somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লেখকের মুক্তি

০১ লা মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখক কি ভেবে লেখে বা কেন লেখে, সেটা নিয়ে লাখ লাখ মতবাদ আছে, নিজেরটা নিয়ে একটু প্যাঁচাই। যে কারণে মানুষ কথা বলে, সে কারণেই লেখে, নিজেকে প্রকাশের জন্য, নিজের ভাব আর ভাবনাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, যা আমার ভেতরে বদ্ধ হয়ে আছে, তার মুক্তির জন্য। মনের ভাবনা যেমন হদয়ের অর্গল ভেঙে কথার ডানায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ে, মস্তিষ্কের চিন্তাও লেখার পাখায় ভর দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি খোঁজে। আর জেল পালানো কয়েদী একা পালায় না, সাথে সঙ্গীসাথী নিয়ে যায়, কাজেই ভাবনাগুলো লেখা হয়ে অন্যের মস্তিষ্কে গুঁতোগুতি করতে থাকে তালা ভাঙবার জন্য, আর এভাবে লক্ষ ভাবনা একত্র হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বাঁধ ভেঙে দেবে, সেই আশাতেই লেখা। সবাই পারে তা নয়, গুটিকয় ভাগ্যবান অতদূর যেতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য সবার একই।

কিন্তু দক্ষিন মেরুবিন্দু ধরতে পারলেই অভিযানে যাবো আর নয়তো যাবো না সেটা হয় না, ম্যালরি নয়তো এভারেস্টের পথে দৌড়াতেন না, আর মেরুবিন্দু ধরতে গিয়ে স্কটের মত হারিয়েও যায় অনেকে, কিন্তু অজানাকে জানার জন্য তাই বলে অভিযান থেমে নেই আর নিজের ভেতরটাকে আবিষ্কার করার জন্য লেখার আঁকুপাকুটাও তাই থেমে থাকে না। লেখালেখি করতে গিয়ে কতজনের কত সর্বস্ব হারিয়ে গেছে আর উজ্জ্বল ভবিষ্যত কৃষ্ণগহ্বরে ডুব মেরেছে সেই হিসাব রাখা সম্ভব নয়; আমাদের অর্থনৈতিক বিচারে বা টিকে থাকার বিচারে সফল লেখক--যদিও সফলতার মাপকাঠি সেটাকে বলতে আপত্তি আছে, সে কথায় পরে আসি--যদি ১ জন হন তো সে হিসাবে ব্যর্থ লেখক ৯৯৯ জন-ই হবেন, সংখ্যাটা নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে গুণে দেখতে পারেন, আমারটা আমি বলে দিলাম নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পৃথিবীর কেন্দ্র খোঁজার মত।

কাজেই, লিখে যেতে হবে, যদি লিখতে ইচ্ছা করে, বা অন্তত ভাবনাটা প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে। আর লিখতে হবে কারো তোয়াক্কা না করেই, হাজার জনের হাজার মতামত থাকতে পারে আপনার লেখার ব্যাপারে আর সেই অধিকার তাদের আছে, লেখার আর পড়ার আর ভাবনার রাজত্বটাই একটা মহা অরাজকতা, এখানে সবাই রাজা এবং চেঙ্গিস খানের মতই ডাকাতে রাজা, পছন্দ না হলেই ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করাটাই দস্তুর, এবং সেজন্য লিখতেও হবে স্বাধীন পাঠানের মত, সদর রাস্তার মাঝাখান দিয়ে এবং পুলিশ-সেপাইয়ের ভয় না খেয়ে। কিভাবে লিখতে হবে সেটা শামসুর রাহমান থেকে ধার করা যায়, মানে ধার করা বা নকল করাটাও লেখকের স্বাধীনতা, যদি সামর্থ্য না থাকে অথচ ইচ্ছা থাকে ষোল আনা। তো শামসুর রাহমান যেমন বলেছেন--"স্বাধীনতা তুমি যেমন ইচ্ছে লেখবার আমার কবিতার খাতা",
কাজেই স্বাধীনতা কোন স্বেচ্ছাচারী কবিতার খাতা নাকি কবিতার খাতাই স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতা সেটা আমরা মিশিয়ে ফেলতে পারি, আর সেটা মেশানোই হলো লেখালেখি।

