মূল গল্পঃ সৈয়দ বদরুল আহসান
বাঙ্গালী উভয় বাংলায়-ই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে৷ এ কথাটি যেমন সত্য তেমনি এটা-ও সত্য যে, বাঙ্গালী বরাবরই ইতিহাসে বন্দি রয়েছে৷ অবশ্য এ বন্দিদশার কারণ গোটা বাঙ্গালী জাতি নয়৷ এর পেছনে যে মূল ভূমিকা সেটি সব সময় রয়েছে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে৷ ভারতবর্ষের ইতিহাসও এই বাস্তবতারই সা্য বহন করে৷ সেই ১৯০৫ সালে যখন বাংলাকে দু'ভাগে বিভক্ত করা হয় তখন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী শ্রেণীই সেই বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে৷ হোক না সে বাঙ্গালী হিন্দু_অথবা হিন্দু বাঙ্গালী৷ পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হচ্ছিল তা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থণৈতিক স্বার্থে আঘাত করেছিল৷ সেেেত্র বাধাটা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকে আসবে সেটাই স্বাভাবিক৷
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মৌলিক সমস্যা সর্বকাল ধরে ঐ রকমেরই_হঁ্যা, পরিবর্তন খুব-ই প্রয়োজনীয়, তবে পরিবর্তন কতটা হবে, কি পরিমাণে হবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি৷ ১৯০৫ সালে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের কাছে পরিবর্তনটা হয়ে উঠেছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি৷ অবশ্য তাঁদের মধ্যে থেকে আবার এই আওয়াজও উঠেছে যে, বাংলার অখণ্ড ঐতিহ্য মহাবিপদের সম্মুখীন, কারণ হচ্ছে ঐ যে এক বাংলাকে দুই-এ পরিণত করা হলো সেটি৷ আবার অন্যদিকে পূর্ববাংলায় অন্য এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঐ বিভক্তির সিদ্ধান্তকে একটা যুগান্তকারী পদপে হিসেবে গণ্য করেছে৷ এই ব্যাপারটাও খুবই স্বাভাবিক৷ আধুনিক যুগে এই প্রথম বারের মত বাঙ্গালী মুসলমান তার নিজের জন্য একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থান তৈরি করে নিয়েছে৷ ফলে মুসলমান পূর্বের ন্যায় আর হিন্দুর শোষণের শিকার হবে না৷ এক কথায়, ইতিহাস তার ছাপ অবশেষে বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে রেখেছে৷ মনে হচ্ছিল ভবিষ্যত্শুধু আলোয় আলোকিত৷
ধারণাটি ছিল ভুল৷ আর একটু এগিয়ে বলতে হয় যে, পূর্ব বাংলাকে সমগ্র বঙ্গ থেকে পৃথক করণের ভেতর দিয়ে সমাজের একটি অংশের জন্য নতুন ধরনের সুযোগ সন্ধানের অবকাশ করে দেওয়া হলো৷ পূর্ব বাংলার নবাব পরিবার, বাঙ্গালী মুসলমানদের মাঝে মুষ্টিমেয় শিতি মানুষ যাদের কখনোই সাধারণ জনতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, তারাই বাংলার বিভক্তিকরণে আনন্দ পেয়েছে৷ সে আনন্দের ব্যাপ্তি অবশ্য খুবই স্বল্প পরিসরের৷ ১৯০৬ সালে যখন মুসলিম লীগ-এর সৃষ্টি হয়_এবং সে ঘটনাটি ঘটে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায়_তখনই এই সত্যটি ফুটে উঠে যে, যে-পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার ফলাফল সমাজের বিভিন্ন, বিশেষ করে নিম্নস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছবে না৷ অতএব ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় তখন সাধারণ জনগণের মাঝে তেমন কোন প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয় নি৷ পুরো ব্যাপারটি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝে সীমাবদ্ধ৷ দ্বন্দ্ব ছিল এবং রয়ে গেল, হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্তদের ভেতর_যার পরিণাম ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে অনতিদূর ভবিষ্যতে৷
