আমার জন্মের পর নতুন এক জন্ম দিয়েছে এই গবর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল । এখনো মনে আছে স্কুলে প্রথম দিন যাবার পথে একজন মনোগ্রাম দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘’ তুমি ল্যাবরেটরিতে পড়? ‘’ । কোন এক অজানা কারনে খুব গর্ব করেই বলেছিলাম ‘’ হ্যা’’ আমি ল্যাবে পড়ি। হয়ত বাতাসের দোষ। ল্যাবরেটরিয়ান বাতাস।
আমার স্কুল আমার শৈশব , আমার কৈশর, আমার প্রাণ । আজ আমি যতটুকু পেয়েছি তার সিংহভাগ আমার স্কুলের কল্যানে । কোথাও যখন কেউ প্রশ্ন করে কোন স্কুল থেকে পাশ করেছি নিজেকে ল্যাবরেটরিয়ান পরিচয় দিতে এক পৈশাচিক আনন্দ পাই আমি ।
শীতকালীল সমাবেশ, টিফিন টাইমে মুড়ি মামার মুড়ি কিংবা জিভে জলআনা চটপটি। যদিও এখন সব স্মৃতি তবুও মনে হয় এইতো সবে ক’দিন হল শেষ করেছি । স্কুল পালানোর দিন গুলোর কথা আর নাই বা বললাম । স্কুল পালিয়ে ঢাকা কলেজের পুকুর , ধানমন্ডি লেক , বলাকা না হয় আজিমপুর । এই ছিলো আমাদের স্কুল পালানোর গন্ডী।
স্কুলজীবনের শেষ সময় গুলোর মধ্যে বেশখানিকটা সময় কেটেছে বিজ্ঞান ক্লাব আর বি এন সি সি রুমে । এক একটি স্মৃতি যেন এক একটি ইতিহাস । ল্যাবরেটরিয়ান’রা সবার থেকে সব দিক দিয়েই একটু বেশি এডভান্স হয় । আর মূল বাদড়াঁমি বা মধুরতম সময় কাটে এই স্কুলজীবনের শেষ সময় গুলোতে , নবম আর দশম শ্রেনিতে ।
খেলাধুলার ভেতর, স্কুলের করিডোড়ে বোতল দিয়ে ফুটবল খেলা, বা ডায়েরি আর কাগজের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা , কলম লড়াই , কাগজের বা হাতে হাতে ক্রিকেট/ ফুটবল ছিলো অন্যতম । নিম্নমাধ্যমিকের আগ পর্যন্ত এগুলোই যেন মূল আকর্ষন।
ল্যাবের ‘টিফিন’ যেন এক অমৃত । বুটের ডালের সাথে পরোটা , কলা – সিঙ্গারা , পুরি-জিলাপি বা নিমকি । আর জানুয়ারিতে শীতের সময় বার্ষিক ফলাফল দেয়ার সময় কোন এক শীতকালীন ফল । কমলা’র খোসা চোখে ছিটিয়ে দেয়া বা কলার খোসা দিয়ে প্রায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা । আজো ফিরে যেতে মন চায় সেইসব দিন গুলোতে ।
ল্যাবের প্রত্যেকজন শিক্ষক এক এক জন ‘’লেজেন্ট’’ । শামীম স্যার , আলমগীর স্যারের গনিত ক্লাস, আলতাফ স্যারের ইংরেজী , ওয়াদুদ কিংবা গোলাম মোস্তফা স্যারের সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাস, সালেহীন স্যার , শ্যামল স্যার বা নোমান স্যারের বজ্র কন্ঠ , ফররুখ স্যারের সিলেটি ভাষা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবিউল স্যারের নবাব সিরাজ উদ দৌলা’র সংলাপ ।আজিজুল হক স্যারের ক্লাসে ‘’ অথর্ব ‘’ আর ‘’ রাবিশ ‘’ শব্দে বকা দেয়া । তাদের জ্ঞান , পড়ানোর ধরন , ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মত মিশে যাওয়া এক কথায় অসাধারন । তাদের ছাড়া আমার দশ বছরের ল্যাবরেটরিয়ান জীবন ব্যর্থ। মা- বাবা’র থেকে কোন অংশে কম নেই তারা । হাজার ভিড়ের মাঝে তাদের খুজে পেলেও ইচ্ছে হয় পা’য়ে হাত দিয়ে সালাম করি । তাদের সম্মান আমার কাছে এতটাই বেশি।
ল্যাব আমাকে কিছু দিন আর নাই দিক ‘ বন্ধু ‘ দিয়েছে একজীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যাদের সাথেই আমার জীবনের দশটা বছর পাড়ী দিয়তে ফেলেছি । পাশ করেছি প্রায় দু’ বছর হতে চলল এখনো কারো বিপদে এক নিমেশেই হাজির সবাই । এখনো পুরোনো কোন বন্ধুকে কাছে পেলে মনে হয় যক্ষের ধন খুজে পেয়েছি । বুকে জড়িয়ে নিতে এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না। শেষ পর্যন্ত আমরাই থাকবো একসাথে । সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা এটিই ।
‘’ শেখার জন্য এস, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও’’ মূলমন্ত্রে দিক্ষিত আমি । গভঃ ল্যাব কে আমি প্রানে ধারন করি। আমার শিকড় এখানে। যেদিন শেষ ক্লাস করি সেদিনও কষ্ট হয়নি, যেদিন এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল দিলো , সরাসরি সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো সেদিনও কষ্ট পাইনি । পাবো না। হয়ত স্মৃতিগুলো মনের গহীনে প্রান ফিরে পাবার চেষ্টা করবে তবুও এতটুকু খারাপ লাগবেনা ।
কারন একটিই, অন্যান্যদের মত নিজেকে কখনো ‘এক্স’ পরিচয় দিই না । আমার পরিচয় আমি ‘ ল্যাবরেটরিয়ান ‘ । এ পরিচয় আমার আজীবনের ।
আমি গর্বিত , আমি ‘ ল্যাবরেটরিয়ান’ ।
ল্যাবাই – ল্যাবিউ
দেখা হবে......
OLsA Reunion 2015
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৪