তো, অখাদ্য লেখা হলে কি হবে? প্রথমত, কোন লেখক--মানে এক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি যে কলম বা কীবোর্ড নিয়ে নিজের মত করে কিছু ভাবতে চায় সে-ই লেখক--নিজের লেখাকে অখাদ্য মনে করে না, কাজেই "অখাদ্য লেখা" কথাটাই লেখকের কাছে অচল। পুরো ব্যাপারটাই আপেক্ষিক, এবং যে পড়ছে তার ব্যাপার, নাহলে বটতলার বই বা চটি বই বিক্রি হতো না। বিশ্বজনীন কিছু সত্য যে নেই তা নয়, তবে শেষমেশ আমরা বটতলার বই লিখতেও বাধা দিতে পারি না, মানুষের হাত-পা, এমনকি কলমকে শেকলে বাঁধা গেলেও মনকে বাঁধা যায় না আর সেজন্য দেখা যায় জেলখানা আর পাতালঘরে বন্দী মানুষও পাথরের দেয়ালে ইটের টুকরো দিয়ে মনের ক্ষেদ আর কষ্টকে তুলে ফেলে, আর নেহাৎ ইট-পাথরের টুকরো না জুটলে নিজের গায়ের রক্ত দিয়েই দেয়ালে লিখে গেছে কোন বন্দী, এমন ঘটনাও বিরল নয়।

খাদ্য-অখাদ্য লেখা থেকেই চলে আসে সফল আর ব্যর্থ লেখকের কথা। জনপ্রিয় অথবা সমালোচক-নন্দিত অনেক লেখককেই বলতে শুনি যে একজন সফল লেখকের পেছনে হারিয়ে যায় ১০০ ব্যর্থ লেখক, আর এভাবেই তারা লেখকের সফলতা আর ব্যর্থতাকে সীমাবদ্ধ করে দেন জনপ্রিয়তা অথবা সমালোচকের কৃপা পাবার বৃত্তে। সেজন্যই মনে হয় তরুণ লেখকরা নামকরা সাহিত্যিক বা সম্পাদক বা প্রকাশকের কৃপা লাভের জন্য তাদের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন, অথবা সমালোচকের প্রশংসাবাক্য শোনার জন্য অহেতুক জটিলতায় ফেলে দেন লেখার নিজস্বতাকে, আর হালে দেখা যায় জনপ্রিয়তা পাবার জন্য নিজের লেখার নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন সর্বত্র আর সর্বদা, সামাজিক মাধ্যমগুলো তো আছেই, একটু বইপাড়া বা পত্রিকাপাড়ায় কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে কাউকে দিয়ে নিজের বই সম্পর্কে দুই-এক কলম লিখিয়ে নেয়াটাও বেশ চলে। বেশ, সাহিত্যের সাফল্য বা ব্যর্থতা থাকতে পারে, সেটার মাপকাঠিও আসলে প্রশ্নববিদ্ধ, কারণ জনপ্রিয়তা বা সমালোচকের কৃপা কোন বিচারেই জীবনানন্দ অতটা সফল ছিলেন না যতটা সফল আজকে আমরা তাঁকে বলি, কালে কালে সেই মাপকাঠি বদলে গেছে। আর লেখকের ব্যর্থতা বা সফলতাকে তো সেভাবে দেখা যাবে-ই না। একটা লেখা সাহিত্য হয়ে ওঠার জন্য কিছু মানদণ্ড থাকতে পারে, কিন্তু যে মানুষটা নিজের আলস্য আর দ্বিধা ভেঙে ভাবনাগুলোকে প্রকাশের জন্য কলম হাতে তুলে নিয়েছে আর সেগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছে নিজের মনের মত, সে-ই লেখক, সে সফল লেখক। ব্যর্থ লেখক তো সে যার কিনা কলম বারবার থেমে যায় "পাছে লোকে কিছু বলে" ভেবে, আর নিজের সন্তুষ্টির বদলে অন্যের সন্তুষ্টির জন্য লিখে যায়। মুক্তির জন্য যে লেখালেখি, সেই লেখা তখন অন্যের ভ্রুকুটির শেকলে
আটকে যায়, লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য তাহলে থাকলো কোথায়?

