somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিপসি মথের অভিযান; নায়ক ফ্রান্সিস চেসেস্টার

১৮ ই জুন, ২০১১ বিকাল ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৮ মে, ১৯৬৭। ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ নৌ-বন্দর। অস্তমিত সূর্যের রশ্মি রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঢেউগুলোকে। আকাশে উড়ছে ছোট কয়েকটি বিমান। ৩০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছে ‘জিপসি মথ’ নৌকায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসা নতুন নায়ক ফ্রান্সিস চেসেস্টারকে স্বাগত জানাতে। তরুণ হৃদয়ের অধিকারী ৬৫ বছর বয়সী ফ্রান্সিস এত সুন্দর সূর্যাস্ত সম্ভবত আগে প্রত্যক্ষ করেননি।
রোমাঞ্চপ্রিয় ফ্রান্সিস ১৯১১ সালে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে নিউজিল্যান্ড যাত্রা করেন। খনিতে কাজ করে, সংবাদপত্র বিক্রি করে এবং সর্বশেষে জমি সংক্রান্ত কাজ করে ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং একটি বিমান পরিসেবা চালু করেন। এরপর মাত্র ৩ মাসের মধ্যে পাইলট লাইসেন্স নিয়ে এক-ইন্জ্ঞিনচালিত একটি বিমানে করে ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি একাই পাড়ি দেন। এরকম রোমাঞ্চকর বিমান যাত্রা চলতেই থাকে। এরমধ্যে জাপানে একটি দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। ১৯৬০ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে একটি নৌকা প্রতিযোগিতায় নিকটতম প্রতিযোগীর চেয়ে এক সপ্তাহ আগে পৌঁছে যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এরপরই, জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ তাঁর ভাবনায় আসে –নৌকা নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ।
শুরু হয় প্রস্তুতি। ১৯৬৬ সালের ২৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ বন্দর থেকে ৫৩ ফিট লম্বা ‘জিপসি মথ’ নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছুদিন পরেই পেটের অসুখে ভুগতে শুরু করেন। অত:পর দেখা দেয় তীব্র পা-ব্যাথা। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই পা লম্বা করে রাখতে হয়। এরপর দেখা পান অনুকূল পরিবেশের। তীব্র বাতাসে ৫৪৮ মাইল পথ পাড়ি দেন মাত্র ৩ দিনে। ১৭ সেপ্টেম্বর শ্যাম্পেনে চুমুক দিয়ে স্ত্রী ও বন্ধুবান্ধবদের স্বাস্থ্য পান করেন এবং পালন করেন নিজের ৬৫ তম জন্মদিন। সেসময় একটি ঝড়ের মধ্যে পরলে জন্মদিন পালন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন। দক্ষিণ গোলার্ধে প্রবেশের পর নৌকার গতিপথের বিপরীতে ঘণ্টায় ৫০ নট বেগে বাতাস বইতে শুরু করলে গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কলকব্জা নষ্ট হয়ে যায়। স্রোতের বিপরীতে শুধুমাত্র দাঁড় বেয়ে নৌকা চালানো তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। তনুমধ্যে জিপসি মথ আরেকটি ঝড়ের কবলে পরলে ফ্রান্সিসকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নৌকা সেচ করতেই ব্যস্ত থাকতে হয়।
