ডিমদৌড় দিয়ে শুরু করা যাক ।ভাবছেন ডিমদৌড়টা আবার কী? ডিম কি দৌড়াতে পারে নাকি !! তখন আমরা প্রথম শ্রেণীতে। জীবনের প্রথম ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’। আমরা এতই ছোট ছিলাম যে আমাদের ত্রীড়া শিক্ষক আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতার নাম দিয়ে দিলেন ডিমদৌড়। তো এবার শুনুন ডিমের কত বুদ্ধি। মাঠের দৈর্ঘ্য ডিমদের জন্য বেশ বড় বলে এটার অর্ধেক ট্র্যাক নেয়া হল। তো এক ডিমের মাথায় বুদ্ধি কিলবিল করত। সে ভাবল আমি যদি দৌড় দিয়ে পুরা মাঠ পাড় হতে পারি তাহলে তো আমিই ফার্স্ট হব। তো সে বাঁশিতে হুইসেল দেয়ার ঠিক পরপরই ট্র্যাকের পাশে দাঁড়ানো মানুষ ঠেলেঠূলে পাশ দিয়ে দৌড়িয়ে মাঠ পার করে দিল !!কি করবে ট্র্যাকের মাঝখানে যে মানুষ দাঁড়ানো (১ম, ২য়, ৩য় মার্ক করার জন্য বিচারকরা দাড়াত), এজন্যই পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল। পরে অবশ্য এই বুদ্ধিমান ডিম এত বীরত্বের পরও ১ম পুরস্কার না পাওয়ায় মায়ের কোলে বসে ভে ভে করে কেঁদেছিল।
স্কুলে অনেক রকম খেলা হত। সবচাইতে বেশী হত ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুট আর কুতকুত নামে একটা খেলা। কুতকুত খেলাটা অনেকেই হয়ত জানি। ওই যে টিভিতে আমাদের সাকিব ভাইকে ‘সামনে ঝুকে পিছনে জোড়ে’ নামে যে একটা খেলা শেখানো হয়। এই খেলাটা আমার খুব বিরক্ত লাগত। মানুষের ঠ্যাং কি একটা যে ব্যাঙ এর মত এক ঠ্যাং নিয়ে লাফাতে হবে। একদিন গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। কয়েকটা গ্রুপ এর কুতকুত খেলার গুটি নিয়ে ছূড়ে পুকুরে ফেলে দিলাম। দুস্টুগুলা গিয়ে এক শিক্ষকের কাছে বিচার দিল। গ্রামের স্কুলে যেকোন বিচারের শাস্তি বেত দিয়ে পিটানো এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও। তো শিক্ষক আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন তোমাকে দুইটা শাস্তি দিব। প্রথম শাস্তি হিসেবে বাম হাতে একটা বেতের বারি খেলাম। দ্বিতীয় শাস্তি হিসেবে বললেন তুমি যাদের গুটি ছোড়েছ তাদের জন্য নতুন গুটি খুঁজে আন। আমি ৪ গ্রুপের জন্য ৪ টা গুটি আনলাম। তখন শিক্ষক আমাকে বললেন, তুমি একবার কুতকুত খেলে বল তোমার কেমন লাগল।আমার মনে হয় তোমার ভাল লাগবে। আমি একবার খেলে চোখমুখ কুচকে বললাম, আমার ভাল লাগেনি। শিক্ষক ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন আচ্ছা বাবা, তোমার হয়ত ভাল লাগেনা, কিন্তু ওদেরতো ভাল লাগে। এই যে দেখ আমারও ভাল লাগে বলেই খেলা শুরু করার ভান করলেন। তারপর বললেন, তোমার কি খেলতে ভাল লাগে? আমি বললাম ক্রিকেট। তারপর কাছেই একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছিল ওদের দেখিয়ে বললেন, যাও তাহলে তুমি ক্রিকেট খেল। “যাদের যেটা ভাল লাগবে তারা সেটা খেলবে, তোমার যেটা ভাল লাগে তুমি সেটা খেল। অন্য কাওকে অসম্মান করাটা কি ঠিক?” আমি দৌড়ে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলাম।
এই শিক্ষকটি ছিলেন আমার মা যার মার আমি সেদিনের আগে ও পরে কখনো খাইনি। আর সেদিনের শিখা দৃষ্টিভঙ্গিটাও এখনো পাল্টায়নি।
