"মা,আক্কু মামা তো দুবাই চলে গেল।"
"আক্কু মামা টা কে?"
"ওহহো,সরি,হাসান।"
"তো হাসান বল,আক্কু মামা বললে কেমনে চিনব?"
"কি করব,অভ্যাস হয়ে গেছে তো,ঐ ব্যাটা নিজেও মনে হয় ওর আসল নাম ভুলে গেছে।"
এটাই ব্যাপার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। কোন এক দৈব দুর্বিপাকে কোন এক বেচারার ঘাড়ে একটা নাম চাপিয়ে দেয়া হল,বাকি জীবন ঐ নাম সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে থাকবে,কখনো কখনো বন্ধুমহল ঐ ভূতো নামটাই চেনে,আসল নামটা হারিয়েই যায়। নইলে এত সুন্দর হাসান নামটা কেন "আক্কু মামা" নামের আড়ালে হারিয়ে গেল,আর কবেই বা হারালো,সেটা স্বয়ং আক্কুও বলতে পারবে না।
তো হয়ে আসছে এরকম,হচ্ছে,আর হবেও। অল্প বয়সে দাঁড়ি উঠে গিয়েছিল বলে এক বন্ধুর নাম দিয়েছিলাম দাঁড়িয়াল ভাই,সেই নাম বাকি স্কুল জীবনেও আর তার পিছু ছাড়ল না। ছোটখাট শান্ত হাসিখুশি স্বভাবের রনির নাম হয়ে গিয়েছিল সুইটি,এখনো হাজারো রনির মাঝে চিহ্ণিত করতে সুইটি নামটাই যথেষ্ট। চশমাওয়ালা শাওনের নিকনেম কানা,কতজনই তো চশমা পরে কিন্তু এই বেচারার কানা নামটা আর ঘুচলো না। মাঝে মাঝে ২-১ জন ভাগ্যক্রমে ভাল নাম পেয়ে যেত,তখন
হৃত্বিক রোশানের ক্রেজ চলছে,সুন্দর চেহারার হামজা পেয়ে গেল হৃত্বিক নামটা,তার ভাব আর দেখে কে! তবে বেশিরভাগেরই কপাল এত ভাল
না,শিক্ষকদের তো না-ই। বেতের বাড়ির শোধ নেবার জন্যই কিনা,মনের সব বিদ্বেষের মাধুরী মিশিয়েই নামগুলি দেয়া হত। আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র অথচ 'জেমস'কে চেনে না,হতেই পারে না। না,গায়ক জেমস না,ইসলামিয়াতের শিক্ষক জেমস,লম্বা দাড়িওয়ালা দুমদাম কিলানেওয়ালা জামশেদ স্যারকে দেখলেই বুঝা যেত জেমস নামটা কত বড় আয়রনি
কলেজের শিক্ষকরাও এই নামের আগ্রাসন থেকে ছাড় পাননি। ফাদার বকুলকে বকুলাপ্পু,ফাদার বেনজামিন কে বেনজু,আর জহরলাল স্যার হলেন 'লালী',তখন আবার মীনা কার্টুনে 'লালী' নামের একটা গরু বেশ হিট করেছে
রেখেছিল,তবে এই নিয়ে বিশেষ আগাতেন না,কে জানে প্রতিবাদ করলে আবারো কি ভয়ংকর নাম আসে! সবাই এতটা সহনশীল না,কাজেই স্ট্যানলি ফিউজ যেদিন ক্লাসে ঢুকে দেখলো যে বোর্ডে ১টা বড়সড় বাল্ব এঁকে সেটাকে কেটে দিয়ে নিচে লেখা 'ফিউজ',সোজা বকুলাপ্পুকে ডেকে আনলো,কাজের কাজ যা হল,ফিউজ নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল।
ভার্সিটিতে এসে নামের আরো বৈচিত্র্য দেখলাম,বাহারের সাথে ভয়ংকরত্বেও এগিয়ে। কেমিস্ট্রির এক স্যারের নাকি ৪টা বউ(শোনা কথা অবশ্য),সবাই ডাকে লুইস,একি নামের আরো কয়েকজন শিক্ষক আছেন,কাজেই আলাদা করতে টাইটেলটা লাগে। অনবরত ঘামেন বলে এক স্যারের নাম ছিল ঘামা,সেই নাম বিবর্তিত হয়ে এখন হয়ে গেছে 'গামা'। 'পাগলা' বললেই সিভিল ডিপার্টমেন্টের অনেক ছাত্রই একজন মাত্র শিক্ষককেই বুঝে থাকে,একিভাবে চরম বদমেজাজী এক শিক্ষকের 'বিডিআর' নামটা এতই জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে যে এখন অনেকে তাঁর সত্যি নামটাই জানে না।'বদু' নামটাও জনৈক শিক্ষকের ভয়াবহ প্রশ্নের ফল,আসল নামটা বললাম না,ভুক্তভোগীরা বুঝে নেবে। 'কোপা শামসু' কে কেউ না চিনে পারেই না,আর সেদিনই ১টা চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম এক শিক্ষকের প্রশ্নে,ফ্লুইড মেকানিক্স কে পড়িয়েছিলেন তার জবাবে আমার খালি মাথায় ঘুরছে ক্লাস নিতেন 'নানা',কিন্তু সেটা কি আর বলা যায়?