অক্টোবর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে দুবার ঝড়ের কবলে পরেন এবং এতে নৌকার পাল সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায়। তনুমধ্যে শক্ত কেক খেতে গিয়ে একটি নকল দাঁত খুলে যায়। পহেলা নভেম্বর সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয় এবং ফ্রান্সিস প্রায় ২৭ গ্যালন মিষ্টি পানি জমিয়ে রাখেন। এরপরেই তাঁকে পেয়ে বসে প্রচণ্ড একাকীত্বে। দক্ষিণ সাগরে প্রকৃতিগত ভাবেই নাবিকরা একাকীত্বে ভোগে বেশি। ফ্রান্সিস কিছুদিন দাঁড় বাওয়া বন্ধই রেখে দেন। একাকীত্ব দূর করার জন্য বিভিন্ন কাজে মনোনিবেশের বৃথা চেষ্টা করেন। রাতে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন অথবা কঠিন অসুখে ভুগছেন। ফ্রান্সিসের কাছে একটি উন্নতমানের রেডিও থাকলেও সেটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছিলেন পাছে সভ্য পৃথিবীর খবর তাঁকে আরও একাকীত্বে ফেলে দেয়। ছেলের দেওয়া শাইকোভস্কি, গারসউইন, বিটোফেনের রেকর্ডগুলো তাঁর একাকীত্ব বরঞ্চ বাড়িয়েই তুলছিল।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি তখনও ৩,০০০ মাইল দূরে। ফ্রান্সিস খেয়াল করলেন স্বয়ংক্রিয় স্টিয়ারিংটি প্রায় বিধ্বস্তই হয়ে গেছে। সেখান থেকে ম্যানুয়াল স্টিয়ারিং চালিয়ে সিডনি পাড়ি দেয়া তাঁর কাছে নিতান্তই হাস্যকর ঠেকল। সাগরে তিনি প্রায় একটানা ৮০ দিন চলছেন। তবু চেষ্টা করলেন ম্যানুয়াল স্টিয়ারিং দিয়েই চেষ্টা চালাতে এবং অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের পর ১০৭ দিনের মাথায় পৌঁছালেন গন্তব্যে। ততদিনে শরীর থেকে ঝরে গেছে ৫০ পাউন্ড ওজন। তিনি সিডনিতে অবস্থান করলেন ৪৭ দিন। জিপসি মথ সম্পূর্ণভাবে মেরামত করে, প্রচুর খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা। কিন্তু কিছুদূর যেতেই আরেকটি ঝড়ের কবলে পরে জিপসি মথের প্রপেলার ও ককপিট ক্ষতিগ্রস্ত হল।
সমগ্র ফেব্রুয়ারি জুড়েই ফ্রান্সিস লড়লেন ঝড়ের সাথে। যাত্রা শুরুর আগেই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাবেন এবং হর্ন অন্তরীপ হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করবেন। হর্ন অন্তরীপের কাছে পৌঁছামাত্র আরেকটি তীব্র ঝড়ে নৌকার পানি সেচ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তনুমধ্যে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ নট। ফ্রান্সিস তীব্র ঠাণ্ডা অনুভব করতে লাগলেন। কিছুদিন পর স্ট্যাটেন দ্বীপের কাছে একটি বড় চাঁইয়ের সাথে সংঘর্ষের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। ২৪ এপ্রিল বিষুবরেখা পার হয়ে উত্তর গোলার্ধে প্রবেশ করলে ভ্রমণ পরিসমাপ্তির তীব্র ইচ্ছা তাঁকে পেয়ে বসল। মে মাসে ডান কনুইয়ে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হওয়ায় আর্নিকা( হোমিওপ্যাথিক ঔষধ) খাওয়া শুরু করলেন। পরবর্তীতে কনুইতে চিড় ধরেছে বুঝতে পারায় ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া শুরু করলেন। উত্তর আটলান্টিক সাগরে প্রবেশের পর থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার, ফটোগ্রাফারদের আগমন তাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলল। তিনি এতটাই বিরক্ত হলেন যে তাদের দেয়া মদ বর্জন করলেন। প্লাইমাউথ নৌ বন্দরে পৌঁছার কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারেন তাঁকে স্বাগত জানাতে বন্দরে জড়ো হয়েছে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ।
যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র দেরি করেনি। শীঘ্রই ফ্রান্সিস চেসেস্টার ভূষিত হন ‘স্যার’ উপাধিতে। অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার কারিগর স্যার ফ্রান্সিস চেসেস্টার নি:সন্দেহে তরুণদের কাছে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১১ বিকাল ৩:১৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×