somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চট্টগ্রামী ভাষায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মেইট্টাল’ এর ভূমিকা: কাফি কামাল

১০ ই মার্চ, ২০১১ রাত ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রাচীন হরিকেল আর লুপ্ত আরাকানের উত্তর-পশ্চিমাংশই চট্টগ্রাম। আর এ অঞ্চলের বর্ণমালাহীন অথচ স্বতন্ত্র ভাষাটিই চট্টগ্রামী। পুরাকাল থেকেই চট্টগ্রামে আগমন ঘটেছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর। সঙ্গত কারণেই সেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে চট্টগ্রামী ভাষায়। আর তাতে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে এ ভাষা। পণ্ডিতদের মতে, চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম প্রবেশ করে পালি ভাষা। তারপর পারস্পরিক স্থানান্তরের ফলে আরাকানি মঘী ভাষা। সুদূর কাল থেকেই বাণিজ্যিক কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আরব্য নাবিকের আনাগোনা ছিল। কারও কারও মতে, এখানে তাদের উল্লেখযোগ্য বসতি গড়ে ওঠা এবং পরে মোগল আমলে ধর্মীয় ও দাপ্তরিক কারণে আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। কিছুকাল পর্তুগিজদের অধিকারে থাকায় পর্তুগিজ এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ আমলে ঘটে ইংরেজির অনুপ্রবেশ। মাঝপথে বিভিন্ন সময় প্রাকৃত, অহমিয়া সহ মঙ্গোলয়েড নানা প্রান্তিক জাতি-গোষ্ঠীর শব্দও। এভাবে বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে সংযোগের কারণে যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে বহু অর্বাচিন শব্দও। এছাড়া চট্টগ্রাম কখনও ভারতের অধিকারে না থাকলেও চট্টগ্রামী ভাষায় হিন্দীর প্রভাবও বেশ লণীয়। বৈদিক ভাষার সঙ্গেও রয়েছে চট্টগ্রামীর মিল। তবে চট্টগ্রামী উপভাষা কোনভাবেই মান বাংলার আঞ্চলিক রূপ নয়। শিশির ভট্টাচার্য্যরে মতে, চট্টগ্রামী উপভাষা ও মান বাংলার মধ্যে ব্যাকরণগত এবং শব্দকোষগত মিল থাকলেও উভয় উপভাষার উৎপত্তি চর্যাপদের যুগ বা পরবর্তি কোন যুগে প্রচলিত আলাদা দুটি উপভাষা থেকে। পুরাকালের সেই দু’টি উপভাষার মধ্যে শব্দকোষগত ও ব্যাকরণগত মিলের কারণেই আজকের মান বাংলা আর চট্টগ্রামীর মিল। তবে মনসুর মুসার মতে, বাংলাভাষার সবচেয়ে দূরবর্তী উপভাষাটিই চট্টগ্রামী। পণ্ডিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতে, চট্টগ্রামী একটি মিশ্রভাষা। এ নিয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরী, আবুল ফজল, ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো সহ অনেক ভাষাবিদই পরস্পরবিরোধী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যা হোক, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মিয়ানমানের উত্তর-পশ্চিমাংশ, আরাকান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষায় রয়েছে চট্টগ্রামীর বিরাট প্রভাব। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিমত, উচ্চারণ সহজীকরণ তথা সংপেণ এখানকার লোকদের একটা স্বভাব। কিছু কিছু পণ্ডিত এটাকে উচ্চারণের কোমলীকরণ বলেও মত দিয়েছেন। যথা, ক বর্ণটি চট্টগ্রামের মানুষ প্রায়ই কোমল বা স্বল্পপ্রাণ হ-এর মতো করে উচ্চারণ করে। চট্টগ্রামী ভাষায় পদমধ্যবর্তী ‘ম’ আনুনাসিক হয়। যথা- আঁই (আমি), আঁর (আমার), তুঁই (তোমার), কুঁআর (কুমার), ছঁই (শিম)। উল্লেখ্য, এ বইয়ে আনুনাসিকের জন্য চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া পদমধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায়ই লোপ বা বিকৃত (আসলে কোমল) হয়। যেমন- মিডা (মিঠা), ডাই (ডাকিয়া), বুগ (বুক), জইদার (জমিদার) ইত্যাদি। পূর্ণবিকৃতিও কম নয়। যেমন- এ্যাত্তে (তখন)। পণ্ডিতরা বলেছেন, অহমিয়া ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামী ভাষার ধ্বনি ও রূপতত্ত্বে কিছু কিছু মিল দেখা যায়। ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ ‘ঘ’, ‘ধ’, ‘ভ’ প্রভৃতি এবং আদি ‘হ’ রতি আছে। রূপতত্ত্ব একবচনে ‘র’, যেমন- হাতর, ঘরর ইত্যাদি। অধিকরণের এক বচনে ‘ত’ বিভক্তি যথা- বাড়িত্ (বাড়িতে), ঘরত্ (ঘরেতে)। নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’ ক্রিয়ার পূর্বে বসে যথা- ন গেল (গেল না), ন আছিল (ছিল না), ন বুঝি (বুঝি না) ইত্যাদি। চট্টগ্রামী ভাষায় ক ও খ, প ও দ উচ্চারণে একটু বৈচিত্র্য আছে। ক খ-এর মতোই উচ্চারিত হবে কিন্তু তেমন জোর পড়বে না। যেমন ‘ক অত্তে’ প্রকৃত উচ্চারণ ‘হ অত্তে’, ‘ড়’-এর উচ্চারণ ‘র’-এর মতো। অনেক সময় ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করা হয়। আবার পরুয়া (পরশু) এখানে ‘প’ ও ‘ফ’-এর মতো উচ্চারিত হবে অথচ ‘ফ’-এর মতো জোর পড়বে না। ঊর্ধ্বকমা (’) ব্যবহৃত শব্দগুলো পড়ার সময় (’)’র পরের বর্ণটিতে জোর দিতে হবে। উর্ধ্বকমাকে অর্থভেদে অ/আ/ই হিসেবে পড়তে হবে। আবার চট্টগ্রামী ভাষার রয়েছে একাধিক রূপ। বৃহত্তর অর্থে ভাগ করলে চট্টগ্রামী ভাষা চার ভাগে