somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লতিফ মাস্টরের মেয়ে

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নূরুন নাহার প্রচন্ড অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার স্বামী লতিফের দিকে তাকিয়ে আছে। লতিফ আয়না দেখে দেখে চুল আঁচড়াচ্ছে। অনেক দিন পরে গোলাপী রঙ এর ফুলওয়ালা শার্ট টা পরেছে সে। ওর নিঃখুত ভাবে কামানো চেহারায় পুরা নায়ক নাদিমের রোমান্টিক ভাব চলে এসেছে! তবে কি দাদীর -‘ রোজার ঈদ বা কোরবাণী’র ঈদ পুরুষ মানুষের আসল ঈদ না, পুরুষ মানুষের আসল ঈদ হল যেদিন তার বৌ মরে সেদিন!’- এই কথা লতিফের বেলায় ও সত্য হয়ে গেল? গতকাল দূপুরে যে ঘটনা ঘটল তাতে লতিফ কি তাহলে তলে তলে খুশিই হয়েছে? তলে তলেই বা কেন? উপরে উপরেই ত লতিফ কে যথেষ্ট খুশি দেখাচ্ছে। নূরুন নাহার স্পষ্ট শুনতে পেল লতিফ গুন গুন করে গান গাচ্ছে- ‘দুনিয়া কা মজা লেলে দুনিয়া তুমারি হে, দুনিয়া তুমারি হে...’। নুরুন নাহার তার জীবন থেকে বিদায় হবার আগেই লতিফের মনে পীরিতের খেলা শুরু হয়ে গেছে?? প্রচন্ড একটা ঘৃণা নুরুন নাহারের বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে লাগল। এই লতিফ কেই সে ভালবেসেছিল? এই লতিফের চেহারার মায়ায় ভুলেই সে দুবাই থাকা কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো স্বচ্ছল ছেলেকে বাদ দিয়ে পরিবারের সবার অমতে স্কুল মাস্টার লতিফ কে বিয়ে করেছিল?

নুরুন নাহার খাট থেকে উঠে কল ঘরের দিকে গেল। চোখ দুটো অসম্ভব জ্বালা করছে। চাপ কলের পানি দিয়ে চোখ ধুলে চোখের জ্বালা কমবে। কিন্তু অন্তরের ঘৃণার জ্বালা কমানোর কোন উপায় নাই। লতিফ যদি নুরুন নাহারের কাছে এসে বলত- ‘দেখ নাহার, আমার কোন ক্ষমতা নাই তোমাকে আর নিজের স্ত্রী হিসাবে রাখার। গল্প উপন্যাস বা সিনেমায় ভালোবাসা কে অনেক শক্তিশালি হিসাবে দেখালেও বাস্তবের টাকা বা ক্ষমতার কাছে ভালোবাসা কিছুই না। আমাকে ক্ষমা কর নূরুন নাহার!’ তাহলেই নুরুন নাহার আবেগে গলে যেত। লতিফের বুকে মুখ রেখে সে অন্তত হু হু করে কিছুক্ষণ কাঁদত। অসহায়, রোমান্টিক, ভালোমানুষ লতিফের জন্য নূরুন নাহারের বুকে ভালোবাসার কোন কমতি নাই। কিন্তু এ মুহুর্তে সে যাকে দেখছে সে ত আস্ত একটা শয়তান! এই শয়তানের সাথে গত তিন মাস এক খাটে ঘুমিয়েছে এই কথা ভাবতেই নূরুন নাহারের সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল।

