শুরুটা কাদের মোল্লার রায়ের পর। রায় মেনে নিতে না পেরে অনলাইন এই মানুষ তাদের অষন্তোস এর কথা জানায়। একে একে সবাই শাহবাগে জমায়েত হতে থাকে। শাহবাগের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। হঠাৎ খুন করা হল ব্লগার রাজীব কে। কেউ তাকে মাথায় তুলে নিয়ে নাচল, শহীদ বলে আপ্লুত হল, কেউবা নাস্তিক বলে গালি দিল। বিভাজনের শুরু এখান থেকেই। তারপর এ আন্দোলনের অনেক বাঁক পরিবর্তন, নানাভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ও তারপরে ছুড়ে ফেলা ইত্যাদি নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অন্য আর কি ফলাফল এসেছে সেদিকে না গিয়ে এ আন্দোলনের একটি বড় আর সবশেষ ফলাফল হচ্ছে হেফাজতে ইসলামী নামে একটি দল এসেছে যারা নাস্তিক ‘ব্লগারদের’ শাস্তি সহ ১৩ দফা দাবী নিয়ে এসেছে। দলটির ভাষায় বলতে গেলে এটি ‘ওলামায়ে কেরাম আর সাধারন ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের দল’।
শাহবাগের আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক এ সবগুলো ব্যাপার এর সাথে তথ্যপ্রযুক্তির কি কোন সম্পর্ক রয়েছে? অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে? কিছু দৃশ্যপট এর কথা বলছিঃ
দৃশ্যপট ০: ছোটবেলায় আমার দাদী আমার আরবী শেখার জন্য একজন হুজুর রেখে দেন। উনি আমাকে বাসায় এসে পড়ান। যে বাসায় পড়ানো হত সে রুম এ একটি টেলিভিশন ছিল। আমার হুজুর প্রায় ই আমার দাদীকে বলতেন ‘শয়তানের বাক্স’ টা সরান। তা না হলে আপনার নাতী কখনো মানুষ হবেনা।
দৃশ্যপট ১: জয়নাল মিয়া। তার নিজের পড়াশোনা পঞ্চম শ্রেণী। ৩ মেয়ে ২ ছেলে। কোন নির্দিষ্ট পেশা নেই তার। গ্রামের এক হোটেল এ মিস্টি বানান তিনি চুক্তি ভিত্তিতে। এতে কোনরকমে সংসার চলতে চায় না। ছেলের স্কুলে পড়াশোনার খরচ দিতে পারেন না। এলাকার এক মুরব্বি তাকে বললেন ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়ে দিতে। এতে আল্লাহর রাস্তায়ও তাকে দেয়া হল, খরচ সব মাদ্রাসায় বহন করবে। জয়নাল মিয়া নিজের বাড়ী থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের এক মাদ্রাসায় ছেলেকে দিয়ে দিলেন। দূরে দেয়ার কারন হল মাদ্রাসার হুজুররা পড়া না পারলে নাকী গরু মারার মত বেত দিয়ে পিটায়, আরও অনেক রকমের শাস্তি দেয়, এই শাস্তি পেয়ে যাতে ছেলে পালিয়ে বাসায় আসতে না পারে। মাদ্রাসাটি এতই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে ওখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ঠিকভাবে পাওয়া যায়না। ছেলে প্রতি বছরে ২ বার বাড়ীতে আসে।
দৃশ্যপট ২: পলেন আহমেদ। ৩ ভাই এক বোন পলেনের। বাবা চাকুরীজিবী। বড় ভাই ঢাকা ইউনিভারসিটি থেকে এবার পাস করে বের হয়েছে। মেঝো ভাই নৌবাহীনিতে আছেন। পলেন গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশনায় অসাধারন। ধারণা করা হচ্ছে গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পাবে। পলেনের বাবার ইচ্ছা ছিল যে ছোট ছেলেকে মাওলানা পড়াবেন। তাই বৃত্তি পরীক্ষার আগেই ছেলেকে তিনি ঢাকার এক মাদ্রাসায় দিয়ে দিলেন। বেশ ভাল মাদ্রাসা। কম্পিউটার ব্যাবহারের সুযোগ আছে। কোরআন সুন্নাহ এর পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কেউ ধারনা দেয়া হয়। পলেনের বাবা নিয়মিত পলেনের খোঁজ খবর রাখেন।
