কবি লিখেছিলেন , " জগত জুড়িয়া এক জাতি আছে , সে জাতির নাম মানুষ জাতি" ।
কিন্তু কে শুনে কবির কথা । আচার-আচরন আর চেহারার মিল কিংবা ধর্মের মিল দেখে অনেক পন্ডিত মানুষ নানা জাতি গড়ে তুলেছেন । আবার সবসময় যে বলেকয়ে জাতি তৈরি হয়েছে এমনটাও নয় ।
এক এক জাতি জাত্যাভিমানের জিগির তোলেন আর সমাজতাত্বিকরা দু ভাগে হয়ে যান- কেউ পক্ষে , কেউ তার বিপক্ষে !
ওল্ড টেস্টামেন্টের পাতা খুলুন । দেখবেন লেখা রয়েছে মানুষে মানুষে যে ফারাক তা সহজাত,বংশগত ও অপরিবর্তনীয় ।
শুধু ওল্ড টেস্টামেন্ট কেন , ইসলাম ব্যাতিত প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থেই একই সুর ধ্বনিত হয়েছে । জন্মসুত্রে কেউ অভিজাত তো কেউ অধস্তন । অধস্তনেরা "Cursed be cannan; a servant of servants shall he be unto his brethren."
গ্রিকেরা একসময় মনে করতো ওদের বাদ দিয়ে পৃথিবীর বাকি সবাই বর্বরদের দলে ।
হেরোডেটাস বলে গিয়েছেন পার্সিয়ান লোকেরা নিজেদের ছাড়া আর কাউকে মানুষ গন্য করতোনা ।
দার্শনিক এরিস্টটলের নাম তো শুনেছেন । তিনি বলেছেন জন্মসুত্রেই পৃথিবীর কিছু মানুষ স্বাধিন আর বাকি সবাই ক্রীতদাস ।
ষোড়শ শতাব্দিতে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করতে গিয়ে মার্কিনিরাও একই কথা উচ্চারন করে ।
উনবিংশ শতকে পৃথিবী যখন সামন্ত থেকে ধনতন্ত্রে যাওয়ার পথে শিল্পবিপ্লবে শামিল , তখন বস্ত্র ও বয়নের জন্য পুনরায় দরকার পড়ছিল দাসপ্রথার । প্রয়োজন হয়েছিল কালো চামড়ার মানুষদের নিকৃষ্টতর বলে ঘোষনা দেবার । আর তাই দরকার পড়েছিল বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যার । ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাথে মিলিয়ে যেই অপবিজ্ঞানের নাম "সোস্যাল ডারউইনিজম" !
ডারউইনের "survival of the fittest" কথার সাথে মিলিয়ে বলা হলো 'Inferior' কালো মানুষগুলোকে 'Superior' সাদা মানুষদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে ।
বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে মানুষ নিধনের এই প্রচেস্টা আমরা হাল আমলে গুজরাট গণহত্যায়ও দেখেছি । যেখানে নরেন্দ্র মোদী ঐ গনহত্যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন 'নিউটনের সুত্র' হিসেবে !
জনাব ম্যাডিসন গ্রান্ট ছিলেন একজন পাঁড় সোস্যাল ডারউইনিস্ট । ১৯১৬ সালে তিনি লিখে ফেলেন "The nursing of the great race" নামে একটি বই ।
বইটি একসময় আমেরিকার বেস্ট সেলার হয়ে উঠে ।
বইটির মুল কথা ছিলো, বিদেশীদের সংগে সংমিশ্রণের ফলে উত্তর আমেরিকার মানুষজনের মহত্ গুণ লোপ পাচ্ছে , বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে তাই বাইরের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে ।
আটলান্টিক পার হয়ে বইটি যখন জার্মানীর হিটলারের হাতে এসে পৌঁছায় তখন হিটলার যেন আকাশের চাঁদ হাতে পান । গ্রান্টকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বইটিকে তার বাইবেল হিসেবে বিবেচনা করেন ।
ব্যস , হিটলারও এবার জার্মানদের বিশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্বে শুরু করলেন ইহুদী নিধন , আইন করলেন জার্মান কেউ ইহুদী কাউকে বিয়ে করতে পারবেনা ! বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেখা গেলো লাখ লাখ ইহুদী মারা পড়েছে !
ধুর ছাই , কালোদের মারতে গিয়ে দেখি সোস্যাল ডারউইনিস্টরা ইহুদীদের মারা শুরু করলো ! শুরু হলো তাই সোস্যাল ডারউইনিজমের বিরুদ্ধে প্রচারনা , বর্ণবাদ বিরোধী প্রচারণা !
তবু আজও বর্ণবাদ টিকে আছে , হয়ত রাষ্ট্রীয়ভাবে নয় , সামাজিকভাবে , সারা বিশ্বে , প্রতিটি মানুষের অন্তরে !
বর্নবাদ যে কেবল গায়ের রঙে হয় তা নয় , মুখে দাঁড়ি দেখলেই 'জঙ্গি' বলা বা ধুতি দেখলেই 'মালাউন' বলাও বর্নবাদ ।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা , আফ্রিকা থেকে চায়না কেউ কি এই বর্নবাদ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে ?
পারেনি , তাই কেবল মাঠের গ্যালারির ঐ বাঙালী দর্শকদের গালি দিয়া লাভ নাই । ঐ বাঙালী নিজেও জানে সে কালো , তবু সে নিজ দেশের রুবেলকে 'কাইল্লা' ডাকে , ভীনদেশের রাবাদাকে 'নিগ্রো' ডাকে ! এটা যে সে বর্নবাদের ভারিক্কি আদিখ্যেতায় ডাকে তা নয় , এটা তার একধরনের জন্মগত বিকৃত প্রবৃত্তি !
শেষ করছি , ইউরোপের মানুষদের নিজেদের 'Superior' ভাবার মুখে চুনকালির ঘটনা দিয়ে ।
বিংশ শতকের শেষের দিকে যখন ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলো তখন ইউরোপিয়ানদের মাঝে আগ্রহ জন্মায় নিজেদের পুর্বপুরুষের ব্যুতপত্তি নিয়ে !
বংশের প্রাচিনত্ব জানতে সবাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতে লাগলো ।
পরীক্ষা করে শেষে জানা গেল সবাই এসেছে ঐ আফ্রিকা থেকে যাদের তারা এতদিন 'Inferior' বলে আসছে !