লতিফ সাইকেল নিয়ে ঘর থেকে বের হল। সাইকেলের চাকায় হাওয়া কম। চাকায় হাওয়া দিতে হবে। চেন শুকিয়ে ক্রত ক্রত করছে। চেনে কেরাচি দিতে হবে। পেডেল মেরে বড় রাস্তায় উঠতে উঠতে প্রচন্ড গরমে ফেটে চৌচির মাঠের দিকে তাকাল লতিফ। সেই মাঠের মধ্যে এক লহমার জন্য সে যেন ছিরু মাতবরের মুখ দেখতে পেল। প্রচন্ড লালসায় লক লক করছে শয়তানের সাপের মত জ্বিহবা টা! লতিফের ইচ্ছা করল সাইকেলের রড টা খুলে গরম করে শালার পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু লতিফ নিজেকে শান্ত রাখল। লতিফ এখনো বিশ্বাস করে কিছু একটা বুদ্ধি সে বার করবেই। বিএসসি পাশ আব্দুল লতিফ হাইস্কুলে মেট্রিক পরিক্ষার্থী ছেলেদের কঠিন কঠিন সব অঙ্ক করায়। অঙ্ক গুলোও প্রথমে লতিফ কে সাপের মত লকলকে জিহবা দেখায়, মুখ ভেংচায়। লতিফ হার মানেনা। মেজাজ গরম করেনা। বুদ্ধি শান্ত করে সাপের চেয়ে ঠান্ডা চোখে সাপের দিকে তাকায় থাকে। সাপের থলিতে কত বিষ আছে সেটা বুঝে নেয়। তারপর খপ করে সাপের গলা চেপে ধরে। ব্লাক বোর্ডে সাপের মতই এঁকেবেঁকে চলে লতিফ স্যারের চক! পোলাপান চোখ বড় বড় করে বইয়ের উত্তর মালা দেখে। লতিপ ছারের ছাত্র হতে পেরে গর্বে তাদের বুক ভরে যায়। ছিরু মাতবর এবং সে যে পরিস্থিতি টা বর্তমানে তৈরি করেছে তাকেও লতিফের একটা ‘প্রকান্ড অঙ্ক সাপ’ বলেই মনে হয়। লতিফ জানে সে কিছু একটা বুদ্ধি বার করবেই। এই সাপের গলাও সে নিশ্চিত ভাবে চেপে ধরবে। কিন্তু হাতে সময় খুবই কম!

তারক বাবুর দোকানের সামনে এসে সাইকেল থামায় লতিফ। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে। সাইকেল স্ট্যান্ডের উপর দাঁড়া করিয়ে- ‘সিজার সিগারেট এক প্যাকেট দাও ত তারক কাকা’ বলতে বলতে দোকানের সামনের বেঞ্চি’র উপর বসে।

লতিফ কে দেখে ভুঁড়ির উপর থেকে গামছা সরিয়ে গামছার কোণা দিয়ে নাক খুঁটতে খুঁটতে নড়ে চড়ে উঠে তারক বাবু। মধ্য পঞ্চাশের তারক বাবুর বুকের সব লোম পাকা। খসখসে পাকা দাড়ির ভেতর পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো তরমুজের বিচি’র মত কিলবিল করে। হলুদ ঘোলা চোখ নাচাতে নাচাতে তারক বাবু বলে- ও মাস্টর! ঘটনা কি সইত্য? হুনলাম-
- কি হুনলা কাকা?, খ্যাচ করে দেশলাই কাঠি ঠুকে সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করে লতিফ।
- হুনলাম, মাতবর বাইত তুমগো বাপ রে ডাকাইছিল গতকাল। মাতবর সাবে নাকি তুমগো বাপ রে কয়- ‘তর পোলারে ক কাইলকার মধ্যেই যেন হে হের বৌ রে তালাক দেয়। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক!’ আমি ত তোমারে আগেই কইছিলাম মাষ্টর! সুন্দরী মাইয়া বিয়া করছ ভাল কথা। বৌ লইয়া শহরে চইলা যাও। তুমি শিক্ষিত মানুষ। শহরে গিয়া উকিলাতি কর! গ্রামে বাঘ থাকতে তুমি তার সামনে হরিণ নিয়া ঘুরাঘুরি করবা, তা ত হইব না মাস্টর! আইজ হোক কাইল হোক, বাঘ হরিণের ঘাঁড়ে পড়ব। তারে থাবা দিয়া ধরব!!

সিগারেট টানতে টানতে তারক বাবুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে লতিফ। সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার সাথে কথা বলতে বলতে তারক কাকা ফিরে যাচ্ছে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। তখন তারক বাবুর বয়স ছয় বছর। তার মা কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজকের ছিরু মাতবরের দাদা সেকান্দার মাতবর। তারক বাবুর বাবা জনার্দন বাবু প্রতিবাদ করায় তাকে বটগাছের সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। সেই কলঙ্কিত বটগাছের সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যায় ‘বাঘের’ কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আজো বেঁচে থাকা তারক বাবু। ছিরু মাতবরের যে চাচা টার গায়ের রঙ অতিরিক্ত ফর্সা এবং চেহারা অবিকল তার ‘ স্বর্গবাসী’ মায়ের মত তাকে রাস্তায় দেখলে মাথা নিচু করে তার পদধূলি নেয়! বাঘের থাবা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকার জন্য নিজে আর বিয়ে থা করেনি তারক মন্ডল!!

