'ভাই কি হবে আমাদের কথা লিখে?কতজনের কথা লিখবেন?পত্রিকার পাতায় ছাপা হলেই কি বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের উপর নির্যাতন?যদি ছাপা হলেই আজকের পর আর কোন বাংলাদেশী নারী শ্রমিক নির্যাতন হবেনা এমন গ্যারান্টি দিতে পারেন তাহলে কেমন করে বেঁচে আছি সব বলব।প্রয়োজন হলে নির্যাতনের চিহ্নগুলোর ছবি উঠিয়ে আপনাদেক দেব।জানি আপনি সে গ্যারান্টি দিতে পারবেন না।কারণ,আপনার সেই ক্ষমতা নেই।'বলেই মেয়েটি কেঁদে ফেলল।৫মিনিটেরও বেশী সময় পর মেয়েটি কান্না থামিয়ে জানতে চাইল, আমি কোন পত্রিকার সাংবাদিক?লিখে কত টাকা পাব?মেয়েটিকে যখন বললাম,আমি কোন পত্রিকার সাংবাদিক নয় এবং প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে লিখতে গিয়ে যা খরচ হচ্ছে তা আমাদের কেউ দেবেনা।মেয়েটি হেসে উঠে বলল,ভাই আপনার লেখা কেউ চাপবেনা।তার চাইতে বরং সরকারী অথবা বিরোধী দলগুলোর প্রবাসী সংগঠন নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কিছু লিখে দিন দেখবেন ছাপা হবে।।অবাক বিষ্ময়ে বললাম,কি বলতে চাইছেন?আমাকে অবাক করে দিয়ে সীমা (ছদ্মনাম) নামের মেয়েটি বলল,পত্রিকাগুলো সরকার আর বিরোধী দল নিয়েই ব্যস্ত।পত্রিকাগুলো যদি একটু প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে লিখত তাহলে সরকার আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিত।দুতাবাসের কর্তাবাবুদের বিলাসী বিবেক হয়ত আমাদের যাপিত জীবনের কথা শুনার একটু হলেও সময় পেত। যে ট্রাভেল এজেন্সীর প্রতারনার শিকার হয়েছি তাদের মুখোশ খুলতে একশবার ফোন করেও দুতাবাসের কাউকে পাওয়া যায়না।আমাদের মত খাদ্দামাদের(কাজের মেয়ে ) কথা শোনার সময় কর্মকর্তাদের নেই।ফোন করলে বলা হয় ফর্ম ফিলাপ করে অভিযোগ জমা দিতে।কিন্তু,ফর্ম পাব কোথায়?
সরকার,মিডিয়া,দুতাবাসের প্রতি ক্ষোভে বিভোর মেয়েটির নাম সীমা।৩বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়।কৃষক বাবার বড় সন্তান সীমা মেধাবী হওয়া সত্তেও অভাবের কারণে এসএসসির পর আর পড়াশোনা হয়নি ।৪বছর আগে সীমার সহজ সরল কৃষক বাবাকে স্থানীয় এক ভিসার দালাল জানায় হাসফাতালের ভিসা আছে।১লাখ ৪০হাজার টাকা খরচ করে সীমাকে বিদেশ পাঠালে বছর তিনেকের মধ্যে বড় লোক হয়ে যাবে।বাংলাদেশী টাকায় প্রতি মাসে বেতন ১৭হাজার টাকা।থাকা,খাওয়া-দাওয়া ,ফ্রি চিকিৎসা,দুই ঈদে বোনাস,সপ্তাহে একদিন ছুটি।প্রতি ২বছর পর ২মাসের ছুটি।দালালের মিথ্যাচারে বিশ্বাসী হয়ে ফসলের জমি বিক্রি করে ২০০৪সালে সীমাকে বিদেশ পাঠায় সীমার সহজ সরল বাবা।অপরিচিত পরিবেশে আসার কয়েক ঘন্টা পরই সীমা বুঝে যায় সে প্রতারনার শিকার। হাসপাতালের নার্সের সহকারী নয় তার চাকরি হচ্ছে খাদ্দামার(বাসার কাজের মেয়ে)।আসার ২দিন পরই কফিলের (মালিক) ১৭বছরের ছেলেটির পশুত্বের শিকার হয় সীমা।সেই থেকে শুরু।ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত মেয়েটিকে কিচেন থেকে বাথরুম পরিষ্কার সব কাজই করতে হয়।ক্লান্তি শেষে বিছানায় গিয়েও রক্ষা নেই।কখনো মালিকের বড় ছেলে কখনো মেঝ ছেলে হয় সীমার রাতের সঙ্গী।মাসের বিশেষ দিনগুলোতেও মেয়েটির রক্ষা নেই।মাসের বিশেষ দিনগুলোতে বিকৃত যৌনতার শিকার হতে হয় সীমাকে!
