প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমান প্রজন্ম এবং সাধারণ শিক্ষিত প্রায় সকলেই ‘কামাল পাশাকে তুরস্কের জাতীয় নেতা ও কর্ণধার বলে বিশেষ মূল্যায়ন করে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস কী বলে? তা উপলব্ধির জন্য কামাল কিভাবে ধর্ম উঠিয়ে আধুনিকতাকে জারি করেছিল নিম্নে তার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেয়া গেল-
কামাল তার দেশের নারীদের পর্দা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সে তার স্ত্রীকে খোলামুখে পুরুষের পোশাকে সর্বত্র ঘুরিয়ে বেড়াত।
১৯২৪ সালে কামাল পাশা বৃত্তি ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত করে আলেমদের অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে। প্রথমে বিদ্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা কুরআন ও ধর্মশিক্ষাদানের ব্যবস্থা রাখে। ১৯২৫ ঈসায়ীতে এ নিয়মও উঠে গেল। তখন হতে পুত্র-কন্যাদেরকে ধর্ম শেখানোর ভার অভিভাবকদের উপর পড়ল।
কামালের মনে হলো, প্রত্যেক দরবেশই নতুন শাসনতন্ত্রের শত্রু। দরবেশদের খানকা ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ও কুসংস্কারের বিকাশ ক্ষেত্র, এ অজুহাতে বিপ্লবী আদালতের সুপারিশক্রমে ১৯২৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মহাসভা করে সমস্ত তেক্কা (কবর) ও তুর্বা (খানকা) বন্ধ এবং দরবেশ প্রতিষ্ঠান তারা ভেঙে দিল। শায়েখ, দরবেশ প্রভৃতি উপাধি ও তাদের রীতিনীতি গ্রহণ, এমনকি তাদের বিশিষ্ট পোশাক পরিধানও দন্ডনীয় বলে ঘোষিত হলো।
চান্দ্র বৎসর কামালবাদীদের নিকট অসুবিধাজনক মনে হলো। ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারা হিজরী সনের পরিবর্তে ইংরেজি আন্তর্জাতিক পঞ্জিকা গ্রহণ করল। এর ফলে পাশ্চাত্যের সাথে পত্রাদি লিখার সুবিধা হলেও মুসলিম জগতের সাথে তুরস্কের একটি দৃঢ়বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল।
মূর্তি নির্মাণ ধর্মবিরোধী; তথাপি ১৯২৬ সালের ৩রা অক্টোবর ইস্তাম্বুলে কামালের মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। তুরস্কে এ দৃশ্য সর্বপ্রথম। পরের বৎসরের (১৯২৬ ঈ.)৪ঠা নভেম্বর আঙ্কারার যাদুঘরের সম্মুখে আরও একটি মূর্তি স্থাপিত হলো।
পারিবারিক আইনই ছিল ইসলামী আইনের সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ। নতুন দেওয়ানী আইন প্রবর্তিত হওয়ায় তাও বাতিল হয়ে গেল।
রাষ্ট্র্রকে সম্পূর্ণ বৈষয়িক করার পথে আর দুটি মাত্র বাধা ছিল। ইসলাম তখনও রাজধর্ম বলে স্বীকৃত হত; একটি আলাদা ধর্মনৈতিক বিভাগেরও অস্তিত্ব ছিল। ১৯২৮ সালের ১০ এপ্রিল শাসন বিধি হতে ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত কথাই বাদ দেয়া হলো। ফলে ইসলাম আর তুরস্কের রাজধর্ম রইল না। পূর্বে প্রতিনিধিরা আল্লাহ পাক উনার নামে হলফ নিতো; এখন হতে নিতে আরম্ভ করলেন আত্মসম্মানের নামে। প্রত্যেক বালেগ পুরুষ ও বয়ঃপ্রাপ্তা নারী ইচ্ছানুযায়ী ধর্মান্তর করার অধিকার পেল।
৩রা অক্টোবর আরবীর বদলে ল্যাটিন বর্ণমালা গৃহীত হওয়ায় মুসলিম জগতের সাথে তুরস্কের আর একটি প্রধান বন্ধন টুটে গেল।