তারক কাকার চেহারার কোথাও এখনো যেন সেই বাঘের থাবার দাগ! নিত্য দিনের নানান সাংসারিক ধুলায় সেই দাগ আড়াল হয়ে থাকে। বিশেষ কোন ঘটনা সামনে এসে যখন মুখটা পরিষ্কার করে আয়নার সামনে ধরে তখুনি শুধু থাবার দাগ টা দেখা যায়। সেই দাগটা বলে দেয়, এই যে শান শওকত, সামাজিকতা, উদারতা, পরোপকারের যে উপর মুখোশ তার ভেতরের ক্ষতটা কতটা দগদগে। কতটা ভয়ঙ্কর! এর পরেও লতিফের মনে হয় তারক কাকা’র মা কে ধর্ষণ করা অথবা বাবাকে বট গাছের সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা কোন কিছুই তারক কাকার পরাজয়ের জন্য দায়ী নয়। তার এই যে ‘বাঘের কর্তৃত্বের কাছে মানসিক ভাবে পরাজয়’ এটাই তাকে নিবীর্য পরাজিত মানুষে পরিনত করেছে। মানুষ নিজে যতক্ষণ নিজেকে পরাজিত না করে ততক্ষণ তাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনা।

কিন্তু লতিফ ই বা কি করবে? নূরুণ নাহার লতিফের স্ত্রী। ‘লতিফ কর্তৃক জোর করে তালাক দেওয়ায়ে নিজে বিয়ে করে মাতবর নূরুণ নাহার কে তার নিজের ভোগের জন্য বৈধ করতে চায়’ এবং এতে বাঁধা দেবার কোন ক্ষমতা লতিফের নাই। আচ্ছা লতিফ যদি স্ত্রী কে তালাক দিতে রাজি না হয় তাহলে মাতবর কি করবে? বটগাছের সাথে বেঁধে লতিফ কে পোড়ায় ফেলবে? ঠিক তারক মন্ডলের বাবা কে যেভাবে পুড়িয়েছিল মাতবরের দাদা? কিন্তু এটা লতিফ মেনেই বা নেবে কিভাবে? নূরুন নাহার কে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। গত সপ্তাহে নূরুণ নাহার আমের আচার খেতে চাইল! লতিফের ইচ্ছা তার একটা মেয়ে হবে। সেই মেয়ে হবে অঙ্কের রাণী! বড় হয়ে সে গ্রামের সব মেয়েকে অঙ্ক শিখাবে। একদিন ইতিহাসের বই এ লিখা হবে তার মেয়ের নাম।

মাতবর যদি নূরুণ নাহার কে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে এসব কিছুই হবেনা। হয়ত নূরুণ নাহার কে গাছের শিকড় বাটা খাইয়ে পেটের বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবে। অথবা মাতবরের ঘরে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত অনাদরে অবহেলায় বড় হবে তার সন্তান! সে যখন একটু বড় হবে তার উপর হয়ত চোখ পড়বে মাতব্বরের কোন বংশ বদের! যে দীর্ঘ অন্ধকারের চক্রে নারী’রা যুগে যুগে পিষ্ট হয়েছে মাস্টার আব্দুল লতিফের মেয়েও সেই অন্ধকার চক্রেই পিষ্ট হবে। কল্পনার চোখে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় আব্দুল লতিফ- কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের ছোট্ট একটা মেয়ে। তার চোখে মুখে সীমাহীন বুদ্ধির ছাপ। চোখের পলকেই সে বুঝে যায় পীথাগোরাসের উপপাদ্য। মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে অঙ্কে লেটার সহ। তারপর আইএসসি পাশ করে, তাও অঙ্কে লেটার। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গনিতের উপর পড়াশোনা করবে। গবেষণা করতে একদিন উড়োজাহাজে চড়ে বিলাতে যাবে। এসবই সম্ভব মেয়ে যদি লতিফ কে বাবা হিসাবে পাশে পায়। আর যদি নূরুণ নাহার ছিরু মাতবরের চার নম্বর বৌ হয়ে তার ঘরে চলে যায় তাহলে হয় তার সন্তান মাতৃগর্ভেই মারা যাবে অথবা একটা অবাঞ্ছিত সন্তান হিসেবে বড় হবে। সে যদি নূরুন নাহারের মত সুন্দরী হয় তাহলে এদেরই কোন বংশ বদের লালসা’র বলি হয়েই হয়ত তাকে একদিন মরতে হবে।