তাহলে লেখককে কি খেয়েপরে বাঁচতে হবে না? অবশ্যই হবে, তবে খেয়েপরে বাঁচার জন্য লেখালেখি নয়, সেজন্য কৃষিকাজও করা যেতে পারে নয়তো চাকুরির শেকল পায়ে বাঁধা যেতে পারে অথবা বেনিয়াগিরি করেও অন্নসংস্থান করা যায়। লেখালেখি থেকে অন্নের সংস্থান যদি আসে তো ভাল, কিন্তু লেখার উদ্দেশ্য সেটা হতে পারে না, অন্নচিন্তায় বিভোর মনকে মুক্তি দেয়ার জন্যই তো লেখালেখির জন্ম, তাহলে এই "লেখালেখি করে খাওয়া"-র প্যারাডক্স কেন? লেখক যখন নিজের আনন্দে লিখবেন তখন যে মুক্তঝরণার মত কলম চলবে, অন্যের ফরমায়েশে লিখলে সেখানে চড়া পড়তে বাধ্য। নিজেই একবার তাকিয়ে দেখুন না, সম্পাদকের কাঁচি এড়িয়ে যখন ব্লগের মত মাধ্যম এলো, কাউকে তোয়াক্কা না করেই যখন লেখার সুযোগ এলো, তখন লেখার যে গতি আর আনন্দ ছিল, একইসাথে সেই লেখা দিয়ে আপনি পাঠকপ্রিয় হয়ে যাবার পর, এবং হয়তো বইমেলায় ২-১টা বই ছাপা হয়ে যাবার পরে "পাবলিক খাবে কিনা" বা "সম্পাদক নেবে কিনা" বা "প্রকাশক ছাপবে কিনা" অথবা "কেউ রুষ্ট হবে কিনা" নয়তো "কার সাথে খাতির করলে পরের বইটা ছাপা যাবে" এমন নানাবিধ চিন্তা মাথায় নিয়ে লিখতে গিয়ে আপনার সেই অনাবিল আনন্দে কালিমা পড়ছে কিনা! জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য নিজেরই পূর্ব সাফল্যের অনুকরণ করে একই কথা বারবার বলে যাচ্ছেন কিনা! যে সময়টায় আপনি মুক্তপাখির মত কলমডানায় উড়তে পারতেন, সে সময়টা নিজের লেখার বিজ্ঞাপন আর ভক্তদের কাছে নিজের "ভাবমূর্তি উজ্জ্বল" করার কাজে ব্যয় করছেন কিনা! যদি তাই করে থাকেন, তাহলে লেখক হিসেবে তখনই আপনার মৃত্যু হয়ে গেছে, আপনি একজন তারকা হতে পারেন, সেলেব্রিটি হতে পারেন, কিন্তু অন্তরের গভীরে আপনিও জানেন, আপনি আর লেখক নন, পাখির মত নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় যে উড়তে পারে না, ডানা যার বাঁধা, সে আবার লেখক কিসে?

এখন অনেকে প্রশ্ন করবেন, তুমি ব্যাটা লেখকের সংজ্ঞা দেয়ার কে? পারলে লিখে দেখাও তো দুই লাইন! আরে ভাই, সেটাই তো করছি, লেখকের সংজ্ঞা দেয়ার জন্য এ লেখা লিখছি সেটা কে বললো আপনাকে? আমি তো লিখছি কারণ আমার মনে কতগুলো ভাবনা এসেছে যেগুলোকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হচ্ছিলাম, আমার লিখতে ইচ্ছে করছিল, আর আমারই স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সেই ভাবনা আমি লেখায় তুলে এনেছি, পড়বেন কি পড়বেন না, প্রশংসা করবেন কি গালি দেবেন সেটা আপনার স্বাধীনতা, লেখকের কি যায়-আসে?

জন্ম থেকেই মানুষ হয়ে আমি-আমরা শৃঙ্খলে বাঁধা যে শৃঙ্খল থেকে মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নেই, কিন্তু মৃত্যুর আগে অন্তত একটুখানি শৃঙ্খল মুক্তির অনুভূতি পেতে লেখালেখির আর বিকল্প কোথায়?
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×