রুপিতে বাণিজ্য নিয়ে এই ফোরামে অভিজ্ঞ ব্লগার সোনাগাজীর একটা লেখা অনেকেই উৎসাহ নিয়ে পড়েছেন ও মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়েই গতকালের সমকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ জনাব সালেহউদ্দিন আহমেদ সাহেবের একটা লেখা শিরোনামে উল্লেখিত নামে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টির গুরত্ব ও অনেকের আগ্রহ বিবেচনা করে লেখাটি এখানে দিলাম। আমি এ বিষয়ে এক্সপার্ট নই, এতে আমার কোনো মতামতও যোগ করা থেকে বিরত রইলাম এবং সেই সাথে লেখক ও দৈনিক সমকালের নিকট কৃতজ্ঞতা জানাই।
রুপিতে বাণিজ্যে বাংলাদেশের লাভ কতটা?
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন একটি যুগে প্রবেশ করল; আমরা দেখতে পেলাম। অন্তত কাগজ-কলমে সেটাই বলা হচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি অন্য কোনো মুদ্রাকে গ্রহণ করল। এখন বলা হচ্ছে, রুপিতে শুরু হলেও উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যবধান এক সময়ে কমে এলে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকায়ও হবে এ বাণিজ্য। এর ফলে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির বেলায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন। এর মাধ্যমে ডলারের একক প্রাধান্য খর্ব হলো।
ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় লেনদেন কার্যক্রমের উদ্বোধনে যৌথ আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনকে আমরা দেখেছি। এখানে বাংলাদেশের পক্ষে সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের পক্ষে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক।
ভারতীয় রুপিতে লেনদেন হলে আমাদের অতিরিক্ত কোনো সুবিধা দেখছি না। আবার আন্তর্জাতিকভাবে যদি বলি, ভারতীয় মুদ্রা রুপি রিজার্ভ কারেন্সিও নয়। এভাবে চলতে থাকলে সুবিধা কী হবে; তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে অসুবিধা হবে– এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ আমরা রপ্তানি করি কম, আমদানি করি বেশি। আমরা তো আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছি। রপ্তানি করলে তারা রুপিতে শোধ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমদানির এত রুপি কোথা থেকে পাওয়া যাবে? এটা তো পরিষ্কার, ডলার ভাঙিয়ে আমদানি দায় শোধ করতে হবে। অথবা ভারতকে আমদানি ব্যয় ডলারে দিতে হবে। তাতে আমাদের বিশেষ কোনো লাভ নেই। আবার ভারতও টাকা নিতে চাইবে না। কারণ তারা টাকা কোথায় খরচ করবে? যেমন– ভারত রাশিয়া থেকে রুপিতে অনেক কিছু কিনেছে। এখন জানা যাচ্ছে, রাশিয়া বলছে, ভারতীয় রুপি তারা খরচ করতে পারছে না। এর ফলে রাশিয়া আর এখন রুপিতে লেনদেন করতে রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ঠিক কোন বিবেচনায় এটি করতে সম্মত হয়েছে– আমার জানা নেই। এখনই যেহেতু শুরু হলো, তাই এর ফলাফল কেমন আসে তা আগেভাগে বলা যাবে না। কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে ফলাফল দেখার জন্য। সেটুকু অপেক্ষা না হয় করা গেল। কিন্তু সরকারের তরফে তো আগেভাগেই সুফলের দিকটা জনগণের সামনে পরিষ্কার করার দরকার ছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বেশ কিছু কারণে রুপিতে বাণিজ্য করার বিষয়টি সামনে এসেছে। ডলার সংকটে রয়েছে উভয় দেশ। ফলে উভয় দেশ এতে লাভবান হতে পারে। ডলার পরিহার করায় আমদানি-রপ্তানিকারকদের মুদ্রা বিনিময় খরচ কমবে। পারস্পরিক লেনদেন সম্পন্ন করতে সময় বাঁচবে। কিন্তু যেটি আগেই উল্লেখ করেছি, বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে এখনও স্বীকৃত মুদ্রা নয় ভারতীয় রুপি। তাই রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। বিষয়টি যে একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত– তা বলা যাবে না। এর অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে বিনিময় হার। এটা প্রথমে নির্ধারিত হতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা বর্তমানে অবমূল্যায়িত হয়ে আসছে। দিন দিন টাকার মূল্য কমছে। আমরা ইতিবাচকভাবে আশা করতে চাই, এটি ভবিষ্যতে হয়তো শক্তিশালী হতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে, তখন যেন ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হারে সামঞ্জস্য আনা হয়। এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কিছু বিষয় নিয়ে তাই সতর্কতা জরুরি বলে মনে করি। প্রথমত, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ যেন ক্ষতির ভাগীদার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এখন দেখতে হবে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য কতটুকু হয়। আমরা ভারতের সঙ্গে আমদানির তুলনায় রপ্তানিতে পিছিয়ে আছি। যতটা রপ্তানি করি, তার সাত গুণ আমদানি করি। রপ্তানির টাকাটা ভারত আগে ডলারে পরিশোধ করত, এখন রুপিতে করবে। তার মানে, প্রতি বছর যে ২০০ কোটি ডলার রপ্তানি বাবদ ভারত থেকে আসত, সেটা আসবে না। তার বদলে ওই পরিমাণ রুপি আসবে। তার মানে ডলারে আয় কমে গেল। তাই আমরা যে খুব লাভবান হবো, তা কিন্তু নয়।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন রুপিতে করা হলেও সেটি তো নির্ধারণ করা হবে ডলার দিয়েই। অর্থাৎ কত রুপির দামে কত ডলার পাওয়া যাবে, সেটা হিসাব করে টাকা দিতে হবে। তাহলে মূল কাজটা হলো কী? তার চেয়ে যেটি জরুরি ছিল; অর্থনীতির অন্যান্য যে দুর্বলতা তা ঠিক করা। তাহলে বিনিময়ের এই নতুন ঝুঁকি তৈরি হতো না।
এ সিদ্ধান্ত যেভাবে গৃহীত হলো, অর্থাৎ অ্যাডহক বা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে সরে আসতে হবে। এর আগে আমরা দেখেছি, জ্বালানি ক্ষেত্রে এ রকম অ্যাডহক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আমরা স্মরণ করতে পারি, কুইক রেন্টাল পাওয়ার করে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলো। সেই তুলনায় উপকার খুবই নগণ্য। এ সিদ্ধান্তের পর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিনিয়োগকারীরা লাভবান হলো। মুনাফা করে গেল তারা, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হলো। এখন আবার এ ধরনের আরেকটি অ্যাডহক সিদ্ধান্ত আমরা দেখতে পেলাম।
আমাদের রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। হুন্ডিতে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব বন্ধে পদক্ষেপ দেখছি না। দেশের অর্থনীতির আসল যে সমস্যা, সেসব না দেখে মুদ্রা বিনিময় নিয়ে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো, সেটা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। মাথাব্যথা, হাত-পা ব্যথা হলে আগে সেটা চিহ্নিত করতে হবে; তারপর চিকিৎসা দিতে হবে। সেটা না করে পেটব্যথার ওষুধ দিলে কাজ করবে না– এটিই স্বাভাবিক।
যদি বলতে হয়, এ ব্যবস্থায় তবে নতুন কী দেখা গেল? সেদিক থেকে বলতে হবে, রুপিতে লেনদেন শুরুর মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যে একটি বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে দেখা গেল। কিন্তু অর্থনীতি যদি চাঙ্গা করা না যায়; যদি এ ধরনের লেনদেনে সুফল না আসে, তবে শুধু বৈচিত্র্য দিয়ে কাজ হবে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২৩ ভোর ৪:৪৫