লতিফ যতই ভাবে ততই পূরা ব্যাপারটাকে তার অনতিক্রম্য একটা দেয়াল মনে হয়। সে পুরা বিষয় টাকে আরো স্বচ্ছ মস্তিষ্কে ভাবতে চায়। ধরা যাক একজন পুরুষ । সে অনেক ক্ষমতাশালী। একটা নারীকে দেখে তার মধ্যে কাম বাসনা জাগ্রত হল। নারী টা অন্য একজন পুরুষের স্ত্রী। সে যে পুরুষের স্ত্রী সেই পুরুষ দূর্বল। সে দূর্বল পুরুষ কে আদেশ করল তার স্ত্রী কে পরিত্যাগ করতে। দূর্বল পুরুষের শক্তিশালী পুরুষের আদেশ পালন না করে কোন উপায় নাই। কারণ আদেশ পালন না করার অর্থই হল শক্তিশালী শত্রু তৈরি করা। আর শক্তিশালী শত্রু তার দূর্বল প্রতিপক্ষকে যেকোন সময়ে যেকোন উপায়ে বিনাশ করতে পারে। কোর্ট, সমাজ, মসজিদের ইমাম কার কাছে এর প্রতিকার চাইবে লতিফ?

সে কি কোর্টে গিয়ে বলবে- মাতবর বলেছে তার স্ত্রী কে তালাক দিতে? একথা বললেই কি কোর্ট মাতবরের কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে কোর্টে চালান করবে? তাছাড়া মাতবর যে একথা বলেছে তার প্রমান কি? মাতবরের চেলা যারা সেই সময়ে কাছারি ঘরে উপস্থিত ছিল তারা কি কোর্টে গিয়ে মাতবরের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে? এই ভয়ঙ্কর বিষয়টাকে শক্তভাবে আদালতে উপস্থাপনের কোন রাস্তাই খোলা নাই।

সমাজ ই বা তার পক্ষে কেন আসবে? তার পক্ষে আসা মানেই ত মাতবরের রোষানলে পড়া। তারা সর্বোচ্চ যেটা করবে সেটা হল নিজেরা সেফ সাইডে থেকে লতিফ কে মাতবরের বিরুদ্ধে খেপানোর চেষ্টা করবে। এতে লতিফের কোন বিপদ হলে তারা পরে আবার মাতবরের পক্ষেই কথা বলবে। বলবে- লতিফ একটা বলদ। সামান্য একটা মেয়েমানুষের জন্য কেউ নিজের জান দেয়??