৩৫বছরের রাজিয়া।৩সন্তানের জননী।কাজ করে প্রভাবশালী এক সৌদিয়ানের বাসায়।গৃহকর্তা অসম্বভ রকমের ভাল হলেও গৃহকত্রী সাক্ষাৎ জমের মত।কাজে একটু ভুল হলেই হাতের কাছে যা পাবে তা দিয়েই আঘাত করে রাজিয়ার শরীরে।রাজিয়ার সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ।শুধু আঘাত করেই ক্ষান্ত হয় না গৃহকত্রী।বন্ধ করে দেয় রাতের কিংবা দুপুরের খাবার।৬মাস ধরে একটা টাকাও পাঠাতে পারেনি সন্তানদের জন্য।গত ৬মাসে একটি বারের জন্যও সন্তানের মুখের মা ডাক শুনতে পারেনি রাজিয়া।সুলতানার মোবাইল থেকে দেশে ফোন করার পর সন্তানের মুখে 'মা' ড়াক শুনে খুশিতে আলোকিত রাজিয়ার মুখ মূহর্ত্বেই দখল করল বিষন্নতা।কারণ,'কখন টাকা পাঠাবে মা?' সন্তানের এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজিয়া কিছুই বলতে পারেনি।
বাসা বাড়িতে যেসব বাংলাদেশী নারীরা যারাই কাজ করছে তাদের ১০০ ভাগই ট্রাভেল এজেন্সী আর দালালদের মিথ্যাচারের শিকার ।দেশ থেকে পাঠানোর আগে তাদের কাউকে বলা হয় হাসপাতালের ভিসা,কাউকে বলা হয় বিউটিপার্লার ,কাউকে বলা হয় মালিকের বাচ্ছাদের দেখা শোনা ,ঘর গোছানো,ইত্যাদি।বেতন ৭০০-১০০০রিয়াল।কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে বাসা বাড়িতে যেসব নারী শ্রমিকেরা কাজ করছে তারা ৪০০-৬০০রিয়ালের বেশী পাচ্ছেনা। বাসায় যেসব বাংলাদেশী খাদ্দামার আছে তাদের সব কাজই করতে হয় ।ফজরের নামাজের পর শুরু হয় তাদের কাজ।চলে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত।সপ্তাহের ৭দিনই বাসায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের কাজ করতে হয়।একটু ভুল হলেই চলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি,কিল-গুসি।প্রায় ৬০ভাগ খাদ্দামাকেই রাতে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।কোন কোন রাতে কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি ক্লান্ত দেহের উপর।এতসব কিছুর পরও মাস শেষে ৪০০-৬০০ রিয়ালও অনেকের ভাগ্যে জুটেনা।মাস শেষ হলে কারু ভাগ্যে বেতন জুটে কারু ভাগ্যে ৬মাসেও বেতন জুটেনা।অনেককে ২-৩বছর খাটিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে একদম খালি হাতে।বাংলাদেশ দূতাবাসে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়না।দূতাবাসের কর্তাবাবুদের বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়না।পাওয়া গেলেও অভিযোগ না নিয়ে ছয়-নয় বুঝিয়ে দিয়ে ফোন রেখে দেয়।কেউ যদি বারবার ফোন করে তাহলে তাকে বলা হয় লিখিত অভিযোগ দিতে।কিন্তু অভিযোগ দিবে কোথায়?রিয়াদ আর জেদ্দা ছাড়া সৌদি আরবের অন্য কোন বিভাগে বাংলাদেশ দুতাবাসের কোন শাখা নেই।অথচ সৌদি আরবের বিভিন্ন শহর উপশহরে ছড়িয়ে আছে ২০ লক্ষেরও বেশী নারী-পুরুষ শ্রমিক।এমনও শহর আছে যেসব শহর থেকে রিয়াদ,জেদ্দার দুরত্ব ২হাজার মাইলেরও বেশী।রিয়াদ আর জেদ্দা অফিসের নাম্বারে ১০০বার করলেও দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়না।জেদ্দাস্থ অফিসের সাথে অনেক চেষ্টা করে সংযোগ পাওয়ার পর কর্মরত একজন অফিসার কোন তথ্য দিতে অস্বীকার করে নিজের চরকায় তেল দেওয়ার উপদেশ দেয়।নারী শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবেদনের কথা বিস্তারিত বলায় কোন তথ্য না দিয়ে উল্টো অভিযোগ করে বসল প্রচন্ড জনবল সংকটে ভুগছে জেদ্দাস্থ দুতাবাস অফিস।