'স্যার আসব?'
আমি ফাইল হাতে দরজায় দাঁড়ানো চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সী ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটার হাবেভাবে চাকুরী প্রার্থীর ‘অহেতুক স্মার্টনেস দিয়ে আড়ষ্টতা লুকানো’র ব্যাপার টা একেবারেই নাই। বরং তার চেহারায় একটা বিনয়ী অথচ বেপরোয়া ভাবের সাথে কোথায় যেন মিশে আছে প্রচণ্ড কৌতুক!
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে আমার রুমে ঢুকতে বলে হাতের ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বললাম। আমার হাতে ওর সিভি। সিভি টা খুব সহজ এবং নির্ভুল ভাষায় লিখা। ‘লাভ টু ওয়ার্ক আন্ডার প্রেশার’ টাইপের হাস্যকর কোন তথ্য সিভি তে নেই। শুধু একটা তথ্য মারাত্নক বিভ্রান্তিকর। ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স এর জায়গায় ‘থ্রি ইয়ারস( জুলাই ২০১৩ টু জুলাই ২০১৪)’ লিখা! চিন্তা করলাম এটা দিয়েই প্রশ্ন শুরু করি।
- আপনি মাস্টার্স পাশ। জুলাই ২০১৩ থেকে জুলাই ২০১৪ পর্যন্ত কয় বছর হয়?
- ১ বৎসর স্যার!
- তাহলে তিন বছরের অভিজ্ঞতা কেন লিখলেন?
- ঠিক ই লিখেছি স্যার!
- আপনার মাথা ঠিক আছে?
- জ্বী স্যার, ঠিক আছে।
- মাথা ঠিক থাকলে এক বছর কে তিন বছর কেমনে বলেন??
- স্যার আমি লিখেছি চাকুরির অভিজ্ঞতা তিন বছর। ঠিকই লিখেছি!
- আমি দুঃখিত। আপনার সাথে কথা বলে নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নাই। আপনি আসেন!
ছেলেটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠল।আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসল। তারপর বলল- আমি তাহলে আসি স্যার!
ছেলেটা ঘুরে চলে যাচ্ছে, হঠাৎ করে আমার মনে হল ছেলেটাকে চলে যেতে দিলে সে আমাকে একটা রহস্যের মধ্যে রেখে চলে যাবে। সময় যত গড়াবে, রহস্য তত বাড়বে! আমি অস্বস্তি এড়ানোর জন্য খুক করে একটু কেশে তার উদ্যেশ্যে বললাম- আপনি বসেন!
সে এবারো এমন ভাবে বসল যেন কাউকে ‘আসেন’ বলার পর পর ই ‘বসেন’ বলাটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
আমি পিয়ন কে ডেকে চা আনালাম, বিস্কুট আনালাম। সে খুব সহজ ভঙ্গিতে চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেল। তারপর আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগে নিজে থেকেই বলা শুরু করল-
আমি যেখানে চাকরি করতাম সেখানে সকাল আট টা থেকে রাত আট টা পর্যন্ত ডিউটি। ফেস্টিভাল ছাড়া কোন ছুটি নাই। প্রায় সময় আবার নাইট করা লাগত। আমি হিসাব করে দেখেছি এক বছরের চাকরি জীবনে আমি যে কয় ঘণ্টা কাজ করেছি সেটা নরমাল ছুটিছাঁটা সহ যেকোন নটা-পাঁচটা চাকরিতে এক বছরে যে কয় ঘণ্টা কাজ করা লাগত তার তিনগুন।সেই হিসাবে সিভি তে অভিজ্ঞতা তিন বছর লিখেছি! হিসাবের স্প্রেড শীট আমার কাছে আছে স্যার। দেখবেন?
বলে সে ফাইল থেকে স্প্রেড শীট বের করতে গেল। আমি হাতের ইশারায় তাকে স্প্রেড শীট বের করতে না করলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি কি চাকরির ইন্টার ভিউ দিতে যেখানে যেখানে যাচ্ছ সবখানে একই ব্যাখ্যা দিচ্ছ?
নিজের অজান্তেই আপনি থেকে তুমি বলে ফেলেছি। বুঝতে পারছি নিজের অজান্তেই ছেলেটার প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়ে গেছে। মায়ার কারনেই ছেলেটার চেহারার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠা প্রতিটা রেখার ভাষা আমি পড়তে পারছি!
-হ্যাঁ স্যার বলেছি। সবাই এমন ভাবে তাকায় আমি যেন পাগল। স্যার আপনি ত ইঞ্জিনিয়ার। আপনি ই বলেন, আমার হিসাব কি ভুল?
ছেলেটার মুখের রেখার ভাষা আমাকে এমনিতেই এলোমেলো করে দিয়েছিল। ‘আমার হিসাব কি ভুল?’ এই প্রশ্নের তীর যেন আমার অনুভূতি’র মর্ম মূলে গিয়ে বিঁধল!
পুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর বিষে নীল যে পৃথিবীতে গণিতের বিবর্তন হয়ে ‘সমীকরণের’ পরিবর্তে সব ‘অসমতা’ হয়ে গিয়েছে, সেখানে অঙ্ক শুদ্ধ রাখার জন্যই যে তিন কে প্রতি মুহুর্তে এক বানাতে হয়- এই কঠিন সত্য আমি তাকে সেই মুহুর্তে কিছুতেই বলতে পারলাম না। আমি চোখের চশমাটা খুলে অসম্ভব ভারী একটা মন নিয়ে ছেলেটার মুখের কাঁপা কাঁপা রেখা গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।