গ্রামের সবচেয়ে বড় মসজিদ টি ছিরু মাতবরের বাবা শামছু মাতবরের গড়া। সেই মসজিদের ইমাম শায়খ আবু জান্দাল আল হাদী আল বরকতপুরি ছাহেব অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী। নাফসের পাল্লায় পড়ে মানুষ কিভাবে নিজের আখেরাত ধ্বংস করে সেটা উনি বিভিন্ন রকম কিচ্ছা কাহিনী সহকারে জুম্মার খুৎবায় বয়ান করেন। সেসব কিচ্ছা কাহিনীতে অবশ্য সেকান্দার মাতবর কিভাবে নাফসের পাল্লায় পড়ে তাদের ঘরের এক দাসী’র সাথে যৌন সঙ্গম করেছিলেন এবং সেই দাসী ‘অন্যায় ভাবে’ গর্ভবতী হবার শাস্তি হিসাবে তার যৌনাঙ্গে জ্বলন্ত মোমবাতির ছ্যাঁকা দেবার মাধ্যমে নিজের আখেরাত ধ্বংস করেছিলেন সেই অশ্লীল গল্প কিছুতেই বলা হয়না। মাতবর বংশের ‘মহান পুরুষ’ দের জন্য নামাজান্তে দোয়া করা হয়। সময়ের সাথে সাথে যাতে তাদের সম্পদ, প্রতিপত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় তার জন্য দোয়া করা হয়। শায়খ আবু জান্দাল আল হাদী আল বরকতপুরি ছাহেবের কাছে যদি লতিফ এই ঘটনার বিচার চাইতে যায় তাহলে বরকতপুরি ছাহেব লতিফ কে সর্বোচ্চ যেটা বলবে সেটা হল- ‘বাবা লতিফ, ছবর কর। যদি আল্লাহ পাক তার স্বীয় কুদরতের মারফত তোমার স্ত্রী কে মাতবর ছাহেবের স্ত্রী তে পরিনত না করেন তাহলে তোমার স্ত্রী যাতে তোমারই থাকে সেই ব্যবস্থা আল্লাহ পাক নিজেই করবেন। আর সেটা যদি আল্লাহ পাকের ইচ্ছাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমি ত সেটা রদ করতে পারব না। আল্লাহ যেটা করেন সেটা যে আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন বাবা লতিফ!’ লতিফ যদি আজকে নিজের স্ত্রী কে তালাক দেয় তাহলে হয়ত শায়খ আবু জান্দাল আল হাদি আল বরকতপুরি ই ছিরু মাতবর আর নুরুন নাহারের বিয়ে পড়াবে! প্রচন্ড একটা ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠে লতিফের।

লতিফ দেখতে পায় এর সমাধান একটাই। আপাত দৃষ্টিতে বহুঘাত আছে বলে মনে হলেও এটা আসলে একঘাত সমীকরণ এবং এর উত্তর একটাই!
অঙ্ক মিলে যাবার পর শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট টা পায়ের তলায় পিষে ফেলতে ফেলতে উঠে দাঁড়ায় লতিফ। এখন শুধু সাহস সঞ্চয় করতে হবে। নিরাবেগ, ঠান্ডা, যুক্তি দিয়ে পরিচালিত সৎ সাহস। এই সৎ সাহসের মাত্রা যত বেশি হবে পরিকল্পনা তত নিঃখুত হবে। নিঃখুত পরিকল্পনা করার পর সেই পরিকল্পনা সফল ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

গায়ে রেশমের পায়জামা পাঞ্জাবি কটি, মাথায় কিস্তি টুপি, চোখে সুরমা, দাড়িতে মেহেন্দি, শহরে যাবার জন্য ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার আগে আলবোলার নলে গভীর ভাবে টান দিলেন সেকান্দর মাতবরের নাতি শামছু মাতবরের পোলা ছিরু মাতবর! শামছু মাতব্বরের চার বিবি’র আষ্ট পোলার মধ্যে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস পোলা ছিল ছিরু। ছোটবেলায় মাতবরের সব পোলাদের হাতে একটা করে বেত থাকত প্রজাদের বেয়াড়া পোলাগুলোকে পিটানোর জন্য। সাত বছর বয়সেই এক বেয়াড়া প্রজার পোলা ভুল করে ছিরুর পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে ফেলছিল বলে পিটিয়ে তার পাছার ছাল তুলে দিয়েছিল ছিরু। সেই পাছার ছাল উঠা বশির এর ছেলে পড়ালিখা করে আজ ইস্কুল মাস্টর! নুরুন নাহার নামক ‘চৌদ্দ দিনের চাঁদ’ নাকি সেই দুই টাকার ইস্কুল মাষ্টরের বৌ!দুই টাকার ইস্কুল মাষ্টর রোজ রাতে চৌদ্দ দিনের চাঁদকে...।!