দৃশ্যপট ৩: গোলাম মনসুর আলী। উনার ৩ মেয়ে। ছেলের তার খুব শখ। ৩ মেয়ের পরও তাই আরেকটি ছেলে সন্তান এর আশা তার। তিনি মানত করেছেন, এইবার যদি তার ছেলে হয় আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দিবেন। আল্লাহ তার আশা কবুল করলেন। এবার ছেলে হল তার। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তিনি তার ছেলেকে ৪ বছর বয়সে বাড়ী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে এক মাদ্রাসায় দিয়ে দিলেন। জয়নাল মিয়ার মত তারও যুক্তি হচ্ছে যাতে পালিয়ে আসতে না পারে। বছরে ২ বার তিনি নিজে মাদ্রাসায় গিয়ে ছেলেকে দেখে আসেন। হুজুরের সাথে কথা বলেন। তিনি ছেলের পড়াশোনায় খুশি।
দৃশ্যপট ৪: রাহেলা বেগম। নিজে এস এস সি পাশ। বড় ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। বাড়ী থেকে কাছেই তালিম (মহিলাদের ধর্মীয় আলোচনা) হয় প্রতি সপ্তাহে। যত কাজই থাকনা কেন উনি নিয়মিত তালিম এ যান। আজকে গিয়ে শুনলেন কারা নাকি আল্লাহ আর রাসুলকে নিয়ে কোথায় জানি যা তা লিখেছে। কি লিখেছে উনি জানেন না। বাসায় এসে উনি সব কথা উনার স্বামীকে খুলে বললেন। পরদিন তার স্বামীকে সব বাধা উপেক্ষা করে শাপলা চত্তরে দেখা গেল।
দৃশ্যপট ৫: শাপলা চত্তরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের দিন আমি বাসার পাশের সেলুনে শেভ করতে গিয়েছি। ২ সেলুনকর্মীর মদ্ধে কথা:
কর্মী ১: কিরে কিরকম লোক হইসে সাপলা চত্তরে।
কর্মী ২: বাই লোকে লোকারন্য। আপনে এই বিল্ডিং এর ২ তলায় উঠলেই কথা শুনতে পারবেন
কর্মী ১: লোক হইব না কেল্লাইগা। আল্লাহ আর রাসূলরে নিয়া যাতা লেকতাসে। ব্লগ সাবার কইরালাইসে। মুসলমানরা এইগুলা মানব নাকি !!
শেভ করা শেষে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলমা, ভাই ব্লগ কি? কোন ব্লগে লিখসে জানেন কিছু?
-না ভাই। হুনছি আমি। দেহি নাই।
দৃশ্যপট ৬: রাহেলা বেগম। নিজে এস এস সি পাশ। বড় ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। বাড়ী থেকে কাছেই তালিম (মহিলাদের ধর্মীয় আলোচনা) হয় প্রতি সপ্তাহে। যত কাজই থাকনা কেন উনি নিয়মিত তালিম এ যান। আজকে গিয়ে শুনলেন কারা নাকি আল্লাহ আর রাসুলকে নিয়ে কোথায় জানি যা তা লিখেছে। কি লিখেছে উনি জানেন না। বাসায় এসে উনি সব কথা উনার স্বামীকে খুলে বললেন। পরদিন তার স্বামীকে সব বাধা উপেক্ষা করে শাপলা চত্তরে দেখা গেল।
আরো অনেক দৃশ্যপট থাকতে পারে। আমি শুধু খুব কমম কয়েকটার কথা বললাম। এবার মূল কথায় আসি। বাংলাদেশ মুসলীম দেশ। নামে মুসলীম না রীতিমত ধর্মপ্রাণ মুসলীম। ধর্মীয় আচার অনুস্টান গুলো তারা যথাযথভাবে পালন করার চেস্টা করে। শুধুমাত্র উলামায়ে কেরাম, বাড়ী ছেড়ে মাদ্রাসায় পড়ূয়া যুবক কিংবা গ্রামের সহজ সরল মহিলাটি না, ধর্মীয় অনূভুতিতে কেউ আঘাত দিলে আমার মত বুয়েট পড়ুয়াদের ও আঘাত লাগে। কথা হচ্ছে কে কিভাবে কিসের ভিত্তিতে আমরা এগুলোতে রিয়েক্ট করব। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের এখনকার পরিস্থিতির পিছনে মূল কারনটি হচ্ছে আমাদের জনসংকার সবচাইতে বড় ‘অশিক্ষত-অল্পশিক্ষিত-দরিদ্র- ধর্মপ্রাণ’ মানুষের সাথে প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের একটা বড় দূরত্ব। বিষয়টি কয়েকটা পয়েন্ট থেকে দেখা যাক।
