somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

When Breath Becomes Air

১০ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জানলার ওপাশে নীল শার্ট গায়ের দুই সিএনজি ড্রাইভার তুমুল মারপিট করছেন । বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সুচাগ্র মেদিনী- সুলভ অবস্থা । পাশে স্যুটকেস হাতে হতবিহ্বল মুখে খুব সুশ্রী চেহারার এক মেয়ে দাড়ানো । বোধকরি তাকে যাত্রী হিসেবে নিজের সিএনজিতে তোলা নিয়েই এ খন্ডযুদ্ধ । দেখতে দেখতে মানুষ জমে যায় । কয়েকজন দেখলাম হাতে তালি দিয়ে উৎসাহও যোগাচ্ছে ।

এসি বাসের ভেতরের আরামদায়ক উষ্ণতায় বসে সত্যি বলতে কী মারামারিটা দেখতে আমারও ভালোই লাগে । নিজের ভেতরের হতাশা, ক্ষোভ সবকিছুকে অবদমন করে রাখতে রাখতে সুশীল সমাজ যেখানে হয়ে পরছে শারীরিকভাবে অক্ষম, মানসিকভাবে পঙ্গু, যেখানে সবকিছুর জন্যে আমরা তাকিয়ে থাকি 'কেউ এসে সমাধান করে দিচ্ছে না কেন?' এই প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায়, সেখানে সোশ্যাল হায়ারার্কিতে একটু নিচে অবস্থান করা এই দুইজনের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই ফায়সালা করে নেয়ার এমন মহতী উদ্যোগ প্রশংসনীয়ই আসলে ।

কোলে উপুড় হয়ে পরে আছে আক্ষরিক অর্থেই দুই দেশ খুঁজে আনা বই 'When Breath Becomes Air'. লেখক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, মেধাবী একজন নিওরোসার্জন । ছোটবেলা থেকেই তিনি মৃত্যুকে নিবিড়ভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন । এজন্যে প্রথমে দ্বারস্থ হয়েছিলেন সাহিত্যের কাছে । নিৎসে, বেকেট, রাসেল, ডিকেন্সদের অক্ষরে অক্ষরে মৃত্যুকে জানতে জানতে একসময় তার মনে হয় মৃত্যুর ধারনাটা আরেকটু আন্তরিক ও ব্যক্তিগত, একে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাঁটাছেড়া করে দেখা প্রয়োজন । তাই ভর্তি হলেন মেডিকাল কলেজে । অকল্পনীয় পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর অপারেশন থিয়েটারে অসংখ্য মৃত্যু-পুনর্জীবনের সাক্ষী হয়ে যখন তিনি সনদ নিয়ে যোগ দেবেন কর্মক্ষেত্রে, হুট করে একদিন জানা গেলো তার শরীরে তখন বাসা বেঁধেছে ভয়াল ক্যান্সার । পৃথিবীতে তার পরমায়ু বেশি বাকি নেই ।

মৃত্যুকে যে মানুষ জানতে চেয়েছিলো নিবিড়ভাবে, ব্যক্তিগত ভাবে তাকে উপলব্ধি করার চেয়ে ভালো উপায় আর কী-ইবা হতে পারতো? মৃত্যুর আগের সময়টুকুতে তিনি আবার হাতে তুলে নিলেন কলম, নিজের অনুভূতির কথাগুলো লিখতে লিখতে বলে গেলেন কতোই না ঠুনকো আমাদের স্বপ্ন, বাস্তবতা! তাসের ঘরের মতো কত অবলীলায়-ই না তা ধসে যেতে পারে ..

বইটা পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখতে পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান । শেষ অংশের Epilogue-টা লিখেছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী ।

খুব বিষন্ন বই । গত দুইদিন মেঘ করে থাকা আকাশের চেয়েও বিষন্ন ।

আকাশের দিকে চোখ রেখে বাসে যে লোকটা গজল গাইতে গাইতে তার ঝোলায় থাকা নানান জিনিসপত্র বিক্রির চেষ্টা করছে বহুক্ষণ যাবত, তাকে ডাক দেই, 'হুজুর, এই দিকে আসেন ।'

প্রায়ান্ধ একজন মানুষ । ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বাস রুটে আতর, মেসওয়াক, নামাজের টুপি, তসবি বিক্রি করেন । প্রায়ই দেখি যাত্রী তোলার জন্যে অল্প সময়ের জন্যে থামা বাসে ওঠার জন্যে হাতড়ে হ্যান্ডেল খুঁজছেন । হেলপার একটু দয়াপরবশ হয়ে বাসে তুলে দিলে উঠতে পারেন, নয়তো প্রায়শই পারেন না । আজ কেউ-ই তার থেকে কিছু কিনছে না। গজল গাইতে গাইতে তার গলা একটু বসে যায় যেন, একপর্যায়ে গাওয়া থামিয়ে দিয়ে ক্ষোভ আর অভিমান মেশানো গলায় তিনি বলেই ফেলেন - ' ভিক্ষা চাইলে সবাই ঠিকই দশ টাকা-পাঁচ টাকা করে দিতো '।

জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো আমার এক শিশি আতরের মালিক হওয়ার সাধ জাগে । প্রথমটা পেয়েছিলাম চাকরির কর্মসূত্রে উপহার হিসেবে । এখনও পরে আছে নিয়ে আসার দিন যেমন ছিলো, তেমন অবস্থাতেই । এটাও হয়তো পরে থাকবে । তিনি এসে জানতে চান কোন সুগন্ধের আতর চাই? জানাই যেটার ঘ্রাণ বেশি ভালো সেটাই । তিনি ব্যাগ হাতড়ে একের পর এক আতরের শিশি বের করেন আর আমার হাতের উপর একটু করে ঘষে দেন । ল্যাভেন্ডার, বেলী, চকলেট (!), রজনীগন্ধা যৌথ সুবাসে সুবাসিত হয়ে উঠে আমার হাতে, নাকের কাছে এনে শুঁকতে যাওয়ার পর সে তীব্র, ঝাঁঝালো ঘ্রাণ ধক করে একদম মগজ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে সাথে সাথে মাথা ধরিয়ে দেয় ।

আকাশে মেঘ ঘন হয়ে আসে । দু'জনের-ই শার্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় ঝিমিয়ে গেছে বাইরের সিএনজি চালকদের মারামারির উত্তাপ । সামনের সিটের যুগলেরা ঘনিষ্ট হয়ে বসলো আরও একটু । ক্ষীণ দৃষ্টির চোখের খুব কাছে এনে নোট চিনতে চিনতে হিসাব মিলিয়ে চলেন হকার সাহেব, যার নাম-পরিচয় আমাদের সবার কাছে 'হুজুর' ভিন্ন আর কিছু নয় । কোলে শঙ্খের মতো সাদা প্রচ্ছদের বইটা ছড়ায় বিষন্ন শীতল দীর্ঘশ্বাস... এসবের মাঝে আমার হাত থেকে বের হয়ে চলে অদ্ভুত এক সুবাস ।

মার্কেজ, সালভাদর দালির বলে যাওয়া সুররিয়ালিজম কি এমন-ই কিছু?

... আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে ।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×