বিহারের একটি জেলার নাম দারভাঙ্গা। অনেকের মতে, 'দ্বার-ই-বঙ্গ' শব্দের অপভ্রংশ দারভাঙ্গা। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, মধ্যযুগে তৎসম শব্দের সাথে আরবী-ফারসীর ফিউশন ঘটানো হতো না। আর দ্বার-ই-বঙ্গ তেমনই।
যাহোক, দারভাঙ্গার নাম নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য নেই। যে বিষয়কে উপজীব্য করে এই পোস্ট লিখবো বলে ঠিক করেছি, তাতে দারভাঙ্গার উল্লেখ আছে।
পিতামহ বাবুরের মতোই মুঘল সম্রাট প্রথম আকবর ছিলেন আমের ভক্ত। আকবরের নিজস্ব আমবাগান ছিলো দারভাঙ্গায়। এই বাগিচাটি বিহারের তৎকালীন সুবাদার মুজাফফর খান তুরবতী সম্রাটকে নজরানা হিসেবে দিয়েছিলেন। এই বাগানের বিশেষত্ব ছিলো, এখানকার গাছগুলোতে প্রত্যহ পানির বদলে দুধ দেয়া হতো। এছাড়াও দেয়া হতো চিনির পানি। এমনিতেও বিহারের আম স্বাদের জন্য বিখ্যাত। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আম উৎপাদক, আর এই উৎপাদনের সিংহভাগ আসে বিহার থেকে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয় চীনে। অথচ কয়েক দশক আগেও চীনে আম তেমন পরিচিত ফল ছিলো না। তবে চীনে আম উৎপাদনে উল্লম্ফন দেখা যায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূত্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার মাও সে তুং ফরমোজা (তাইওয়ান) থেকে আনা আম খেয়ে এর দেওয়ানা হয়ে পড়েছিলেন। ধারণা করা হয়, মাওয়ের আমপ্রীতিই আজকে চীনকে শীর্ষ আম উৎপাদকে পরিণত করেছে।
তবে শীর্ষ আম্র উৎপাদকের তালিকায় গরহাজির থাকলেও শ্রদ্ধেয় কাউবয় জেনারেলের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু আম হয় বাংলায়। তাঁর মতে, বাংলাদেশের আমের স্বাদে টক ভাবের অস্তিত্ব থাকায় এই আম কটকটে মিষ্টি স্বাদের নয়। এদেশের সবচেয়ে সুমিষ্ট আমের জাতেও অম্লতা আছে, যা আমরা খাওয়ার কালে অনেক সময় বুঝতে না পারলেও এটাই এদেশীয় আমের স্বাদকে নতুনত্ব দান করে।
সব কিছুর মতো আমাদের দেশে আমের জাতেও ফিউশন এসেছে। এখন ছোট গাছে আম হয়ে যায়। জনসংখ্যার উল্লম্ফন, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়া ক্রয়ক্ষমতা এখন চাপ দিচ্ছে কৃষির উপর। অল্প আয়াসে বেশি ফলনের গুঁতায় এখন বাজারে অগণিত উচ্চফলনশীল ও উন্নততর জাতের আম। কাউবয় জেনারেল নিজেই ফিউশনের মাধ্যমে 'ফজলভোগ' নামের একটি জাত করেছিলেন! তাঁর কাছ থেকে কয়েকটি পিওর ব্রিড আমের জাতের নাম জানলাম। এর মধ্যে কয়েকটির নাম জানি, খেয়েছিও। কয়েকটির নাম আমার কাছে নতুন। কয়েকটি পিওর ব্রিড আম হচ্ছে- ল্যাংড়া, গোপালভোগ, মিছরিভোগ, খিরসাপাত, ছাতাপড়া, ফজলি, সুরমা ফজলি, কুয়া পাহাড়ী, সূর্যপুরী, আশ্বিনা।
কয়েক বছর আগে বান্দরবানের ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্ব পালনকারী ব্রিগেডিয়ার ইসমত আহমদ চৌধুরী দুর্গম বনাঞ্চলে অত্যন্ত সুস্বাদু একটি আমের জাত খুঁজে পেয়েছিলেন। গুগলে দেখলাম, বান্দরবানের পাহাড়ে 'রাঙ্গুয়াই' নামের এক জাতের আমের বড় পসার ঘটছে। এটাই সেই আম কিনা জানিনা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সুবাদে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে আম চাষের ব্যাপক সম্ভাবনার খোঁজ মিলেছে। কিন্তু ওসব এলাকায় খাদ্য হিসেবে আম তেমন প্রচলিত নয়। বলা হয়, আফ্রিকায় মিশনে গিয়ে বাংলাদেশ সফট পাওয়ার এবং সফট পাওয়ারের আগ্রাসী সক্ষমতা সম্পর্কে জোরালো উদাহরণ স্থাপন করতে পেরেছে। দলদাসত্বকে জয় করে যেদিন বাংলাদেশ পশ্চিম আফ্রিকায় সফট পাওয়ারের উপনিবেশ স্থাপন করবে, তখন হয়তো বাংলাদেশীদের দ্বারাই ওই অঞ্চলে আম জনপ্রিয়তা পাবে।
চা এদেশের পানীয় নয়। আব্বার কাছে শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর প্রাচ্যের যুদ্ধ প্রচেষ্টার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল চাঁদপুরে মার্কিন সেনাদের আনাগোনা ছিলো। যোগাযোগব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল হওয়ায় চাঁদপুরে তাদের দেখা যেতো। আজকের মিশন রোডে অবস্থিত খ্রীষ্টান মিশনের চৌহদ্দিতে তাদের ছোট একটা সেনা ছাউনি ছিলো। ততোদিনে ব্রিটিশ জেনারেল উইলিয়াম স্লিমের চতুর্দশ আর্মি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গন ছেড়ে গেছে। তখন এদের স্থলে এসেছিলো কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সেনারা।
এসব কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সৈন্য দুটি কাজ করতো- সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সারে আম পুকুরে গোসল করতো, আর শহরের মানুষদের বিনা পয়সায় চা পান করাতো। তখন উইনস্টন চার্চিলের উপহার দেয়া দুর্ভিক্ষ চলছিলো। এক কাপ চা ছিলো তখন অনেক বড় কিছু। তাছাড়া নতুন এই পানীয় পানে ক্ষুধা দীর্ণ দেহে বল আসতো, অবসাদও কাটতো। মানুষ এভাবে চায়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া শুরু করলো। চায়ের অদম্য নেশা সৃষ্টি করলো বাজার। এরপর জীবন আর পেছনে ফিরে গেলো না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িত থাকার সময়ই মিত্রশক্তি সফট পাওয়ার দিয়ে নিজেদের বাজার সৃষ্টি করে গেলো। যার কারণে ব্রিটিশের বিদায়ের পরও গেলো না জেমস ফিনলে, ব্রুকবন্ড, ফোর্টনাম অ্যান্ড ম্যাসন, লিপটন, ম্যাকলয়েড, ডানকান ব্রাদার্সরা।
যে ভাবমূর্তি বাংলাদেশ আফ্রিকায় বিনা পয়সায় পেয়েছিলো, তা মনে হয় ফিকে হয়ে গেছে। কারণ, মহাথির মোহাম্মদের ভাষায়, "বাংলাদেশে উন্নয়নের চেয়ে রাজনীতি বেশি হয়।"
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:৩৬