বৈচিত্র্য বন্ধুমহলের নামেও আছে,ফার্স্ট বয় আদনান যেমন আজীবনের জন্যই 'আদু ভাই' নামটা জুটিয়ে নিয়েছে,আর চরম পড়ুয়া স্বপনের নামের সাথে লেগে গেছে 'রোবট' টাইটেল। একি ক্লাসে ২টা সনেট থাকায় একজন হয়ে গেল 'গুরু সনেট',আর মোটাসোটাটা হয়ে গেল 'তবলা সনেট।' তাবলীগি রিয়ালের নাম ছিল 'ডিসকো মোল্লা',আজকাল দাড়ি কামিয়ে সেই নামটাই সার্থক করছে সে। ৬ ফুট লম্বা মাহফুজকে আমরা এখন 'টম' বলেই ডাকি,উৎপল তার আসল নামের বদলে 'নূরা পাগলা' নামেই বেশি পরিচিত। তিন-তিনটা রাসেলকে আলাদা করতেও টাইটেল লাগে,কোই বাত নেহি,এক রাসেল হয়ে গেল 'গবু',একজন কান্দু মিয়া,আরেকজনের চুল পাকা বলে সে হয়ে গেল 'বিপি' (এটার পুরাটা বললাম না,বুদ্ধিমানেরা অনুমান করে নিন)।এক বন্ধুর ডাক নাম 'দুলা মিয়া',কারণ সবার আগে তার প্রেম হয়েছিল, এরপর তো কতজন প্রেম করে বিয়েও করে ফেলল কিন্তু সে আজীবন 'দুলা'-ই রয়ে গেল। চুল কম মাথায় একজনের,নাম হয়ে গেল টাক্কু,অচিরেই নামটা সার্থক হবে,এমন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি আজকাল। মেকানিক্যালের 'পৈতা'র আসল নামটাই জেনেছি শেষ বছরে এসে,আর মুহাহাহা হাসিতে ক্যাফে কাঁপানো 'পশু'-র আসল নাম কি,সেটা মনে হয় বন্ধুবান্ধবরাও মনে করতে বেশ সময়ই নেবে। ক্যাফেতে ক্রিকেট খেলার সময় প্রতিপক্ষ ডিপার্টমেন্টের চর্বিওয়ালা এক ছেলের নাম দেয়া হল 'দুলদুল',শুনতে পাচ্ছি নিজের ডিপার্টমেন্টেও তার দুলদুল নাম স্থায়ী হয়ে গেছে। ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে করা শৌখিন ফিল্মে এক জুনিয়রকে পর্দায় দেখে এক বন্ধু অডিটরিয়াম ভরা দর্শকের সামনে চিৎকার করে উঠল--"মালিকায়ে হামিরাহ্",আর যায় কোথায়,নামটা তৎক্ষণাৎ টপচার্টে উঠে গেল,নামের মালকিন যদিও তাতে বিশেষ আনন্দ পায়নি।
এখন মাঝে মাঝেই ভাবি,আহা কি সব দিন গেছে! নামগুলো কত আনন্দের সাক্ষী,কত দিনের স্মৃতি,কে বলে নামের কোন দাম নেই? আবার যখন অনেক বছর পরে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে,এরকম অদ্ভুত ডাকনাম দিয়েই কি ডাকবো? কেন জানি মনে হয়,ডাকবো,আর ডাকলে,সাড়া না দিয়ে যাবে কোথায়। হয়তো রাস্তায়,ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে এক মুহূর্তের জন্য কেউ ডেকে উঠবে,এই ব্যাং,কই যাস? এখনকার মতই দাঁতগুলো বের করে বলবো,কাজ আছে মামা,ক্যাফেতে বস,এখনি আইতাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০০৮ রাত ২:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




