ভাই বড় ধন...
রমা চৌধুরীর কথা অনেকেই জানেন। আজ তাঁর ভাই আলাউদ্দিনের গল্পটি বলতে চাই।
তার আগে, যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য রমা চৌধুরীর জীবন নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। সংবাদমাধ্যমে রমা চৌধুরীর করুণ অথচ সংগ্রামমুখর কাহিনি প্রকাশের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী দেখা করতে চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে গিয়েছিলেন তিনি। চিরচেনা সেই খালি পা, মলিন বেশে হাজির হয়েছিলেন গণভবনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। গ্রহণ করেননি। বরং উল্টো তাঁকে উপহার দিয়ে এসেছিলেন নিজের লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থটি। সাহায্য করতে চেয়েছিলেন আরও অনেকেই। কিন্তু রাজি হননি তিনি। কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে বাঁচতে শেখেননি রমাদি। নিজে লেখালেখি করেন। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ মিলিয়ে ১৮টি গ্রন্থের লেখিকা রমা চৌধুরী জীবন ধারণ করেন ফেরিওয়ালার মতো দ্বারে দ্বারে বই বিক্রি করে।
সেই ষাটের দশকে, নারীদের জন্য উচ্চ শিক্ষা লাভ যখন প্রায় বিরল ঘটনা ছিল এ দেশে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন রমা চৌধুরী। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আজ প্রতিষ্ঠার মধ্যগগনে থাকার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেছে একাত্তর।
পেশা হিসেবে বেঁচে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের গ্রামের বাড়ি পোপাদিয়াতেই ছিলেন তিনি। স্বামী ছিলেন ভারতে। একাত্তরের ১৩ মে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা হানা দিয়েছিল তাঁর বাড়িতে। পাকিস্তানি সেনা নিজের মা আর দুই শিশুসন্তানের সামনেই ধর্ষণ করে তাঁকে। লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর বাড়িটিও।
লাঞ্ছিত হওয়ার পর এলাকাবাসী কেউ কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাশে এসে দাঁড়ালেও নিকটজনেরাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেদিন। রমা চৌধুরী তাঁর একাত্তরের জননী বইয়ে লিখেছেন, ‘...আমার আপন মেজো কাকা সেদিন এমন সব বিশ্রী কথা বলেছিলেন লজ্জায় কানে আঙুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেওয়ার জন্য।’
ছেলেদের নিয়ে থাকতে হয়েছে দরজা-জানালাহীন ভাঙা ঘরে। অনাহারে-অর্ধাহারে ও শীতের কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল সাগর ও টগর নামের দুই ছেলে। ১৫ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাতে অসুস্থ হয়ে ২০ ডিসেম্বর মারা গেল সাগর। একই অসুখে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেল দ্বিতীয় ছেলে টগরও।
স্বাধীনতার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন রমা। কিন্তু ভাগ্য সেখানেও বঞ্চিত করেছে তাঁকে। প্রতারণার শিকার হলেন আরও একবার। সংসার ভাঙল। দীপংকর নামে এই ঘরের এক সন্তানকেও হারালেন ১৯৯৮ সালে। হিন্দু ধর্মের মরদেহ পোড়ানোর রীতি গ্রহণ করেননি রমা চৌধুরী। তিনটি ছেলেকেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। তিন সন্তান মাটির নিচে আছে, এই বিশ্বাসে বাকি জীবন আর কোনো দিন জুতা পরে মাটিতে হাঁটেননি। জীবনের সব হারিয়েও ভাগ্য ও প্রকৃতির কাছে পরাস্ত হননি রমা চৌধুরী। নিজের সৃষ্টিশীলতাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছেন সম্মানের সঙ্গে।
রমা চৌধুরী প্রথম আলোএখান থেকেই শুরু হতে পারে আলাউদ্দিনের গল্প। ১৯৯৪ সালে একটি প্রেসে বই ছাপাতে এসে সেই প্রেসেরই কর্মী আলাউদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। সব অবলম্বন হারিয়ে যখন অকূল সাগরে তখন ঈশ্বরই যেন তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিল পুত্রতুল্য ছোট ভাইটিকে। আলাউদ্দিন ওরফে খোকনেরও ছিল দুঃখের ইতিহাস। সৎমার রূঢ় ব্যবহারে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। দুই দুঃখী বাঁধা পড়লেন মায়ার বাঁধনে। একসময় খোকনকে রেঁধে খাওয়াতেন দিদি। পরে ভাই-বোন যখন একত্রে থাকা শুরু করলেন, সেই থেকে আজ প্রায় ১৯ বছর ধরে দিদিকে রেঁধে খাওয়ান খোকন। টুকটাক প্রেসের ব্যবসা আর সাংগঠনিক কিছু কাজকর্ম ছাড়া বাকি সময়টা দিদির দেখাশোনা, দিদির বই ছেপে বের করা, পরে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সেই বই বিক্রি করেই দিন কেটেছে খোকনের।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন রমা চৌধুরী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড় মাস অনিদ্র রাত কাটিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে দিদিকে কেড়ে এনেছিলেন খোকন। এখানে বলা দরকার, তখন এই আলাউদ্দিন ছিলেন প্রথম আলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক। বন্ধুসভার সদস্যরাও খোকনের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা-শুশ্রুষা করেছিলেন দিদিকে।
হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরার পর শরীরের ডান পাশ অবশ হয়ে পড়েছিল রমা চৌধুরীর, একটি চোখও নষ্ট। খোকন নিজের হাতে খাইয়েছেন-পরিয়েছেন, গোসল করিয়েছেন দিদিকে। তাঁরই বিস্ময়কর সেবা-যত্নে দিদি আবার ফিরে পেয়েছেন চলার শক্তি।
দিদি পূজা দিতে যান কৈবল্যধাম ও গোলপাহাড়ের শ্মশান মন্দিরে। সেখানেও তাঁর সঙ্গী খোকন। দিদি পূজা করেন, দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন ছোট ভাইটি। দিদি তাঁর দেবতার কাছে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন। দিদির পূজার জন্য ভোগও রান্না করে দেন খোকন।
‘অন্য ধর্মাবলম্বীর রান্না করা ভোগ দেবতা গ্রহণ করবেন?’ —এমন প্রশ্নে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন রমা চৌধুরী। সেই দৃষ্টিতে যেন উঠে আসে পাল্টা প্রশ্ন, ‘ভাইয়ের আবার জাত কী?’
সময়ের নিয়মে আলাউদ্দিন বিয়ে করেছেন। একটি কন্যাসন্তানও আছে তাঁর। কিন্তু এখনো দেখা যায় কাঁধে ঝোলা, কানে হিয়ারিং এইড লাগানো এক প্রৌঢ়া হেঁটে যাচ্ছেন ফুটপাত ধরে, পাশে তাঁর মাথায় ছাতা ধরে চলেছেন এক তরুণ।
এই যুগে নিজের সন্তানই ঠিকমতো দেখভাল করতে পারেন না মা-বাবার। সেখানে অনাত্মীয় ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের দুটি মানুষের এই অসাধারণ সম্পর্ক দেখে বিস্ময় মানতেই হয়! এ যেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের সেই অসাধারণ উক্তিটিকেই মনে করিয়ে দেয়—‘পৃথিবীতে কে কাহার!’
Click This Link