১৯৩৪ সালের ২৬শে নভেম্বর আর একটি আইনে সমস্ত তুর্ক তাদের বে, আগা, পাশা, হানুম, এফেন্দি প্রভৃতি আরবী-ফারসী পদবি ও আহমদ, মুস্তফা প্রভৃতি আরবী নাম বাদ দিয়ে প্রাচীন তুর্ক নাম ও উপাধি গ্রহণে আদিষ্ট হলো। প্রত্যেক তুর্ক পুরুষের পদবি হলো এখন হতে ‘রায়’ ও বিবাহিতা-অবিবাহিতা নির্বিশেষে প্রত্যেক মহিলার ‘বায়ান”। কামাল নিজে মুস্তফা নাম ও গাজী উপাধি ত্যাগ করে আতাতুর্ক (তুর্কদের জনক) ও ইসমত ইনোনু’ (ইনোনুর যুদ্ধ জয়ী) উপাধি গ্রহণ করলো। ২৪শে নভেম্বর মহাসভার এক অধিবেশনে কামাল এই নতুন উপাধিতে ভূষিত হলো।
১৯৩৫ সালে মসজিদের বাইরে ইমাম-মুফতীদের পাগড়ি ও জুব্বা পরা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। শুধু ইমামতি করার সময়ই ধর্মীয় পোশাক পরার অনুমতি মিলল।
কামাল বলল, “পায়ে জুতা, উপরে প্যান্ট, ওয়েস্ট কোট, শার্ট, টাই, কোট এবং সর্বোপরি এদের সাথে মিলিয়ে রৌদ্র প্রতিরোধক শিরস্ত্রাণ যার আসল নাম ‘হ্যাট’ তা হবে আমাদের জাতীয় পোশাক।”
১৯২৫ সালের ২৫শে নভেম্বর ফেজ ও পাগড়িকে জাতীয় পোশাক হিসেবে বাতিল এবং হ্যাটসহ ইউরোপীয় পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে জনৈক কামালবাদী সংসদে একটি খসড়া আইন উপস্থাপন করলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়।
এর সাথে ইসলামী সালামও উঠে গেল। এর পরিবর্তে ‘সুপ্রভাত’, ‘বিদায়’ ও হ্যান্ডশেক রেওয়াজ প্রবর্তিত হলো।
সরকারের আদেশে মক্তব-মাদ্রাসা লোপ ও ধর্ম শিক্ষা দান বন্ধ হওয়ায় কাঙ্খিত ইউরোপীয় শিক্ষা বিপ্লব সম্পূর্ণ হলো। একমাত্র ইস্তাম্বুলেই ৬০০ মসজিদ ভিত্তিক বিদ্যালয় তথা মক্তব ছিল; আজ তার একটিরও অস্তিত্ব নেই।
দেশ থেকে পর্দা উঠিয়ে দেয়া, মাযার-খানকা তুলে দেয়া, দরবেশদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, হিজরী সন উঠিয়ে দেয়া এমনকি মুস্তফা, আহমদ প্রভৃতি আরবী শব্দ উঠিয়ে দেয়া, আরবী বর্ণমালা উঠিয়ে দিয়ে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা, আরবীর পরিবর্তে তুর্কী ভাষায় নামায পড়তে বাধ্য করা, ইসলামকে তুরস্কের রাজধর্ম থেকে বাদ দেয়া, মসজিদের বাইরে ইমাম-মুফতীদের পাগড়ি, জুব্বা পরিধান নিষিদ্ধ হওয়া, পক্ষান্তরে ইউরোপীয় পোশাক যথা স্যুট, কোট, টাই পরিধানের আইন প্রণয়ন করা এবং আইন ভঙ্গকারীদের জন্য তথাকথিত বিপ্লবী আদালতের মাধ্যমে কারাগারে নিক্ষেপ, ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো, সালাম উঠিয়ে তার পরিবর্তে গুডমর্ণিং ও হাই এবং হ্যান্ডশেক ইত্যাদি ইউরোপীয় কালচার প্রচলন করা সব কামালের কীর্তি।
সর্বশেষ খলীফা ছিলেন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ। আর খিলাফত উচ্ছেদের একটি সুযোগ আসে ১৯২২ ঈসায়ীতে ল্যুসেনে অনুষ্ঠিত সভায় ষষ্ঠ মুহাম্মদের উপস্থিতিতে। জাতীয় পরিষদের বিনা অনুমতিতে তিনি উপস্থিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় এবং ১৯২২ ঈসায়ীর ১লা নভেম্বর খিলাফত উচ্ছেদ বিল জাতীয় পরিষদ প্রণয়ন করে। এর ফলে খিলাফত রহিত হয় এবং সুলতান লন্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করে।
খিলাফত রহিতের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিরোধ করে খিলাফত আন্দোলন গড়ে উঠে। ভারতবর্ষেও আগা খান, সৈয়দ আমীর আলী, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী খিলাফত বজায় রাখার পক্ষপাতি ছিলেন; এমনকি অনেকে শেষ উপায় খিলাফত উচ্ছেদ না করে কামালকেই খলীফা হওয়ার আহবান জানায়।
