একদিন রাতের বেলা এক শেয়াল গিয়ে হাজির হলো এক বিয়ে বাড়ীতে। বিয়ে বাড়ী। খাওয়া দাওয়ার কোন কমতি নাই। সে গন্ধ শুকতে শুকতে রান্না ঘরের বেড়ার ছোট এক ভাঙ্গা অংশ দিয়ে অনেক কসরত করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভিতরে ঢুকে তার তো মাথা খারাপ। নানা পদের বাহারী সব খাবার-দাবার, যেন তার জন্যই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। গভীর রাত, বিয়ে বাড়ীর সবাই ঘুমে অচেতন। তাকে বাঁধা দেওয়ার কেউ নাই। সে মনের সুখে নানা পদ খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ করে সে যখন বের হতে যাবে তখনই বাধল বিপত্তি। যে পথে সে ভেতরে ঢুকেছিল সে পথে তো আর বের হতে পারছে না। ঢোকার সময় পেট খালি ছিল অনায়াসে ভিতরে ঢুকতে পেরেছে। এখন ভরপেটে বহু চেষ্টা করেও আর বের হতে পারল না। কি আর করা। সে রান্নাঘরের এককোনে লুকিয়ে থাকল। আশা খুব ভোরে যখন দুয়ার খোলা হবে সেই সুযোগে দৌড়ে পালাবে। কিন্তু বিধি বাম। পেট ভরা থাকায় তার ঝিমুনির মত আসতে লাগল এবং এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কখন ভোর হল তা সে টেরও পেল না।
সকালে গৃহকর্তা দরজা খুলে দেখে শেয়াল পন্ডিত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। খাবার-দাবার সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গৃহকর্তা দ্রুত দরজা বন্ধ করে বাইরে এসে সকলকে ঘটনা খুলে বলল। রান্না ঘরে শেয়াল ঢুকেছে এবং খাবার দাবার সব নষ্ট করেছে এ খবরে বিয়ে বাড়ির লোকজন হৈ হৈ করে হামলে পড়ল রান্নাঘরে। শেয়াল আর পালানোর সুযোগ পেল না। ধরা পড়ল সে। তারপর সবাই মিলে আচ্ছামত উত্তম-মধ্যম দিল। মার খেয়ে শেয়ালের যখন যায় যায় অবস্থা তখন দুষ্টু ছেলের দল তাকে গলায় দড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল গ্রামের বাইরে খোলা মাঠে। সেখানে আরও একপ্রস্থ ধোলাই দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেধে রেখে ছেলের দল গ্রামে ফিরে গেল। শেয়ালের জান খুব শক্ত। এত মার দেওয়ার পরও ঘন্টা কয়েকের মধ্যে সে বেশ সুস্থ হয়ে উঠল।
এদিকে ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল বাঘ মামা। শেয়ালকে গাছের সঙ্গে বাধা দেখে বাঘ ডেকে বলল - কি হে শেয়াল পন্ডিত তোমার গলায় দড়ি কেন?
চতুর শেয়াল নতুন গল্প ফাঁদল। বলল - কি আর বলব মামা। ঘটনা হইছে কি শোনেন তবে। এক বিয়ে বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিলাম। গৃহকর্তা বলল দাওয়াত না খাইয়া শেয়াল পন্ডিত কই যায়? আমি বলি বাড়ীতে কাজ আছে। গোস্ত পোলাও খাইবার সময় নাই। তারা নাছোরবান্দা। বলে না খাইয়া গেলে কনের অমঙ্গল হইবো। জোর কইরা খাওয়াইল। পরে বিয়া বাড়ির দুষ্ট পোলাপাইন আমারে এইখানে বাইন্দা রাখছে। বিকালে আবার খাইতে হইবো। পাছে পালিয়ে যাই সেই জন্য এই ব্যবস্থা। তৈলাক্ত জিনিস কত আর খাওয়া যায় বলেন? কিন্তু হেরা নাছোরবান্দা।
বাঘ ভাবে, আমি খাবার পাইনা আর শেয়াল পন্ডিতরে জোর করে খাওয়ায়। এরেই কয় কপাল। বাঘ বলল - তা আমাকেও তোর সঙ্গে নেনা, কিছু ভালমন্দ খাই।
ধূর্ত শেয়াল বলল - দাওয়াত তো একজনের, দুইজন যাই কেমনে? তাছাড়া মান-সম্মানের বিষয় আছে না। তবে এক কাজ করা যায়।
বাঘ আগ্রহী হয়। চতুর শেয়াল বলে - আমার গলার এই রশি তোমার গলায় পড়িয়ে দিতে পারি। বিকেলে ওরা এসে রশিতে বাধা তোমাকে পাবে আর তোমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে খাওয়ানোর জন্য।
বাঘ ভাবল বুদ্ধি মন্দ না। সে তখন বলল - তবে তাই কর না!