নুরুন নাহারের রূপের কথা আগে মানুষের মুখে শুনেছে ছিরু মাতবর। কিন্তু মানুষের মত শয়তান দুনিয়াতে আর দুইটা নাই। খামাকা বাড়ায় কথা বলে। যে মাইয়ার দিকে তাকায়া তার ‘আলবোলার নলি’ বিলকুল ঝিমায় থাকে তারে কয় হুরপরি! এজন্য নিজের চক্ষে না দেখা পর্যন্ত ছিরু মাতবর কারো কথা বিশ্বাস করেনা। এর আগে ‘স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করে’ যে দুই হুরপরি কে বিয়ে করেছে তাদের প্রত্যেক কেই আগে নিজের জহুরি চোখ দিয়ে যাচাই করে নিয়েছে। স্বামীগুলো এখন তার সেরেস্তায় চাকরি করে। এক কালের বিয়ে করা বৌ কে ‘আম্মা’ ডাকে! লতিফ মাস্টর কেও সে নিশ্চয় একটা চাকরি দেবে। স্কুলের বেতনের চেয়ে ভাল বেতনের চাকরি। সে যেহেতু অঙ্কের মাস্টর তার মাথা নিশ্চয় ভাল। আর ‘তার উপযুক্ত’ একটা বৌ ও এর ব্যবস্থাও নিশ্চয় করবে। একটু শ্যামলা গায়ের রঙ, একটু চাকরানি চাকরানি চেহারার লক্ষ্মী একটা মেয়ে যে মাঝে মাঝে নুরুন নাহারের কাপড় চোপড় ধুয়ে দেবে!

ঘোড়ার গাড়িতে উঠে সহিসের উদ্যেশ্যে হাঁক ছাড়ল ছিরু মাতবর। ঘোড়া ধুলা উড়িয়ে শহরের উদ্যেশ্যে যাত্রা করল।

দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ নির্জন পাকা রাস্তার পিচ পর্যন্ত গলিয়ে দেয়। সেই রাস্তা দিয়ে পাগলের মত সাইকেল মেরে যাচ্ছে লম্বা দাড়িওয়ালা এক যুবক। তার মাথায় পাগড়ি। গায়ে লম্বা জোব্বা। সন্ধ্যার আগেই তাকে পৌঁছে যেতে হবে লামহুছড়ি’র ঢাল। লামহু ছড়ির ঢাল থেকে শহর আরো ছয় মাইলের পথ। লামহু ছড়ির ঢালের আশেপাশের শকুনগুলা অনেকদিন ভালোমন্দ কিছু খায়না। তাদের ভালোমন্দ খাবারের ব্যবস্থা করবে আজ যুবক!

ঘোড়ার গাড়ি’র সীটে হেলান দিয়ে নুরুন নাহারের গোলাপী শরীর কল্পনা করতে করতে ঘেমে উঠে ছিরু মাতবর। আজ রাত টা পোহালেই আগামীকাল নুরুন নাহারের সাথে তার বিয়ে। নাইয়ুরি নৌকার ছই এর ভেতর দেখা নুরুন নাহারের ভীতা হরিনীর মুখটা নিজের বুকের উমের ভেতর কল্পনা করতেই বুক টা আবার ধুক ধুক করে উঠে মাতবরের! সেই কল্পনার ঘোরে থাকার ফলেই মাতবর বুঝতেই পারেনা সহিস আস্তে আস্তে ঘোড়া চালানোর ফলে তিন ঘন্টার রাস্তা পাঁচ ঘন্টার হয়ে শহরে পৌঁছানোর অনেক আগেই চারদিক আন্ধাইর হয়ে সাইনঝা নেমে এসেছে!! মাতবর সহিস কে মিষ্টি ধমক লাগায়- মিঞা জোরসে! জোরসে ছোটাও ঘোড়া!!

সহিস হঠাৎ লাগাম ছেড়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে নিজের বুক! নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গাড়ি গড়িয়ে খাদে পড়তে চায়। সহিস প্রাণপণে লাগাম টেনে গাড়ি থামাতে থামাতে আতঙ্কিত চিৎকার করে- মরণ! মরণ! হুজুর আমার মরণ!

সন্ধার অন্ধকারে গাড়ি থেমেছে। ছিরু মাতবরের মুখ আতঙ্কে নীল! এই সন্ধার অন্ধকারে সহিস বুকে ব্যাথা নিয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। সাথে কোন লোকজন নাই। কি ভয়ঙ্কর! এই জায়গাটা ঘন জঙ্গল। যখন তখন বন্য হাতি নেমে আসে। পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ার গাড়ি নিজে চালিয়ে এতটা পথ একা যাওয়া ছিরু মাতবরের অনভ্যস্ত ইন্দ্রিয় সর্বস্ব শরীরের কম্ম নয়!

