somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট্টবেলা, যত্ত খেলা

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডিমদৌড় দিয়ে শুরু করা যাক ।ভাবছেন ডিমদৌড়টা আবার কী? ডিম কি দৌড়াতে পারে নাকি !! তখন আমরা প্রথম শ্রেণীতে। জীবনের প্রথম ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’। আমরা এতই ছোট ছিলাম যে আমাদের ত্রীড়া শিক্ষক আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতার নাম দিয়ে দিলেন ডিমদৌড়। তো এবার শুনুন ডিমের কত বুদ্ধি। মাঠের দৈর্ঘ্য ডিমদের জন্য বেশ বড় বলে এটার অর্ধেক ট্র্যাক নেয়া হল। তো এক ডিমের মাথায় বুদ্ধি কিলবিল করত। সে ভাবল আমি যদি দৌড় দিয়ে পুরা মাঠ পাড় হতে পারি তাহলে তো আমিই ফার্স্ট হব। তো সে বাঁশিতে হুইসেল দেয়ার ঠিক পরপরই ট্র্যাকের পাশে দাঁড়ানো মানুষ ঠেলেঠূলে পাশ দিয়ে দৌড়িয়ে মাঠ পার করে দিল !!কি করবে ট্র্যাকের মাঝখানে যে মানুষ দাঁড়ানো (১ম, ২য়, ৩য় মার্ক করার জন্য বিচারকরা দাড়াত), এজন্যই পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল। পরে অবশ্য এই বুদ্ধিমান ডিম এত বীরত্বের পরও ১ম পুরস্কার না পাওয়ায় মায়ের কোলে বসে ভে ভে করে কেঁদেছিল।

স্কুলে অনেক রকম খেলা হত। সবচাইতে বেশী হত ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুট আর কুতকুত নামে একটা খেলা। কুতকুত খেলাটা অনেকেই হয়ত জানি। ওই যে টিভিতে আমাদের সাকিব ভাইকে ‘সামনে ঝুকে পিছনে জোড়ে’ নামে যে একটা খেলা শেখানো হয়। এই খেলাটা আমার খুব বিরক্ত লাগত। মানুষের ঠ্যাং কি একটা যে ব্যাঙ এর মত এক ঠ্যাং নিয়ে লাফাতে হবে। একদিন গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। কয়েকটা গ্রুপ এর কুতকুত খেলার গুটি নিয়ে ছূড়ে পুকুরে ফেলে দিলাম। দুস্টুগুলা গিয়ে এক শিক্ষকের কাছে বিচার দিল। গ্রামের স্কুলে যেকোন বিচারের শাস্তি বেত দিয়ে পিটানো এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও। তো শিক্ষক আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন তোমাকে দুইটা শাস্তি দিব। প্রথম শাস্তি হিসেবে বাম হাতে একটা বেতের বারি খেলাম। দ্বিতীয় শাস্তি হিসেবে বললেন তুমি যাদের গুটি ছোড়েছ তাদের জন্য নতুন গুটি খুঁজে আন। আমি ৪ গ্রুপের জন্য ৪ টা গুটি আনলাম। তখন শিক্ষক আমাকে বললেন, তুমি একবার কুতকুত খেলে বল তোমার কেমন লাগল।আমার মনে হয় তোমার ভাল লাগবে। আমি একবার খেলে চোখমুখ কুচকে বললাম, আমার ভাল লাগেনি। শিক্ষক ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন আচ্ছা বাবা, তোমার হয়ত ভাল লাগেনা, কিন্তু ওদেরতো ভাল লাগে। এই যে দেখ আমারও ভাল লাগে বলেই খেলা শুরু করার ভান করলেন। তারপর বললেন, তোমার কি খেলতে ভাল লাগে? আমি বললাম ক্রিকেট। তারপর কাছেই একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছিল ওদের দেখিয়ে বললেন, যাও তাহলে তুমি ক্রিকেট খেল। “যাদের যেটা ভাল লাগবে তারা সেটা খেলবে, তোমার যেটা ভাল লাগে তুমি সেটা খেল। অন্য কাওকে অসম্মান করাটা কি ঠিক?” আমি দৌড়ে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলাম।
এই শিক্ষকটি ছিলেন আমার মা যার মার আমি সেদিনের আগে ও পরে কখনো খাইনি। আর সেদিনের শিখা দৃষ্টিভঙ্গিটাও এখনো পাল্টায়নি।

