somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহামারীর সময়ে ভালবাসা (love in time of pandemic)

০৬ ই মে, ২০২০ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরনের শাড়িতে বড় বড় যে কয়েকটা ফুলের ছাপা ছিল আজ তার আরো একটা পাপড়ি ছিড়ে গেল,পাতা দুখান তো গত মাসেই নাই হয়ে গেছে। তিলে পড়া ব্লাউজের উপর সেটাই অতি যত্নে পেচিয়ে স্বামীর সামনে গিয়ে বসেছে ফুল্লরা। ফুল্লরার চুল গুলো কেমন যেন পাটের দড়ির মত গিট লেগে গিয়েছে, হাটুর নীচের চামড়াটুকুও মফস্বলের পিচের রাস্তার মত শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। শেষ কবে স্নান হয়েছে মনে পড়ে না।

রেলের পাশেই এক পরিত্যক্ত বগিতে কানাই আর ফুল্লরার সংসার। ভোররাতে ফুল্লরা যেই পাপর-সিঙ্গারা ভেজে দিত জোহরের আযান দেওয়া পর্যন্ত সেগুলো ট্রেনে ফেরী করে বিক্রি করতো কানাই। ফেরার সময় বালতিতে করে দুই বালতি রেলের জল যা নিয়ে আসতো তা দিয়েই ধোয়া-মোছা, গোসল চলতো ওদের। কিন্তু গত ছ-মাস দেশে মহামারী লেগেছে ট্রেন থেকে শুরু করে দোকান-পাট, কারখানা সবই বন্ধ।

প্রথম প্রথম সরকারের লোক, ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেগুলো এমনকি শহরের কিছু বড়লোকরা এসে মাঝে মাঝে চাল ডাল তেল দিয়ে যেত। কিন্তু প্রায় মাস দুয়েক হতে চলেছে তাদের কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না। শুরুর দিকে যা পেয়েছিল তাই দিয়েই একবেলা খেয়ে আর একবেলা জল খেয়ে দিন যায় ওদের। দিনে দু'ঘন্টা রাস্তার পাশের সরকারি কলে যে জল আসে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে একরকম যুদ্ধ করেই সেখান থেকে এক বালতি মত জল আনা যায়, তা দিয়েই রান্না, ধোয়া-মোছা করে রাতে দুজনে দু-গ্লাস খেয়ে শুয়ে পড়ে। খানিকটা জল খরচ করে গা ধোয়া সেখানে বিলাসিতা।

মাথার বালিশ দুটো একদম চুপসে গেছে, তাই নিজের বালিশটা কানাইকে দিয়ে কানাইয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো ফুল্লরা। কয়েকমাস যাবত স্নান না করায় বিকট দুর্গন্ধ বের হচ্ছে কানাইয়ের গা থেকে, তাই শাড়ি আচল দিয়ে নাকটা ঢেকে সেভাবেই পড়ে রইলো কানাইয়ার বুকে। কানাই ওর মাথায় চুলে বুলিয়ে দিতে গিয়ে দেখলো তার হাত সড়ছে না চুলগুলো আঠা হয়ে জট লেগে গেছে, তাই দু'হাতে ফুল্লরাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল দুজনে।

গতরাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি ফুল্লরার তাই সকাল থেকে মরা ঘুম ঘুমোচ্ছে, ওদিকে সরকারি জলের টাইম শেষ হতে চলেছে। বালতি হাতে দাত ঘষতে ঘষতে আজ নিজেই দৌড়োলো কানাই। ঠেলেগুতিয়ে কলের সামনে যখন পৌছালো তখন এক নারী টিনের কলসিতে জল নিচ্ছিল। ফুল্লরার মতনই ছেড়া একখান শাড়ি পড়া, ব্লাউজটাও পিঠের দিকে খানিকাটা ছিড়ে গেছে। কলসি ভরার পর যখন ছেড়া শাড়ির আচলটা কোমড়ে গুজে নীচু হলো, ব্লাউজের ফাঁকা দিয়ে তার স্তনের বেশখানিকটা বেরিয়ে এল।

