১৮-ই মার্চ,২০১২, রবিবার। মীরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ। এশিয়া কাপের পঞ্চম ম্যাচ। অথচ নড়েচড়ে বসেছি আমরা বাংলাদেশীরা। সমীকরণটা এমন যে যদি পাকিস্তান জিতে তাহলে বাংলাদেশ সরাসরি ফাইনালে, আর যদি ইন্ডিয়া জিতে তাহলে আমাদের পরের ম্যাচে জিততে হবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আমার সারা ক্রিকেট জীবনে পাকিস্তানের সাথে যাদের ই খেলা পড়েছে সবসময় চেয়েছি পাকিস্তান হারুক। এদের হারতে দেখলে ৭১ এ আমার পূর্বসুরীরা যেরকম আনন্দ পেয়েছিল তেমন আনন্দ পাই। আর এখানে যেহেতু আমাদের শ্রীলঙ্কার সাথে সুযোগ আছে তাই এই ম্যাচে কে হারল জিতল তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা নিজেদের যোগ্যতাতেই ফাইনালে যাব, অন্তত পাকিস্তানের সহযোগীতায় না। বাংলাদেশ ফাইনালে গিয়েছিল, বীরদর্পে পরের ম্যাচ এ শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে।
২২ মার্চ দিবা-রাত্রির ফাইনাল ম্যাচ। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান। মাঠে গিয়ে দেখার জন্য অনেক খুঁজেও টিকেট পেলাম না। ইচ্ছা হল নিজেরাই বুয়েট ক্যাফের সামনে বড় স্ক্রিন এ খেলা দেখার ব্যাবস্হ্যা করব। খেলা শুরু ২ টায়। অনেকখানি সময় হাতে নিয়ে সামিন ভাইয়া, ফারিগ ভাইয়া, সাগর, সিরাত, শিব্বীরসহ বন্ধুরা মিলে কাজ শুরু করলাম। সামিন ভাইয়া আর ফারিগ ভাইয়া সেদিন প্রজেক্টরের স্ক্রীন এর জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ী করেছেন। শেষ পর্যন্ত স্ক্রীন না পেয়ে ব্যানার এর সাদা কাপড়ের ব্যাবস্হা হল। ক্যাফে তে ডিশ ছিল না। বিটিভি তে এই সিরিজ দেখিয়েছিল। তাই একটা এন্টেনা হলেই চলে। চানখারপুল আর স্টেডিয়াম দৌড়াদৌড়ি করে এন্টেনার ব্যাবস্হা হল। প্রজেক্টর বসানো হল অডিটরিয়াম এর সামনে। আরেক সমস্যায় দেখা গেল। অডিটরিয়াম বন্ধ আর ক্যাফে থেকে অডিটোরিয়াম অনেকখানি দূর। বাড়তি পাওয়ার ক্যাবল বানিয়ে আনা হল। তাও হল না। পড়ে হল থেকে বন্ধুদের মাল্টিপ্লাগ এনে জোড়াতালি দিয়ে পাওয়ার পাওয়া গেল। পড়ে অবশ্য অডিটোরিয়াম থেকেই পাওয়ার পাওয়া গিয়েছিল। হল থেকে আনা হল তাসনিম এর পিসি। অনেক দৌড়ঝাপ এর পর খেলা দেখা শুরু হল।
খেলার শুরুতেই মাশরাফী আর নাজমুলের হাত থেকে আগুন ঝড়ছে। এরপর রাজ্জাক আর সাকিবের কোনঠাসা করা বোলিং। কখনই বাংলাদেশকে মনে হয়নি তারা পিছিয়ে আছে। শুধু শেষ ওভারটিতে নো-ফ্রিহিট মিলিয়ে শাহাদাতের ১৮ রানের ওভারটি গলার কাটা হয়ে বিধে রইল। তারপরো ২১৮ রানের টার্গেটটা নতুন চেনা বাংলাদেশ এর কাছে নেহাতই ছোট মনে হচ্ছিল। ইনিংসের শুরুতে তামিমের ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং এ মনেই হচ্ছিল ঠিক পথেই আছি আমরা যদিও অপর প্রান্তে নাজিমুদ্দিনকে বেশী ই ঠান্ডা মনে হচ্ছিল, মোটামোটি বরফ-৫২ বলে ১৬ রান। ৬০ রানে হঠাত তামিমের বিদায়ে কিছুটা বাজ পড়লেও পরে সাকিব আর নাসিরের ব্যাটিং এ আমরা আবার জেগে উঠলাম। জয়টাকে নিছক এ যখন সময় এর ব্যাপার মনে হচ্ছিল ঠিক ওখান থেকেই সাকিব-নাসিরের বিদায়। শেষদিকে মাশরাফি এসে ৯ বলে ১৮ রানের ইনিংস খেলে আবারো জয়টাকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসল।
অডিটোরিয়ামের সামনে তখন এক ঘোড় লাগা পরিবেশ। ঘোড় বললে ভুল হবে আসলে, আমরা সবাই তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। দাঁড়িয়ে আছি না বসে আছি না শুয়ে আছি মাথায় কিছু নাই। মাথা সব ফাঁকা। হাতের নখ কোথায় যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নাই। অসংখ্যবার দোয়া পড়েছি। শেষ ওভারে ৬ বলে দরকার ৯ রান। ক্রিজে মাহমুদুল্লাহ আর রাজ্জাক। মাহমুদুল্লাহ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান আর রাজ্জাক বোলার যিনি মাঝে মাঝে চোখ বুজে ছয় মারেন। এই রান কিছুই না।
না শেষ পর্যন্ত জিতিনি আমরা। মহাকাব্বিক শেষ ওভারের শেষ দুই বলে দরকার ছিল ৪ রান। ওভারের পঞ্ছম বলে রাজ্জাক আউট হয়ে এটাকে ১ বলে ৪ রানের সমীকরনে নিয়ে গেলেন। শেষ স্ট্রাইক এ শাহাদাত। লেগ বাই ১ নিয়েছিল আর আমরা হেরেছিলাম ২ রানে। অডিটোরিয়ামের সামনে তখন আমার সবচাইতে শক্ত বন্ধুটির চোখ পানিতে চিকচিক করছে, কারও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, ফুটবল পাগল বন্ধুটি প্রথমবারের মত খেলা দেখতে এসেছে আর খেলা শেষ এ কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে, কেউ বসে পড়েছে, কারও মুখ দিয়ে কোন কথা বেড় হচ্ছে না।
আমরা বাঙ্গালীরা আবেগী। আমরা ক্রিকেট খাই, ক্রিকেট দাই, ক্রিকেটে ঘুমাই। ক্রিকেট আমাদের হাসায়-কাঁদায়, চিৎকার করতে শেখায়, আমাদের স্বপ্ন দেখায়, কখনো স্বপ্ন ভঙ্গের কারন হয়। আজকে হয়তো আমাদের ক্রিকেট এর আরেক ইতিহাস রচনা হবে। আজকেও আমরা আবেগী হয়ে যাব। ভালবাসায় আবেগ তো থাকবেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