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ইতিহাসের আলোকে অবলোকন করছেন৷ তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট_বাঙ্গালীর আধুনিক কালের ইতিহাসে বরাবরই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সামাজিক তথা রাজনৈতিক বিপবের পথে একটি অন্তরায় হয়ে রয়েছে৷ তবে কি মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিবর্তন কখনো চায় নি? হঁ্যা, চেয়েছে৷ কিন্তু সে-চাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে৷ যেন নীতিটি ছিল কিছু দূর যাওয়া এবং তারপর হয় থেমে যাওয়া, না হয় পেছনের দিকে ফিরে আসা৷ এই যুক্তির প েযে ঐতিহাসিক উদাহরণ চৌধুরী উপস্থাপন করছেন তা হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম৷ সে-বছর বাঙ্গালী, পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী, স্বাধীন জাতি হিসেবে তার উপস্থিতি বিশ্বের দরবারের ঘোষণা করেছে, জোর গলায়৷ কিন্তু তাই বলে মানুষের মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে? যে রাজনৈতিক শ্রেণী চরিত্র আওয়ামী লীগ বহন করেছে সে চরিত্রে বৈপবিক কিছু সাধন করা স্বাভাবিক কারণেই সম্ভব ছিল না৷ হঁ্যা, তাজউদ্দিন আহমদ হয়তো অন্য একটা কিছু করতে পারতেন, নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করতে পারতেন৷ তাঁর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তিনি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন৷ চিন্তাধারায় তিনি ছিলেন বামপন্থী অথচ তাঁকে বসবাস করতে হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণীর মাঝে৷ তাজউদ্দিন স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন, কিন্তু তিনি এটা স্পষ্টতই অাঁচ করতে পেরেছিলেন যে, তাঁর ল্য ও তাঁর দলের ল্য এক ও অভিন্ন নয়৷ মধ্যবিত্ত আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিদ ও শেখ ফজলুল হক মনি-র তৈরি করা মুজিব বাহিনী ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রামের পথে একটি বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ সমস্যা ঐ এক এবং পুরাতন : মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী তার নিজ স্বার্থের স্বাধীন হতে চেয়েছে, তাই গোটা সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে এমন কোন অঙ্গীকার সে করে নি৷ অতএব পথের মাঝে এসে যখন এই বাঙ্গালী অনুধাবন করেছে যে, তার প্রয়োজন মিটেছে, তখন সে সংগ্রামের সমাপ্তি টেনেছে৷ আর বাকি সমাজ? সেটা পূর্বে যেই স্তরে ছিল সেই স্থানেই রয়ে গেল৷ নতুন যা চোখের সামনে ভেসে এলো তা হলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিদায়, অর্থাত্অবাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও সামন্তবাদের বিদায়, এবং তার স্থলে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উদয়৷
তবে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সঠিক পথে পরিচালিত হয় নি? নাকি মাঝ পথেই বিপবের একটি বিরাট সম্ভাবনাকে হত্যা করা হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যেমন কঠিন তেমনই দুঃখজনক৷ কারণ এই যে, যে-মুক্তি সংগ্রাম আরো দীর্ঘ কাল পরিচালিত হতে পারতো এবং হওয়া দরকার ছিল সেটা দ্রুত এক জায়গায় এসে থেমে গেছে৷ অন্য কথায় বলতে গেলে থামিয়ে দেয়া হয়৷ এবং তার মূল কারণ ছিল ভয়_মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভয় যে, যদি সংগ্রাম তার হাতের বাইরে চলে যায় তাহলেই তো স্বাধীনতার ব্যাপারটা বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে৷ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের ফল দাঁড়ায় এই যে, আপামর জনগণ যে ধরনের সামাজিক তথা বৈপবিক পরিবর্তন আশা করেছিল তার কিছুই ঘটে নি৷ পাকিস্তানি শোষক শ্রেণীর বদলে বাঙ্গালী শোষক শ্রেণী দেশের সর্বময় মতার অধিকারী হয়ে দাঁড়াল৷ রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র ঐ পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক শিায় শিতি ও প্রশিণপ্রাপ্ত বাঙ্গালী প্রাধান্য পেল৷ গ্রামের দরিদ্র কৃষকের মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে ফিরে যেতে হলো তার পূর্বেকার দারিদ্র্যে৷ আবার অন্য দিকে মধ্যবিত্ত থেকে উঠে-আসা একদল মানুষ হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সব চাইতে বেশি লাভবানকারী অংশ৷ রাজনীতি তার পুরাতন ধারায় চলতে থাকে৷ রাজনৈতিক দল ফিরে যায় সেই বুর্জোয়া পন্থার রাজনীতিতে৷ এমনকি যে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেতার আদর্শের উপর নির্ভর করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় সেই আদর্শই হুমকির মুখোমুখি হয়৷ যে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার কাজে পথ বেছে নেয়, যে-পথ ১৯৬৬-এর ছয় দফা সংগ্রামের ফলে প্রশস্ত হয় এবং পরবতর্ীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ণতা লাভ করে, সেই একই বাঙ্গালী ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান-এর লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগদানকে একটি বলিষ্ঠ পদপে বলে গণ্য করে৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজকে স্বাধীন মনে করেছে ঠিকই, তবে সে এটাও বুঝলো যে মতার কেন্দ্রস্থলে থাকতে হলে তাকে কিছুটা হলেও আপোস করতে হবে৷ এবং আপোস সে স্বেচ্ছায় করলো৷ যার কারণে ১৯৭৫-এর পরবতর্ী সময়ে যখন জেনারেল জিয়া বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ-এর পাশাপাশি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করিয়েছিলেন তখন প্রতিবাদকারী ১৯৫২ অথবা ১৯৬৬ অথবা ১৯৭১-এর বাঙ্গালীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর চিন্তার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না, এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক৷ তারপরও তাঁর বিশেষণ খণ্ডন করা একটি দুরূহ ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায়৷ সহজ কথাটি হচ্ছে যে বাঙ্গালী_এবং এর মাঝে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজের বাঙ্গালীকেই বোঝানো হচ্ছে_সব সময়-ই নির্যাতিত হয়ে এসেছে৷ তার উপর রয়েছে আবার তার ধমর্ীয় চিন্তাধারা৷ এর পাশাপাশি এসেছে শ্রেণী ভেদাভেদ৷ যে বাঙ্গালী, নেতৃস্থানীয় বাঙ্গালী, এই জাতিকে ভারতবর্ষে একটি আলাদা ও নিজস্ব সত্তা দিতে পারতেন তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ৷ কিন্তু ১৯২৫ সালে তাঁর অকাল মৃতু্য সে-সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়৷ পরবতর্ীকালে সুভাষচন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধী-র হাতে নাজেহাল হয়েছেন৷ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে সুভাষের বিজয় ও সিতারামাইয়ার পরাজয়কে গান্ধী মানসিক ও রাজনৈতিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি৷ ইতিহাস তখন বড় একটা মোড় নেয়৷ তারপর যে সম্ভাবনাটি ছিল সেটি হলেন এ. কে. ফজলুল হক৷ লেখক আেেপর সুরে বলছেন_এবং সেই আপে আরো অনেক বাঙ্গালীর_যে যে-মুহূর্তে ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ-এ যোগ দিলেন সেই মুহূর্তে উপমহাদেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়৷ পাকিস্তান সৃষ্টির পর যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধাপে ধাপে অগ্রসর হয় এবং যার নেতৃত্ব ১৯৬০-এর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে বর্তায় সেটাও স্বাধীন বাংলাদেশে ধীর ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে৷
অথচ এমনটি তো হবার কথা ছিল না৷ মুক্তিযুদ্ধের শেষের ভাগে তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর এক সরকারী কর্মকর্তাকে গভীর ভারাক্রান্ত ভাষায় বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ তো স্বাধীন হবে অবশ্যই_তবে ঐ সঙ্গে তিনি এও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছুটা আত্মজিজ্ঞাসার ধাঁচে, যে সে স্বাধীন রাষ্ট্র আদৌ বাঙ্গালীর বাসযোগ্য হবে কি না৷ আমাদের দুঃখটা এখানেই যে, এই স্বাধীন বাংলাদেশেই স্বাধীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহকমর্ীরা প্রাণ দিয়েছেন৷ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং নিহত হলেন৷