সে শেয়ালের বাধন খুলে দিলো। আর শেয়াল সেই রশি বাঘের গলায় পরিয়ে দিল। বলল - বাঘ মামা নিশ্চিন্তে থাক বিকালবেলা ভাল খানা-পিনার ব্যবস্থা হইব। তারপর সে সেখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ল। বাঘ অপেক্ষা করতে লাগল ভাল খানাপিনার।
বিকেলে ছেলের দল আবার আসল শেয়াল মরল না বাঁচল তা দেখার জন্য। এসে দেখে এই অবস্থা। শেয়াল নাই তার স্থানে বসে আছে এক বাঘ। বাঘ দেখেতো ছেলের দল চিৎকার চেচামেচি শুরু করল। গ্রামের লোকজন চলে এলো ঘটনা কি দেখার জন্য। আজব কারবার। সবাই ভাবল মারের চোটে শেয়াল বাঘ হয়ে গেছে। এখন এ বাঘ যদি একবার ছাড়া পায় তাহলেও বিপদ। সবাই লাঠিসোটা নিয়ে হামলে পড়ল বাঘের উপর। এমন মার দিল তা কি আর বলব। মার খেয়ে বাঘ এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ল। সবাই ভাবল বাঘ মারা গেছে। এরপর তারা বাঘের গলার রশি খুলে দিয়ে দুরে ফেলে দিয়ে আসল।
গভীর রাতে বাঘের জ্ঞান ফিরল। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল। আমার সঙ্গে মামদোবাজী! আমার সঙ্গে! শালা শেয়াল পন্ডিতকে আগে সাইজ করবো পরে অন্য কথা।
এদিকে শেয়াল এক মরিচ ক্ষেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য ক্ষেতে পাকা মরিচ খেতে আসা মুরগি ধরে খাওয়া। খুজতে খুজতে বাঘ সেখানে এসে হাজির হ’ল। তা বাবাজী এইবার যাইবা কই? খুব তো খেইল দেখাইলা। আজ তোমার শেষ দিন। বাঘ হুঙ্কার ছাড়ল। শেয়াল বলল - মামা আমারে পরে খাও। আগে এই পাকা মরিচ খাও। এরপর নাহয় আমাকে খেও।
শেয়াল পন্ডিত পেকে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া মরিচের নানা গুনাগুণ বর্ননা করতে লাগল। বলল - একসাথে যদি তুমি এক মুঠো পাকা টকটকে লাল মরিচ খেতে পার তবে তোমার সব রোগ সারবে। এ অমৃত সেবনে তোমার জীবন ধন্য হবে। কিন্তু খেতে হবে এক মুঠো। খবরদার এর কম কিন্তু খেওনাকো।
লাল টকটকে মরিচ দেখে বাঘের খুব লোভও হ’ল। হঠাৎ জরুরী কোন কাজের কথা মনে পড়েছে এমন এক ভাব নিয়ে শেয়াল বলল - মামা তুমি মরিচ তুলতে থাক আমি ততক্ষনে আসছি। এরপর ধূর্ত শেয়াল সেখান থেকে সটকে পড়ল। বোকা বাঘ মুঠো ভর্তি লাল টকটকে মরিচ তুলে মুখে পুরে আরামসে চিবুতে লাগল। কয়েক চিবুনি দেয়ার পরেই বাঘ টের পেল শেয়ালের চালাকি। কিন্তু তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। প্রচন্ড ঝালে তার মুখ পুড়ে যেতে লাগল, নাক মুখ দিয়ে গরম ধোয়া বের হতে লাগল। সে পাগলের মতো দিগ¦বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগল। শালা বদমাস, ধোকাবাজ কোথাকার, এবার শেয়ালকে পেলে আর আস্ত রাখবো না, যেখানে পাব সেখানে কাঁচা চিবিয়ে খাবো এমন ভাব নিয়ে সে শেয়ালকে খুজতে লাগল।
শেয়ালকে খুজতে খুজতে একদিন এক বনে এসে হাজির হ’ল। দেখে শেয়াল জঙ্গলের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মুখে পুরে রেখেছে একটি লম্বা লাঠির মাথা। লাঠির অপর প্রান্ত একটি মৌচাকের ভিতরে ঢুকানো। ঘটনা হচ্ছে মৌচাকে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে যে মধু চুইয়ে পড়ছে সেটা শেয়াল মজা করে খাচ্ছে।
দেখে তো বাঘ তেড়ে এল। হারামজাদা। এবার তোকে আমি কাঁচা চিবিয়ে খাব। আমার সঙ্গে বদমায়েসি। শেয়াল বলল - মামা আমাকে একটু পরে খাও। তার আগে তুমি এখানে একটু মুখ লাগাও। শেয়াল তার মুখে থাকা লাঠিটি বাঘের দিকে এগিয়ে দিল। বাঘ তার পুরোনো কথা ভুলে লাঠির মাথায় মুখ লাগালো। অমনি সুমিষ্ঠ মধু তার মুখে পড়ল। মধু বড়ই সুস্বাদু। বাঘ লোভে পড়ল। ওমনি শেয়াল মধুর গুন বর্ননায় লেগে গেল। মধু সকল রোগের মহৌষধ। পিত্তরস সঞ্চারক। সর্বরোগ বিনাশী। ইত্যাদি ইত্যাদি। বলল- আমি ছোট প্রাণী অল্পতে তুষ্ট। তোমারতো আর আল্পতে হবে না। তুমি বরং ঐ গাছের ডালে পা রেখে মুখটি মৌচাকে ডুবিয়ে দাও। একসাথে অনেক মধু পাবে ওখানে। তৃপ্তিসহকারে খেতে পারবে। বাঘ ভাবলো শেয়ালতো ঠিকই বলেছে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে উচু ডালে সামনের দু’পা তুলে দিল আর মুখটি জোড় করে ঢুকিয়ে দিলো মৌচাকের মধ্যে। আর যায় কোথায় মুহুর্তের মধ্যে শত সহস্র মৌমাছি উড়ে এসে হুল ফুটাতে লাগল বাঘের চোখে-মুখে-সর্বশরীরে। বাঘতো মাগো বাবাগো বলে দৌড়াতে লাগল আর মনে মনে শেয়াল পন্ডিতের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল। আর শেয়াল ততক্ষনে পগারপার।
------------------------------------------------------------------
কি! কি বুঝলেন? শিয়ালের কাছে বারবার ধরা খাওয়া কিন্তু ছইলতো ন’অ।