somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি নিজের অজান্তেই আব্বার ছায়াকে স্পর্শ করে বেঁচে থাকি প্রতিদিন

১৫ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার প্রথম বাবা বাবা অনুভূতি আমার বোনের বাচ্চা Niloy হবার পর। অনেকদিন আগের কথা ১০-১২ বছর হবে। নিলয় মাত্র হয়েছে। আব্বা-আম্মা-বোন রাতের খাবার খাচ্ছে, নিলয় আমার কাছে। ওর গালে হাত বোলাতে খুব মজা, মোম মোম একটা অনুভূতি। মজা লাগে। আব্বার সাথে তখন সম্পর্ক খুব খারাপ। আব্বা বলল, "তোমাকেও আমরা এমন আদর করেই বড় করছি, আশা করি এখন বুঝতে পারো।"

নিলয় বড় হতে থাকে। ওর একটা সমস্যা ছিল ছোটকালে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। আম্মা-বোন সামলাতে পারতো না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, ক্লাসে যাই না, ২টা পর্যন্ত ঘুমাই। নিলয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হলেই আম্মা-বোন ছুটে ছুটে আমার রুমে আসে, আমি ওকে কোলে নিয়ে সামলাই, নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে, ওকে মা-বোনের কাছে ফিরিয়ে দেই। আমার বাবা বাবা হবার অনুভূতি প্রগাঢ় হয়।

২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দোতলায় ওটি'র সামনে আব্বা আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। মুনমুনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়েছে। ১১.৩০ এর দিকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন মেয়ে হইসে, সুস্থ হইসে, সুন্দর হইসে। আমি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। আব্বা হঠাত আমাকে ডেকে নিল। বলল মুনমুনের কাছে যাও। আমি যেয়ে দেখি আমার বউ কি যেন খুঁজছে দরজা দিয়ে, আমাকেই হয়ত। তার কিছুক্ষণ পর নার্স মেয়েকে আমার কোলে দেয়। কেমন একটা ছোট্ট পোটলা, কি যেন ভীষণ আদর, আমার সেই পরিপূর্ণভাবে বাবা হওয়া।

আমার আব্বার সাথে আমার ছোটকালের কিছু মধুর স্মৃতি আছে। আম্মা নানা বাড়িতে গেলে আমি আব্বার কাছে থাকি। আব্বা-আম্মা ঝগড়া করে দুই রুমে থাকলেও আমি আব্বার সাথে থাকি। আব্বা তাড়াতাড়ি ঘুমায়। ঘুমের মধ্যে গায়ে-শরীরে হাত বুলিয়ে দেয় আর আমার একটা পা তার কোমরের ওপর তুলে দেয়। এই স্মৃতিটা কখনও আমি ভুলব না। আমিও এখন রাতে ঘুমানোর সময় মেয়ের মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেই। মেয়ের একটা পা আমার গায়ের ওপর তুলে দেই। মেয়ে বিরক্ত হয়ে সরিয়ে ফেলে, কিন্ত আমার ভাল লাগে, চোখে পানি আসে।

আমার আব্বার সাথে অমন ২/১টা মধুর স্মৃতি ছাড়া আমার সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। সৎ মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দিনের বেশিরভাগ সময়ই আব্বা অফিসের কাজে দিতেন, আমাদের দিতেন বকা-ঝকা পড়ালেখা না করবার জন্য কিংবা দুষ্টামি করবার জন্য। আব্বার সাথে আমার সম্পর্কের শীতলতা ঘোচে আমার মেয়ে হবার পর। আমার আব্বা আর মেয়ে লেপ্টালেপ্টি থাকে। আমরা বউ-জামাই অফিসে থাকি - আব্বা, আম্মাই ওর আদর-যত্ন করে। আমরা অফিস থেকে ফিরলেও মেয়ে আব্বা-আম্মার কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমার মেয়ের বেশ কিছুদিন আগে হঠাত পেটে ব্যথা হলো। আব্বা আম্মা ওই সময়ে ফেনী গেছে। আমার চিরস্থায়ী ডাক্তার Robin কে খবর দিলাম - ও বলল এপেন্ডিসাইটিস, কেটে ফেলে দিতে হবে, আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। আমার চাইতে ঘাবড়ে গেল আমার আব্বা। রবিন ঈদের ছুটির ভেতরও ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দিল। ডাক্তারও বললো অপারেট করতে। আমি মুখে কিছু বলিনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভরসা পাইনা। আমার আব্বা ছাড়া আমি এত বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নেই। আমার পক্ষে আত্মজা ভেঙে আব্বাকে বলা সম্ভব না তুমি ফেনী থেকে চলে আসো। কিন্তু আমি কি বলব। আমার আব্বা সবকিছু ফেলে ঢাকা চলে আসলেন। আব্বা ঢাকায় পা দেবার সাথে সাথে আমার মনে হলো আর কোথাও কোন সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে।