ক্রিকেট খেলার নেশাটা ছিল খুব বেশী। স্কুলের পর বিকেলে বাড়ির পাশে খেলা হত। আমার শাসক গোষ্ঠীর প্রধানের (আমার দাদী) কড়া তত্তাবধান আর প্রো-প্রধানের হালকা পাতলা তত্তাবধানের পরও দুপুরের ঘুম-টুম বাদ দিয়ে খেলতে চলে যেতাম। তো ওখানে খেলার নিয়ম ছিল যাদের নিজেদের ব্যাট থাকত তারা বাড়তি কিছু সুবিধা পেত। যেমন, অন্যরা একবার ব্যাট করলে তারা দুইবার সুযোগ পেত, অন্যরা টানা ফিল্ডিং দিলেও তারা মাঝে মাঝে রেস্ট পেত, এরকম। এক কথায় তারা ছিল এলিট শ্রেণির। তো আমি বাবাকে বললাম ব্যাট কিনে আনতে। কিন্তু আমার শাসক শ্রেণীর প্রধান, আর প্রো-প্রধানের ‘খেলার কারনে ছেলের শিক্ষাজীবন ধংসের দোড় গোড়া থেকে রক্ষা’ কল্পে কি মিটিং হয়েছিল জানিনা। আমার বাবা সুন্দর একটা ব্যাট কিনে আনলেন আর আমি সগৌরবে এলিট ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে বের হলাম। বাঘ যেমন শিকারের উপর ঝাপিয়ে পরার আগে লেজ দিয়ে মাটিতে বারি দেয়, আমিও আমার নতুন কেনা ব্যাট দিয়ে বিশাল ছক্কা মারার আগে মাটিতে বারি মারলাম। ব্যাট দুই টুকরা হয়ে গেল। সবাই খেক খেক করে হাসছে। বদ মাসুমটাও হাসছে। বেটার ব্যাট কাঠ থেকে কেটে বানানো, হাত দিয়ে ধরলে হাতে কাঠের আশ বিঁধে যাওয়ার অবস্থা হয়। সেও হাসছে। লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না। সেদিনের পর কিছুদিন আর খেলতে যাইনি। এলিট ছাড়া অন্য কোন অবস্থান ভাল লাগেনা। তাছাড়া লজ্জাও পেয়েছি। তো আব্বুকে বললাম আরেকটা নতুন ব্যাট কিনে আনতে। কয়েকদিন পর তাও কিনে দেয়া হল। ৩ দিন পর ওইটারও একি অবস্থা হল। কি আর করা! আমারইতো দোষ। বাঘের মত মাটিতে বারি মারতে গিয়েই তো ভাঙ্গে। বাবাতো ভাল দেখেই কিনে দেন। এরপর আর অনেক দিন যাইনি। শাসক কমিটির ষড়যন্ত্র সফল হল।

কিন্তু কিছুদিন পর মাথায় আসল, মাসুমের ব্যাট কাঠ কেটে বানানো ওইটা ভাঙ্গেনা, আমারটা বারবার ভাঙ্গে কেন (আগেও টিউব লাইট ছিলাম এখনি আছি..:P). ছোটবেলাসহ আমার সব সময় এর সুখ-দুঃখের সথী ছোট চাচাকে বললাম, গাছ থেকে ভাল কাঠ কেটে ব্যাট বানিয়ে দিতে। শাসক কমিটির ষড়যন্ত্র চাচা সব সময়ই জানতেন আর আমাকে গোপনে-প্রকাশ্যে যখন যেভাবে পারতেন সহযোগীতা করতেন। চাচা শক্ত কাঠ দিয়ে মেশিন দিয়ে কেটে ভাল ব্যাট বানিয়ে দিলেন যাতে হাতে ব্যাথা না পাই। তারপর ওই ব্যাট দিয়ে অনেকদিন খেলেছিলাম।..:)

হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যেন নতুন এক জগত পেলাম। বছরের প্রথম দিকে ক্লাস তেমন হতনা। একটা ক্লাসের পরই আমাদের স্পোর্টস শিক্ষকের বাঁশির আওয়াজ শুনে আমরা লাফিয়ে মাঠে যেতাম। বিশাল মাঠ, কত মানুষ, কত রকমের নতুন খেলা !! কয়েক রকমের দৌড়, লং আর হাই জাম্প, গোলা নিক্ষেপ, ভলিবল ইত্যাদি। সবই হত জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে হওয়া ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’র প্রস্তুতি হিসেবে।একমাস পর হল ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’। স্কুল সুন্দর করে সাজানো হল, অনেক অতিথি, দুরু দুরু বুকে একেকটা ইভেন্ট এ অংশ নেয়া। দৌড়ের ট্র্যাক এ দঁড়িয়ে যখন দেখতাম দাদী আর ছোট চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে, চিৎকার করে সাহস দিচ্ছে নিজের সাহস আর শক্তি ছোটখাট জেট ইঙ্গিনের সমান মনে হত…:P…একবার তো লং জাম্প এ নিজের থুতনীর সাথে হাটু লেগে দুইটা দাতের উপরের অংশ ভেঙ্গে গিয়েছিল…:P প্রতিযোগিতার প্রথম পর্বে ছোট গ্রপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ৭ম শ্রেণীতেও চ্যাম্পিয়ন। পুরস্কার দিত জগ, থালা-বাটি এসব। মনে মনে বলতাম স্যারগুলা এরকম ক্ষ্যাত মার্কা কেন? এগুলা কেও পুরস্কার দেয় !! খালি চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পাওয়া ব্রোঞ্চ ম্যাডেলটাকে আপন মনে হত। জগ-থালা-বাটি দাদী সগৌরবে সংসারের কাজে লাগিয়ে দিয়ে নাক-চোক-মুখ ফুলিয়ে যখন বলতেন, এগুলা আমার নাতীর পুরস্কার, আমি মরার আগে আমার নাতীকে সফল দেখে যেতে চাই, তখন অবশ্য জগ-থালা-বাটিগুলাকে খুব বড় মনে হত।
(আমার এই প্রিয় বন্ধুটি আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার পর মারা যান যার নাতী এখনো সফলতার পিছনে হণ্যে হয়ে ঘুরছে)

৮ম শ্রেণীতে চ্যাম্পিয়ন তো দুরের কথা কিছুই পেলাম না..:P..রাস্তায় ছোট চাচার হাত ধরে হাটছি, মুখ হাসি হাসি। চাচা কনফিউজড হয়ে বললেন, কি বাবা কিছু পাওনি বলে মন খারাপ হয়েছে? আমি হাসিমিখে বললাম, নাহ। কালকেই তো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ওখানে তো শিউর একটা পাচ্ছি (ক্লাসে ১ম স্থানের জন্য্ন এই পুরস্কার প্রতি বছর দেয়া হয়..:P). ছোট চাচা পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, that’s the spirit. আজকের জন্য মন খা্রাপ করে কি লাভ। বরং কলকের জন্য খুশী হও……দূর্ভাগ্য ছোটবেলার সেই Spirit টা এখন মনে হয় আর নাই। সবকিছু সহজভাবে নিতে পারিনা..:(

ওই বছরই আমি ঢাকা চলে আসি; এরপর ওই স্কুলের মাঠে একবার গি্যেছিলাম, মাঠের মাঝখানে কিছু গরু ছাড়া কেউ ছিলনা। মাঠেও আর তেমন নামা হয়না খেলার জন্য, বুয়েট মাঠে গিয়ে নিজেকে কখনো কখনো মাঠের এলিয়েন মনে হয়। ৪ বছর পর এক বাল্লবন্ধু যখন ফোন করে বলে, ”দোস্ত মাঠে এসেছি। আজকে বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা আমাদের স্কুলে। চলে আসনা। দিবা নাকি আরেকবার লং জাম্প” তখন মনে হয়-

“সময়টা আজ কেমন যেন, বড় হয়ে গেছি আমি”



সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:৪৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×