ক্রিকেট খেলার নেশাটা ছিল খুব বেশী। স্কুলের পর বিকেলে বাড়ির পাশে খেলা হত। আমার শাসক গোষ্ঠীর প্রধানের (আমার দাদী) কড়া তত্তাবধান আর প্রো-প্রধানের হালকা পাতলা তত্তাবধানের পরও দুপুরের ঘুম-টুম বাদ দিয়ে খেলতে চলে যেতাম। তো ওখানে খেলার নিয়ম ছিল যাদের নিজেদের ব্যাট থাকত তারা বাড়তি কিছু সুবিধা পেত। যেমন, অন্যরা একবার ব্যাট করলে তারা দুইবার সুযোগ পেত, অন্যরা টানা ফিল্ডিং দিলেও তারা মাঝে মাঝে রেস্ট পেত, এরকম। এক কথায় তারা ছিল এলিট শ্রেণির। তো আমি বাবাকে বললাম ব্যাট কিনে আনতে। কিন্তু আমার শাসক শ্রেণীর প্রধান, আর প্রো-প্রধানের ‘খেলার কারনে ছেলের শিক্ষাজীবন ধংসের দোড় গোড়া থেকে রক্ষা’ কল্পে কি মিটিং হয়েছিল জানিনা। আমার বাবা সুন্দর একটা ব্যাট কিনে আনলেন আর আমি সগৌরবে এলিট ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে বের হলাম। বাঘ যেমন শিকারের উপর ঝাপিয়ে পরার আগে লেজ দিয়ে মাটিতে বারি দেয়, আমিও আমার নতুন কেনা ব্যাট দিয়ে বিশাল ছক্কা মারার আগে মাটিতে বারি মারলাম। ব্যাট দুই টুকরা হয়ে গেল। সবাই খেক খেক করে হাসছে। বদ মাসুমটাও হাসছে। বেটার ব্যাট কাঠ থেকে কেটে বানানো, হাত দিয়ে ধরলে হাতে কাঠের আশ বিঁধে যাওয়ার অবস্থা হয়। সেও হাসছে। লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না। সেদিনের পর কিছুদিন আর খেলতে যাইনি। এলিট ছাড়া অন্য কোন অবস্থান ভাল লাগেনা। তাছাড়া লজ্জাও পেয়েছি। তো আব্বুকে বললাম আরেকটা নতুন ব্যাট কিনে আনতে। কয়েকদিন পর তাও কিনে দেয়া হল। ৩ দিন পর ওইটারও একি অবস্থা হল। কি আর করা! আমারইতো দোষ। বাঘের মত মাটিতে বারি মারতে গিয়েই তো ভাঙ্গে। বাবাতো ভাল দেখেই কিনে দেন। এরপর আর অনেক দিন যাইনি। শাসক কমিটির ষড়যন্ত্র সফল হল।
কিন্তু কিছুদিন পর মাথায় আসল, মাসুমের ব্যাট কাঠ কেটে বানানো ওইটা ভাঙ্গেনা, আমারটা বারবার ভাঙ্গে কেন (আগেও টিউব লাইট ছিলাম এখনি আছি..
হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যেন নতুন এক জগত পেলাম। বছরের প্রথম দিকে ক্লাস তেমন হতনা। একটা ক্লাসের পরই আমাদের স্পোর্টস শিক্ষকের বাঁশির আওয়াজ শুনে আমরা লাফিয়ে মাঠে যেতাম। বিশাল মাঠ, কত মানুষ, কত রকমের নতুন খেলা !! কয়েক রকমের দৌড়, লং আর হাই জাম্প, গোলা নিক্ষেপ, ভলিবল ইত্যাদি। সবই হত জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে হওয়া ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’র প্রস্তুতি হিসেবে।একমাস পর হল ‘বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা’। স্কুল সুন্দর করে সাজানো হল, অনেক অতিথি, দুরু দুরু বুকে একেকটা ইভেন্ট এ অংশ নেয়া। দৌড়ের ট্র্যাক এ দঁড়িয়ে যখন দেখতাম দাদী আর ছোট চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে, চিৎকার করে সাহস দিচ্ছে নিজের সাহস আর শক্তি ছোটখাট জেট ইঙ্গিনের সমান মনে হত…
(আমার এই প্রিয় বন্ধুটি আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার পর মারা যান যার নাতী এখনো সফলতার পিছনে হণ্যে হয়ে ঘুরছে)
৮ম শ্রেণীতে চ্যাম্পিয়ন তো দুরের কথা কিছুই পেলাম না..
ওই বছরই আমি ঢাকা চলে আসি; এরপর ওই স্কুলের মাঠে একবার গি্যেছিলাম, মাঠের মাঝখানে কিছু গরু ছাড়া কেউ ছিলনা। মাঠেও আর তেমন নামা হয়না খেলার জন্য, বুয়েট মাঠে গিয়ে নিজেকে কখনো কখনো মাঠের এলিয়েন মনে হয়। ৪ বছর পর এক বাল্লবন্ধু যখন ফোন করে বলে, ”দোস্ত মাঠে এসেছি। আজকে বার্ষিক ত্রীড়া প্রতিযোগীতা আমাদের স্কুলে। চলে আসনা। দিবা নাকি আরেকবার লং জাম্প” তখন মনে হয়-
“সময়টা আজ কেমন যেন, বড় হয়ে গেছি আমি”
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