তারও বেশ কিছুদিন আগের কথা। বৃহস্পতিবারের রাত। বন্ধু Syeed ভাইকে নিয়ে বেরিয়েছি নারায়ণগঞ্জের দিকে ড্রাইভে যাব। নিকেতন থেকে বেরিয়ে পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়েছি, অক্টেন নিচ্ছি, বউয়ের ফোন। আব্বা নাকি কেমন কেমন করতেসে, আমি যাতে চলে আসি। আমি চোখের পলকে গাড়ী নিয়ে আসায় দেখি আব্বার অবস্থা ভাল না। আব্বা অচেতন প্রায়। তিনজন মানুষ মিলে কোনরকমে আব্বাকে গাড়িতে তুললাম। আমার সাথে বউ-বাচ্চা আর পেছনে আব্বাকে দু'দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে আম্মা আর সায়ীদ ভাই। আমরা সবসময় এপোলো'তে যাই কিন্তু ওই অবস্থায় আমার মাথা কাজ করতেসেনা, ইউনাইটেড কাছে - কই যাই কই যাই! Tareq ভাইকে ফোন দিলাম, উনি ঠান্ডা মাথায় বললেন, "এপোলোতে নেন, ওদের emergency ভাল।" এপোলোতে নেবার কিছুক্ষণ পর আব্বার জ্ঞান ফিরল, তার কিছুই মনে নেই। ডাক্তাররা অনেক কিছু টেস্ট করে বললেন, Transient Ischemia হয়েছে, তবে এখন ভয়ের কিছু নেই। আমি বাইরে এসে একা একা কাঁদলাম। আমি এই লেখাটা লিখবার সময়ও কাঁদছি। আমার বাবা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিগত কারণে আমি সহসা কখনও কেঁদেছি বলে আমার মনে পড়েনা। আমার বাবাকে নিয়ে তার ৬ মাস পর আমাকে আবারও ভোর ৩টায় এপোলোতে নিতে হয়েছে এবং আবারও কাঁদতে হয়েছে।

আজকাল সারাক্ষণ আব্বাকে নিয়ে টেনশনে থাকি। দেশের বাইরে যেতে চাইনা এমনকি ঢাকার বাইরেও যেতে ইচ্ছা করেনা আব্বার শরীরের কথা চিন্তা করে। আব্বা আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে নাই এই একটা আতংক ছাড়া আমার জীবনে আর কোন আতংক নাই। আব্বা আমার পাশে আছে সবসময় এর চাইতে বেশি ভরসার জায়গায়ও আমার জীবনে আর নাই।

আমার বাসায় মানুষদের সাথে তেমন কথা হয়না। আব্বার সাথেনিজের অজান্তেই আব্বার ছায়াকে স্পর্শ করে বেঁচে থাকি ও না। কিন্তু এই যে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, একজনের ছায়া দিয়ে আরেকজনকে স্পর্শ করা - এর বেশি কিছু আমি চাই না।

আব্বার মতন মানুষ আমি হতে পারিনাই বলে আমার কোন দুঃখ নাই, আমি যে প্রতিদিন এটাই আমার জীবনের সবকিছু।

শামীম আহমেদ
চট্রগ্রাম
১৫ জুন ২০১৪

https://www.facebook.com/shamimahmedjitu
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×