এ সবই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভুল ও ভয়-এর কারণে ঘটেছে৷ ভুল ছিল স্বাধীনতা স্বল্প সময়ে চাওয়া এবং পেয়ে যাওয়া৷ আর এই শ্রেণীর ভয় ছিল যে, মুক্তিসংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে জনগণ ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিকে অগ্রসর হবে৷ ভয় ছিল যে, বাংলাদেশের সংগ্রাম যত বেশি সময় নেবে তত বেশি ভিয়েতনামের সংগ্রামের আকার ধারণ করবে৷ আর তাই যদি হতো এবং হতে দেওয়া হতো তাহলে তো এই দেশে বুর্জোয়া রাজনীতিকে তার ইতি টানতে হতো৷ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের স্বাভাবিক গতিকে দুই ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়৷ প্রথমত, আওয়ামী লীগ কখনোই চায়নি যুদ্ধ বেশি সময় ধরে চলুক, কেননা তার ফলে একটা জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন পূর্ণ আকার ধারণ করার সম্ভাবনা ছিল প্রকট৷ দ্বিতীয়ত, ভারত সরকার ও তার সামরিক বাহিনী কখনো এটা মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না যে, তাদের দুয়ার পার হলেই একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের অবকাঠামো ল করা যাবে৷
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ৷ এই স্বাধীন দেশেও সেই সীমাবদ্ধতাগুলো রয়ে গেছে৷ এক দিকে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে_এবং এই বাড়তি সংখ্যা নতুন ভয়ের সঞ্চার করছে_তেমনি অন্য দিকে বেড়েছে বাংলাদেশের নব্য ধনী গোষ্ঠীর উদীয়মান প্রতাপ৷ এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে দুনর্ীতি, এর সদস্যরা হচ্ছে ঋণখেলাপি, আবার এদের পেছনেই রয়েছে বৃহত্রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা৷ এই দুয়ের মাঝে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আবার বাঁধা পড়েছে৷ একদিকে আশঙ্কা রয়েছে যে, দারিদ্র্য যতই বৃদ্ধি পাবে ততই সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে এবং এই বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাঙ্া পূরণে আরো ব্যাঘাত ঘটবে৷ আবার নব্যধনী শ্রেণী যত বেশি তার প্রসার ছড়াবে তত বেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার, নিজের মতাহরণ ল করবে৷
বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রাম সেই উনবিংশ শতাব্দী থেকে চলে এসেছে, এবং আজও সে সংগ্রাম শেষ হয় নি৷ কিন্তু সেটা আদৌ কি সংগ্রাম? নাকি গা-বাঁচিয়ে চলার একটি অন্তহীন প্রয়াস? এই শ্রেণীর সামনে রাজনৈতিক কর্মপন্থা বা এজেন্ডা বলতে যা বুঝায় তা সাধারণত কখনোই ছিল না৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণী যুগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, যার ফলে জনগণের রাজনৈতিক ও সামাজিক আশা-আকাঙ্া পূরণের ব্যাপারে প্রায় প্রতিবারই বাধা পড়েছে৷ এই ধরনের মনোভাবের কারণেই যে-সামাজিক বিপব আশা করা গিয়েছিল সে-বিপব আর সংগঠিত হয় নি৷
সামাজিক বিপব প্রস্তুতির েেত্র যে-পরিকল্পনার প্রয়োজন সে-পরিকল্পনা অসমাপ্ত রয়ে গেছে৷ হঁ্যা, মধ্যবিত্ত শ্রেণী অবশ্যই বিভিন্ন েেত্র উন্নতি সাধন করেছে, যেমন শিা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে৷ তা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এসব কিছুকে সামাজিক পরিবর্তনের েেত্র ব্যবহার করতে সম হয় নি৷
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিযোগ আসলে সমগ্র জাতির অভিযোগ৷ প্রশ্ন থেকে যায় অভিযোগটির মুখোমুখি আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী আদৌ হতে পারবে কি? যদি পারে, তাহলে তার ফলশ্রুতি কি হবে?