জল নিয়ে বাড়ি ফিরে কানাই দেখলো এক হাতে মাথা রেখে পাশ ফিরে অই ময়লা বিছানাতেই বড় শান্তিতে ঘুমোচ্ছে এখনো ফুল্লরা, জলের বালতিটা রেখেই বউয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো কানাই। শুয়েই ফুল্লরার পিঠের থেকে চুলগুলো সরিয়ে খামচাতে শুরু করে দিল। ব্যাথায় হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল ফুল্লরার, কিন্তু কয়েক মাস পর স্বামীর অমন হাতের স্পর্শ তার শরীরে যে তৃপ্তির স্বাদ জাগালো তার কাছে সে ব্যাথার যন্ত্রণা কিছুই মনে হচ্ছে না তার, চোখদুটো আবার বন্ধ করে তাই কানাইয়ের নখের খোঁচা অনুভব করতে থাকলো। ফুল্লরা কে চিত করে নিয়ে তার গায়ের উপর উঠে বসলো কানাই, শিকারী বাঘের মত ব্লাউজের বোতামগুলো একটানে ছিড়ে ফেলে স্তনের বোটায় একটা কামড় দিতেই, ফুল্লরার গায়ে জমে যাওয়া ময়লা আর দুর্গন্ধে আর পাশ ফিরে বমিই করে দিল সে।

কানাইয়ের অবস্থা দেখে আর নিজের অবস্থা ভেবে চোখে জল চলে আসলো ফুল্লরার, বেচে থাকাটাই যেখানে একটা সংগ্রাম যৌনতা সেখানে বিলাসিতা-ই। অথচ বয়স তাদের কারোই ত্রিশ পার হয়নি। বিছানা ছেড়ে উঠে চুলো ধরালো সে, খেয়ে তো বাচতে হবে। হাড়ির চাল টুকুতে দুজনের এ বেলা চলে যাবে, রাতটা না হয় জল খেয়েই কাটিয়ে দিবে কিন্তু কাল কি খাবে? তাই অর্ধেকটা চাল নিয়ে বাকিটা কালকের জন্য রেখে দিল সে। আজ রাতে দুজন দুদিকে ফিরে ঘুমালো, ফুল্লরা অভিমানে আর কানাই লজ্জায়।

পরদিন রাতে একাই শুয়ে আছে ফুল্লরা,গতকাল আর আজ দুজনেই একবেলা করে আধপেটা খেয়ে আছে। খিদায় ঘুম আসছে না তাই দরজার মুখে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছে কানাই। ফুল্লুরাও পাশে এসে বসলো কিন্তু কাছে গেল না। কানাই ওকে কাছে ডেকে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিল, তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে একে অপরের পিঠে বুজে অঝোরে কাদতে লাগলো। দুজনেরই বুকটা ফেটে যাচ্ছে, চোখ দুটো ঝরেই যাচ্ছে কিন্তু কারো মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সেখানেই একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল হয়েছে, আজ ঘরে আর কোন খাবার নেই, কানাই তাই খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে। সে গরীব কিন্তু কখনো ভিক্ষা করে খায় নি, কিন্তু আজ ভিক্ষার জন্য যে দিকেই যায় দরজা বন্ধ, এই ছোয়াচে মহামারী রোগের ভয়ে কেউ এখন আর বাইরে বেরই হয় না, কারো কাছে সাহায্য চাইতে গেলে নোংরা কানাইকে কেউ বাড়ির সীমানাতেই পা রাখতে দেয় না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত কানাইয়ের প্রচন্ড জল পিপাসা পাইয়াছে, কিন্তু একটু জলও কেউ দেয় না।