বিভক্ত। ক. চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পূর্ব থেকে কর্ণফুলীর পশ্চিমতীর হয়ে শহরের উত্তর-পূর্বাংশের ভাষা, খ. শহরের দণিাংশ থেকে কর্ণফুলী পেরিয়ে মাথামুহুরীর উত্তরতীরের ভাষা, গ. মাথামুহুরীর দণিতীর থেকে কক্সবাজারের ভাষা ও ঘ. চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পশ্চিমের সমুদ্রতীর ধরে শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশের ভাষা। এর মধ্যে (ঘ) অংশটি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার বিশাল প্রভাব রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামে ভাষাগতভাবে তাদের থার্টি ফাইভ-সিক্সটি ফাইভ বলে মন্তব্য করা হয়। অন্যদিকে (গ) অংশের ভাষায় রয়েছে আরাকানি ভাষার বিশাল প্রভাব। ক ও খ অংশ দুটির ভাষা তুলনামুলক নিজস্ব। তবে এ দুই ভাষার মধ্যেও রয়েছে দৃশ্যমান ফারাক। যেমন- ক. অংশে জ-এর ব্যবহার (কুইজ্জা, দইজ্জা) ও খ. অংশে গ-এর ব্যবহার (কুইরগা, দইরগা) পরিস্কার একটি ভেদরেখা টেনে দিয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের হিন্দু-বৌদ্ধদের ভাষারও কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মোটা দাগে চট্টগ্রামী ভাষাকে রোয়াই-চাডি¹ানাই দুইভাগেও ভাগ করা হয়। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামী ভাষার উচ্চারণ বিশ্লেষণ রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। তবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের যে কোন অংশের লোকজন সহজে এবং স্বতস্ফূর্তভাবেই অন্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাতে পারেন। ‘মেইট্টাল’ চট্টগ্রামীভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ গল্পগ্রন্থ। গল্পগুলো মূলত (খ অংশের) বা দণি চট্টগ্রামী ধারায় লেখা। তবে চট্টগ্রামী ভাষার অন্য ধারার লোকজনও গল্পগুলো বুঝতে পারবেন। চট্টগ্রামী ভাষার লিখিত রূপ না থাকা ও উচ্চারণ জটিলতার কারণে পাঠ কিছু কঠিন হবে। এ ছাড়া কিছু চট্টগ্রামী শব্দ বানানের প্রয়োজনীয় বর্ণও পাওয়া যায়নি বাংলা বর্ণমালায়। যা বিকল্প বানানে লেখা হয়েছে। যেমন- পেউরগা (মাটি কাটার ঝুড়ি), ভোউট্টা (ভোটটি)। সব মিলিয়ে যৌক্তিক কারণেই কিছু বানান ত্র“টি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে পাঠকের সুবিধার্থে প্রতিটি গল্পের শেষে কিছু শব্দার্থ দেয়া হয়েছে। মান বাংলার ক্রমপ্রসারনে লুপ্তমুখী মৌখিক ভাষা চট্টগ্রামীকে কালের করাল গ্রাস থেকে আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ এবং বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এ ভাষার বৈচিত্র্য তুলে ধরার জন্যই আমার এ প্রচেষ্টা। চট্টগ্রামী ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকদের মাতৃভাষায় সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব চর্চায় আগ্রহী তুলতেও বৈকি। বইয়ের ‘কুর কুরাইন্না আঁসি’ গল্পটি দৈনিক মানবজমিনের ২০১০ ঈদ সংখ্যায় ও অন্যগল্পগুলো সামহোয়ারইন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের তাৎক্ষনিক নানা উৎসাহব্যাঞ্জক মন্তব্য আমাকে উদ্দীপ্ত ও বই প্রকাশ তরান্বিত করেছে।
কাফি কামাল
ফেব্রুয়ারি ২০১১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের জাতির কপালে শনি আছে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:১১



একাত্তরে যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে তারা বলেছে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না, সুতরাং ভারতের অধীন হওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের অধীন থাকা ভালো। তারা মনে করেছে অধীকাংশ নাগরিক তাদের দলে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৬

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

জুলাই আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতা ছিলেন না , তাকে কেউ চিনতো না কয়েক মাস আগে ও ।

জুলাই জংগীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদি ভাই, ইনসাফ এবং একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প

লিখেছেন গ্রু, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৮



ইদানিং একটা কথা খুব মনে পড়ে। হাদি ভাই।

মানুষটা নেই, কিন্তু তার কথাগুলো? ওগুলো যেন আগের চেয়েও বেশি করে কানে বাজে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি? ক্ষমতা? গদি? নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ৩০ দেশের দুষ্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদুত বদলায়ে দিচ্ছে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২৩



আইয়ুব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার পর, বাংগালীদের লাথি খেয়ে সরেছে; জিয়া, কর্নেল তাহের ও জাসদের গণ বাহিনী আমাদের দেশকে নরক (১৯৭৫ সাল ) বানিয়ে নিজেরা নরকে গেছে। আমাদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×