তার ওপর আছে ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে আগের সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারী চাঁটাই।দলীয় লোক নিয়োগের ফলে অভিজ্ঞদের জায়গায় এখন অনেক নুতুন মুখ।অভিযোগের পর অভিযোগ জমা হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের চাইতে দলীয় ঘরোয়া আলোচনা সভায় বেশী সময় দিচ্ছে দলীয় যোগ্যতাই নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা।বারবার অনুরুধ করা সত্ত্বেও কাগজে কলমে কত হাজার নারী শ্রমিক বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছে সে তথ্যটাও জানা যায়নি।
বর্তমানে কর্মরতদের কাছ থেকে কোন তথ্য না পেয়ে কয়েকদিন আগে চাকরী হারানো এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে পরিচয় আর বর্তমান অবস্থান গোপন করার শর্তে কথা বলতে রাজী হয়।প্রায় দেড় বছর আগে নিয়োগ পাওয়া 'দ' আদ্যক্ষরের এক কমকর্তা চাকরি হারায় বর্তমান সরকারের দলীয় নিয়োগের জোয়ারে।চাকরী হারানো কর্মকর্তা বারবার নাম,পরিচয় আর অবস্থান প্রকাশ না করার অনুরুধ করে জানায় প্রতিদিন নারী শ্রমিকদের যেসব অভিযোগ জমা হয়েছিল কর্মরত অবস্থায় তার ৩০ভাগই যৌন হয়রানির,৩৫ভাগ বেতন না পাওয়া। বাকী ২৫ভাগের মধ্যে আছে দেশে যেতে না দেওয়া,অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো ইত্যাদি।'দ' আদ্যক্ষরের কর্মকর্তা আরো জানান বাংলাদেশী কোন হাউস কিপারের ভিসা দুতাবাস ইস্যু না করলেও অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশী নারীদের এখনো পাঠানো হচ্ছে বাসা-বাড়ির কাজের জন্য।বিষ্ময়কর তথ্য হচ্ছে,দেশের অধিকাংশ ট্রাভেল এজেন্সী পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সীর মাধ্যমে বাংলাদেশী নারীদের ভারতীয় পাসপোর্ট দিয়ে সৌদি আরব পাঠাচ্ছে।তেমনই একজন নারী শ্রমিক সামিনা আক্তার।সামিনা আক্তার কে প্রথমে পাঠানো হয় ভারতে ।তারপর সেখানে ১৭দিন রেখে সামিনার নাম বদলে রত্না নাম দিয়ে পাঠানো হয় সৌদি আরব।অনেক অনুরুধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সী আর পাশ্ববর্তী ট্রাভেল এজেন্সীর নাম জানায়নি সামিনা ওরফে রত্না।মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সামিনা নুতুন কোন ঝামেলায় জড়াতে রাজী নয়।
নারী শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবেদনটি করতে গিয়ে যাদের সাথে কথা হয়েছে তাদের অন্যতম দাবী হচ্ছে ফিলিফাইন,ইন্দোনেশী,ইন্ডিয়ান নারী শ্রমিকেরা যেসব সুযোগ-সুবিদা পাচ্ছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্যও তা নিশ্চিত করা।ফিলিপাইন,ইন্ডিয়ান,ইন্দোনেশী নারী শ্রমিকদের মত বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিক পদক্ষেপ নিবে এবং ট্রাভেল এজেন্সীগুলোর প্রতারনা বন্ধে ট্রাভেল এজেন্সীগুলোর কর্মকান্ড গভীর ভাবে মনিটর করবে এমনটাই নারী শ্রমিকদের কামনা।
--------------------------------------------------------------------------------
।প্রতিবেদনটি আজকের আমার দেশে Click This Link
প্রকাশিত।কিছু কারণে প্রতিবেদনটির কিছু অংশ আমার দেশের প্রতিবেদন থেকে বাদ দিতে হয়েছে।কিন্তু ব্লগে সম্পর্ন দেওয়া হল।প্রতিবেদনটির সূম্পর্ন দায়ভার আমার।
২য়বারের মত প্রতিবেদনটি দৈনিক যুগান্তরে সূম্পর্ন প্রকাশিত Click This Link