ওলামায়ে কেরাম, মাদ্রাসা স্টুডেন্ট ও গ্রামের অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীঃ
১। উপরের দৃশ্যপটের মধ্যে শুধু দৃশ্যপট ৩ ছাড়া বাকীদের মধ্যে খুব কম মানুষ ই হয়ত বলতে পারবেন ‘ব্লগ’ ‘ব্লগার’ ‘ইন্টারনেট’ ‘ইন্টারনেটে কিভাবে ব্লগ লিখে’ ‘২-১ টা ব্লগের নাম’ ইত্যাদি। ‘আস্তিক নাস্তিক’ ইস্যুতে তারা হয়ত বেশীরভাগ ই একে অন্যের মুখ থেকে শুনেছে। (আমার কাছে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডাটা হয়ত নেই। তবে হলে আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা কম)।
মূলকথা হল তাদের মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব। এর জন্য আসলে দায়ী কে? তাদের শিক্ষাব্যবস্হার ত্রুটি? দীর্ঘ্যদিন থেকে চলে আসা প্রযুক্তির প্রতি তাদের অনীহা? নাকি অভিবাবকদের অসচেতনতা? এগুলা দূর করতে কাদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত?
২। ‘টেলিভিশন মানে শয়তানের বাক্স’, ‘ইন্টারনেট মানে ব্লগারদের নাস্তিকতা ছড়ানো’ তাদের এই ধারনাগুলো দূর করার দায়ীত্ব কার/ কাদের। যেই ওলামায়ে কেরাম টেলিভিশন, ইন্টারনেট কে খারাপভাবে দেখছেন সেই একই ব্যাক্তি হয়ত ইসলামিক অনুষ্ঠান না টিভির ভক্ত, বা তার হজের যাবতীয় কাজগুলো ইন্টারনেটে করা হচ্ছে। এই পয়েন্টগুলো তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়না?
৩। নাস্তিক ব্লগাররা যে পোস্টগুলা লিখছেন সেগুলা পয়েন্ট বাই পয়েণ্ট আলাদা করে আমরা মুসলমানরা খন্ডন করে তাদের সাথে লজিক্যাল্যি লড়তে পাড়ি। সবাই পারব না। যারা সঠিক কোরআন সুন্নাহ জানেন তারা একেবারে রেফারেন্স দিয়ে তাদের যুক্তিগুলা তুলে ধরতে পারেন। এতে করে ওই যুক্তির গ্রহনযোজ্ঞতাও বাড়বে। জ্ঞানের মোকাবেলা জ্ঞান দিয়ে করতে হয়, তলোয়ার দিয়ে না। এটা না বুঝার বড় কারন হয়ত শিক্ষার অভাব, আর যারা বুঝতে পারেন তারা কিছু করতে পারছেন না প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে।
৪। আমরা যারা প্রযুক্তির মানুষ তাদের কি কিছু করার আছে? মুসলীম দেশগুলার জন্য আমরা আলাদাভাবে কিছু ভাবব কিনা, তাদের জন্য প্রযুক্তির কোথাও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে কিনা, সেটার আউটপুট কতটুকু পজিটিভ বা নেগেটিভ হবে, কিভাবে আমাদের আরও বড় জনগোস্ঠীকে প্রযুক্তি সচেতন করতে পারি, তাদের বান্ধব প্রযুক্তি তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারি এগুলা নিয়ে হয়ত আমাদের ভাবা উচিত।
প্রযুক্তি কোন নির্দিষ্ট মানুষ বা জনগোষ্ঠীর জন্য না। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্য শুধু না, আমরা যাতে অন্তত পিছিয়ে না পড়ি সেজন্যই এটা সবধরনের মানুষের কাছে পৌছানো দরকার তাদের মত করে, তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রেখে, তাদের ব্যবহারযোগ্যতার কথা চিন্তা করে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