হাটতে এক মসজিদের সামনে এসে দাড়িয়েছে কানাই, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে এটা সৃষ্টিকর্তার ঘর, তাই এখান থেকে একটু জল অন্তত পাবে। কিন্তু না বিধাতাও আজ তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে ছিটকানি দিয়েছেন। মসজিদের পিছনেই গোরস্থান, সেখানে কয়েকজন লোক জটলা পাকিয়ে কি যেন আলোচনা করছিল। কানাই কাছে গিয়ে দেখলো মহামারীতে মারা যাওয়া এক শিশুর লাশ, সবাই বলছে ধর্মমতে তার দাফন করাতে, কিন্তু শিশুটাকে গোসল করাতে কেউ এগিয়ে আসে না, কারন রোগটা ছোয়াচে। পাশেই গোরস্তানের কল যেখানে লাশের শেষ গোসল করানো হয়, সেটা চোখে পড়তে কাউকে কিছু না বলেই কানাই কল চেপে আগে খানিকটা জল খেয়ে নিল। তারপর লোকেদের ডেকে পর্দা, সাবান, বালতির আর যা যা লাগে ব্যাবস্থা করতে বললো, সে করাবে গোসল। কিন্তু একটাই শর্ত গোসলের পর সেগুলো তারা ফেরত নিতে পারবে না। তাকে দেখে প্রথমে কেউ রাজি হলো না, কিন্তু যে রোগীর ধারে কাছেও কেউ যেতে চায়না, সেখানে সেই রোগীর লাশ ছোয়া আর ধরে গোসল করানো আত্নহত্যার সামিল এমনকি বাচ্চাটার বাবাও আজ সন্তানের লাশে হাত দিতে নারাজ, তাই আর কোন উপায় না পেয়ে তারা সব এনে দিল। এছাড়া ব্যাবহারের পর এমনিতেও জিনিসগুলো কেউ আর কখনো ছুয়ে দেখতো না। কানাই তখন নিজ হাতে সেই বাচ্চাটাকে গোসল করিয়ে জানাজার জন্য তৈরি করে দিয়ে নিজেও গোসল করে নিল। কয়েকমাস পর গোসল করতে গিয়ে সাবানটার অর্ধেক ফুরিয়ে ফেললো। তারপর সেই বালতিতে একবালতি জল নিয়ে, সাবান আর পর্দা টুকু সাথে করে ঘরের উদ্দেশ্য রওনা দিল।

না খেয়ে বসে আছে ফুল্লরা, কানাইকে দেখে প্রথমে খুশি হলেও পরে দেখতে পেল তার হাতে কোন খাবার নেই। সাবানের টুকরো আর পর্দাটা ফুল্লরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো স্নান করে আসতে। জিনিস গুলো দেখে ফুল্লরা আন্দাজ করতে পারলো কোথাথেকে কিভাবে কানাই সেগুলো এনেছে, এগুলো তে হাত লাগানো আর মৃত্যুকে গায়ে জড়ানো একই কথা। তাই সেগুলো বাগানে ফেলে দিতে গেল সে, কিন্তু তখন তার মনে হলো এমনিতেও এভাবে তারা আর ক'দিন ই বা বাঁচবে? আর মরার পরেও তো তাদের কেউ গোসল করাবে না, এর থেকে মরার আগে শেষবারের মত স্নানটা সেরে নিলে ক্ষতি কি? তাছাড়া শেষ কবে কানাই তাকে আদর করেছে সেটাও মনে নেই, সেদিন তো গায়ের গন্ধে বমিই করে দিল।৷ ফুলসজ্জার রাতের মত আরেকটা বার ভালোবাসার মানুষটার আদর পেতে পেতে তার বুকের উপর চিরদিনের মত ঘুমিয়ে যাবার যে সুযোগ এসেছে সেটাই বা কয়জন পায়!

সবটুকু সাবান খরচ করে ফুল্লরা স্নান সেরে পর্দাটা গায়ে জড়িয়ে আজ আবার কানাইয়ের সামনে বসেছে। এসে দেখে রিলিফে যে তেল তারা পেয়েছিল, কানাই তার সবগুলো খালি বোতল নিজের হাতে উবুর করতে লেগেছে। সবকটা বোতল ঝাকিয়ে যে কয়েক ফোটা তেল সে পেল তা নিয়ে ফুল্লরার চুলে মাখিয়ে দিয়ে বললো "আর কোন দিন তোর চুলে অমন জট বাধতে দিব না"। লাশটাকে আতর মাখানোর সময় বোতলে করে খানিকটা সে লুঙ্গির কাছায় লুকিয়ে রেখেছিল। চুলে তেল মাখানোর পর সেই আতরের বোতলটা বের করে ফুল্লরার সারা শরীরে মাখিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকলো কানাই।

দিন কয়েকপর সেই আতরের গন্ধ যেন কোথায় হারিয়ে গেল আজ সেই পরিত্যাক্ত বগিটি থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে.....!!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২০ রাত ১২:৪৮
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×