কিন্তু ইসলামবিদ্বেষী কামাল খিলাফত ধারণাটাই রাখতে ইচ্ছুক ছিল না। কারণ তাতে যে ইসলামী চেতনা প্রতিভাত হয়। তাই সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একান্ত অনুরোধ তথা চাপ থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদ ১৯২৩ ঈসায়ীর, ২৯শে অক্টোবর খিলাফত রহিত বিলের বিরোধিতার জন্য রাষ্ট্র্র্রদ্রোহিতার বিল পাস করে এবং প্রচার করে যে, তুরস্ক একটি প্রজাতন্ত্র এবং জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের প্রধান খলীফা নন। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রধান প্রেসিডেন্ট। আব্দুল মজিদ সাময়িকভাবে মুসলমানগণের খলীফারূপে পরিচিত হলেও ১৯২৪ ঈসায়ীর ২রা মার্চ নবগঠিত রিপাবলিকান পিপলস পার্টির সভায় কামাল পাশা খিলাফত সম্পূর্ণরূপে রহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ৩রা মার্চ জাতীয় সভা এই বিষয়ে বিল পাস করে।
এরপরে খুলাফায়ে রাশিদীনের সময় হতে অর্থাৎ ৬৩২ ঈসায়ী হতে খিলাফত শুরু হয়ে দীর্ঘ তের শতাব্দীর পর ১৯২৪ ঈসায়ীতে সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষিত হল। আব্দুল মজিদ পরিবার পরিজনসহ বহিষ্কৃত হন।
কিন্তু পাঠক! তারপরেও শুধু এ যুগেই নয়, সে সময়েও এই খোদাদ্রোহী, ইসলামদ্রোহী ও ইসলামের চরম শত্রু কামালের ভাবমর্যদা ইহুদীবাদী প্রচার মাধ্যমের কারণে কিরূপ ছিল ড. আব্দুল কাদের লিখিত ‘আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস’ থেকে তা জানা যায়।
“জগতে কেউ অমর নয়। কামালও চিরজীবী হয়ে আসেনি। ১৯৩৮ ঈসায়ী ৮ই নভেম্বর তার সংজ্ঞা লোপ পেল। ১০ তারিখে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে সে চিরতরে চক্ষু মুদলো। জন্মের মতো কামালের মুখাবলোকন করার জন্য দেল্মা বাগ্চি প্রাসাদে জনতার হাট বসে গেল। পুলিশের সর্বপ্রকার চেষ্টা সত্ত্বেও ৪ জন মুসলমান, ৩ জন ইহুদী, ১ জন আর্মেনিয়ান ও ২ জন বৈদেশিক ভিড়ের চাপে প্রাণ হারাল। এদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ আর ৭ জনই নারী। কামাল জনসাধারণের বিশেষত নারী সমাজের কত প্রিয় ছিলো, এটাই তার প্রমাণ।”
শুধু তাই নয়, এযুগেও এদেশে কামাল সম্পর্কে কিরূপ চেতনা দেয়া হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের যাবতীয় বই থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরনের একটি বইয়ে নিম্নরূপ মন্তব্য করা হয়-
“মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও ইউরোপের ‘রুগ্ন দেশ’ তুরস্ককে বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষাই করেনি, নবজীবন দানও করে। সেদিক থেকে তাকে ত্রাণকর্তা বলা যেতে পারে। সে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে একটি আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে। সে তার অতুলনীয় সংস্কার দ্বারা সালতানাত, খিলাফত, ক্যাপিচুলেশন ও মিল্লাত প্রথার অবসান ঘটায়। পাশ্চাত্য প্রভাবে সে তুরস্কের আধুনিকীকরণে সফলতা লাভ করে এবং প্রগতিশীল, গণতন্ত্রী এবং সংস্কারপ্রবণ তুরস্ক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কামালকে জাতীয় পরিষদ আতার্তুক বা তুর্কী পিতা নামে অভিহিত করে।”
কবি বলেছেন, ‘এই ঘরে আগুন লেগেছে ঘরেরই আগুন থেকে।’
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১২ বিকাল ৪:৫৫