
কবি মাসুদ মুস্তাফিজ ও তার বহুমাত্রিক কবিতা
দ্বীপ সরকার
কবি মাসুদ মুস্তাফিজ বাংলাদেশের সমকালীন একজন পরিচিত কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্মঃ ২২ নভেম্বর ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে, দিনাজপুর,বাংলাদেশ। তিনি নব্বই দশকের কবি হিসেবে পরিচিত,সেই সময় থেকে বাংলা কবিতার পরিসরে তিনি সমানভাবে কাজ করে চলেছেন। কবির কবিতাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বিমূর্ততা এবং দৃশ্য-প্রতীকের ঘন সঞ্চারণ। প্রতিটি কবিতা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চেতনাকে মিশিয়ে এক ধরনের পোস্ট-মডার্ন ভাষাভঙ্গি তৈরি করেছে, যেখানে অর্থের তেমন কেন্দ্র নেই; বরং বিচ্ছিন্ন চিত্র,চিত্রকল্প,হঠাৎ পরিবর্তিত বাক্যগতি। বাক্যের এক ঠাওর থেকে আরেক ঠাওরে,শক্তিশালী রূপকের মাধ্যমে পাঠককে নিজস্ব ব্যাখ্যার দিকে ঠেলে দেয়। তার অনেক কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়,ভাষার ভাঙন ও রূপকের বহুস্বর।
‘হারানো রুমাল’এ আমরা দেখি ভাষার এক ধরনের দেহীকরণ। ‘ক্রমবর্ধমান শরীরের ব্যাকুল অব্যয়পথ’, ‘রক্তবিভক্তির গোলাপ’ বা ‘সমর্পণ ঘ্রাণের জল’-এসব চিত্রকল্প ভষাকে সরাসরি অনুভূতির বদলে দেহ-সদৃশ এক চলমান কাঠামোয় পরিণত করেছে। এই ভাষাভঙ্গি অর্থকে স্থির হতে দেয় না; বরং ক্রমাগত পিছলে যেতে বাধ্য করে।‘যৌবন ভিজে গর্ভস্থ হয়েছে বিবর্ণ জানালা’-এখানে যৌবন, জল, জানালা-তিনটি স্তরের রূপক একত্রে এসে তৈরি করেছে সময়-দেহ-স্থানের এক যৌথ প্রতীক। এটি পোস্ট-স্ট্রাকচারাল কবিতার অভিব্যক্তি। এছাড়াও তার কবিতায় প্রকৃৃতি ও মানবসমাজের দ্বৈত সংঘাত ফুটে ওঠে।
কবিতা ‘নিমগাছের পাতায় রাহুপাত্রের হাওয়া’য় প্রকৃতি এবং অর্থনীতি, মানুষের ভুল ও প্রকৃতির নীরব দর্শন-এ দু’য়ের সংঘাত স্পষ্ট। ‘নব অর্থনীতির অবনতিদ্বার’, ‘গাণিতিক অসাড়তা’, ‘বহুমাত্রিক বৈষম্য’-এই শব্দচয়ন দেখায় কবি সামাজিক বাস্তবতার গভীরে নিহিত অসাম্য ও নিঃশ্বাসহীনতাকে প্রকৃতির প্রতীকে অনুবাদ করেছেন। এখানে মানুষের ব্যর্থতা পাঠককে একটি দার্শনিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়-প্রকৃতি কি আজও আমাদের শুদ্ধতার আশ্রয়, নাকি আমরা সবকিছুই দূষিত করে ফেলেছি?
কবির ‘খহর’ কবিতায় অস্তিত্বের সংকট ও পারিবারিক-ঐতিহাসিক ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ‘খহর’ কবিতাটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশ ব্যক্তিগত। কিন্তু ব্যক্তিগত হলেও অভিজ্ঞতা আবার বৃহত্তর ও সামষ্টিক অস্তিত্ববাদের উদাহরণ। ‘আমার বাবা-মা রাতদিন হয়ে যাচ্ছে সময়’-এই লাইন অস্তিত্ববাদী উপলব্ধি-সময়ের ভেতর মানুষ কিভাবে নিঃশেষিত হয়-তার এক কাব্যিক উক্তি। ‘অপ্রেমিকার কোলাহল’, ‘তৃতীয় প্রজন্ম’-এগুলো সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতার দারুন প্রতীকীর স্বরুপ। কবিতাটি ভাষার অনির্দিষ্টতা নিয়ে খেলেছে-ইনয়নের আনয়ন অস্থানিক’-একটি পোস্ট-মডার্ন ফ্র্যাগমেন্ট, যা শব্দের অর্থ ভেঙে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। স্মৃতি, আবেগ ও শিল্প-ঐতিহ্যের পুনরালোচনা তার কবিতার আরো স্বরুপে নিয়ে যেতে পারে।‘রোদ্দুর পাহাড়ে’ কবিতাটি প্রকৃতি, স্মৃতি, সংগীত ও সময়-এই চারটি উপাদান দিয়ে নির্মিত। রবীন্দ্রসংগীত থেকে ডিলান-দুটি সাংস্কৃতিক মেরুর উল্লেখ কবিকে এক বৈশ্বিক স্মৃতিশিল্পের ভ্রমণে নিয়ে যায়। এটি ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি-যেখানে পূর্ববর্তী সংস্কৃতির টেক্সট বর্তমান আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থ তৈরী করে। এখানে বৃষ্টি, রোদ, মেঘ-প্রতিটি প্রকৃতিচিহ্ন একটি মানসিক অস্থিরতা ও প্রেমের ভ্রান্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রেম, শরীর ও ক্ষয়ের রূপতত্ত্ব‘ছায়া ঝরে পাতার শব্দে’ কবিতাটি প্রেম ও ক্ষয়কে কেন্দ্র করে। ‘ছায়ার বয়স বেড়ে যায়’, ‘ভবিষ্যৎ প্রতীক্ষার ফুল’-এগুলো প্রেমের বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর ছায়াকে একসঙ্গে ধারণ করে। মেয়েটির ঠোঁটে ‘রক্তগোলাপ’-প্রেম ও যন্ত্রণা একাকার। শেষের লাইনগুলোতে ‘বিষ’, ‘রক্তাক্ত’-এই প্রতীক প্রেমকে নিছক রোমান্টিক না রেখে শরীরের আঘাত ও অভ্যন্তরীণ ভাঙনের সঙ্গে যুক্ত করে। এটি বোদলেয়ারীয় আধুনিকতার একটি ধারাকে স্মরণ করায়।
কবিকে এভাবে মুল্যায়ন করা যেতে পারে। এগুলো লিরিক নয়, বরং ফ্র্যাগমেন্টেড মনোলগ। সময়, প্রেম, শরীর, মৃত্যু, প্রকৃতি-সবকিছুই এখানে স্থির নয়; বরং চলমান, ভঙুর, ধ্বস্ত ও পুনঃর্নির্মিত। ভাষা তথ্য বহন করে না, বরং অনুভবের প্রক্রিয়া তৈরি করে। পাঠককে অর্থ ‘খুঁজে’ পেতে হয়-এটি কবিতার পোস্ট-মডার্ন গুণ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