কিন্তু ওকি? অন্ধকার ফুঁড়ে কে আসে?? গায়ে সাদা জোব্বা, মুখে লম্বা চাপ দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। তার মত পাপীকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ পাক ‘খাজে খিজির’ কে পাঠিয়ে দেবেন সেটা কিছুতেই বিশ্বাস হয়না ছিরু মাতবরের!

কিন্তু যুবক এসে গাড়িতে উঠে। ছিরু মাতবর কে ‘আছছালামুআলাইকুম’ বলে সালাম দেয়। তারপর বলে- আমার পরিচয় আপনার জানার প্রয়োজন নাই। আপনার যেটা বিশ্বাস হচ্ছেনা সেটাই হয়ত বিশ্বাসযোগ্য! আপনি আরাম করে বসুন। আপনার সহিস কে আমি গাড়িতে তুলে নিচ্ছি। আমিই গাড়ি চালিয়ে আপনাকে শহরের কাছাকাছি পৌঁছে দেব। ততক্ষণে আপনার সহিস জেগে উঠবে। এরপর আমি আমার পথে চলে যাব। সহিস আপনাকে শহরে পৌঁছে দেবে। আমার কথা আপনার কাউকে বলার প্রয়োজন নেই।

যুবক দেখতে দেখতে ভারী সহিস কে কোলে করে গাড়িতে তুলে শুইয়ে দিল! তারপর চালকের আসনে যাওয়ার পরিবর্তে সটান ছিরু মাতবরের সামনে এসে দাঁড়াল! জোব্বার আড়াল থেকে পিছলে বেরিয়ে এল একটা চকচকে ধারালো রড!!

- কে তুমি যুবক? আ আজরাইল?
- ভাবতে পার!
- সোনাদানা কি চাও বল? জমিদারি দিলে হবে? সুন্দরি বৌ?
- কিচ্ছু লাগবে না। তোমার দাদা সেকান্দর মাতবরের কলিজা যেটা তুমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছ, যেটা ‘খালি হরিণ খাওয়ার জন্য লাফায়’ সেই কলিজাটা পেলেই আমার চলবে। আর কিচ্ছু লাগবেনা।
- তোমার পায়ে ধরি মাস্টর!! নু নুরুণ নাহার আমার মা!
- অঙ্কের মাস্টর চক ধরতে জানে। বোর্ডে পিছলা খেয়ে তার চক ভাঙ্গেনা!

ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর ধারালো রড দিয়ে আঘাত টা করে লতিফ। ঘোড়াগুলো আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে। সহিস পিঠের উপর এখনো না শুকানো মাতবরের চাবুকের ক্ষতগুলোর উপর হাত বুলায়। নিঝুম নিস্তব্ধ রাস্তা গড়িয়ে পড়া রক্তের দাগ বুকে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
..................

কোর্টে মামলায় নিজে রাজ সাক্ষী হয়ে সহিসের জীবন বাঁচায় লতিফ। তবে শকুন রা আসার আগেই ছিরু মাতবরের লাশ পুলিশ রা সরিয়ে ফেলেছিল। লতিফের যেদিন ফাঁসি হয় সেদিন তারক মন্ডল পাগল হয়ে যায়। ছিরু মাতবরের যে চাচা টার চেহারা অবিকল তার মায়ের মত ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে ‘দাদা দাদা’ বলে ডাকতে থাকে আর বটগাছের গোড়াটাকে একটা দা দিয়ে পাগলের মত কোপাতে থাকে। মাতবরের লোক এসে তারক মন্ডল কে বট গাছের সাথেই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে।

নুরুন নাহারের মেয়ে সুরাইয়া নাহার দেখতে মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছে। স্কুলে সে অঙ্কে সব সময় একশ তে একশ পায়। গ্রামে সুরাইয়া নাহার নির্ভয়েই চলাফেরা করে। তার বাপই নাই, অথচ তার ‘বাপের মেয়ে’ হিসাবেই সুরাইয়া নাহার কে গ্রামের সব বদমাশ রা ভয় পায়!!







সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:০৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×