somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থেরামিন - ১০০ বছরে পা রাখা "অস্পৃশ্য" বাদ্যযন্ত্র!

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ধরুন, একটা বাদ্যযন্ত্র যার কোন তার নেই, পর্দা বা কোন "কি" বা বাটনও নেই। বাদ্যযন্ত্রটির সামনে আপনি বিশেষ ভঙ্গিতে হাত নাড়ছেন আর সেটা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সুর! ভাবছেন মজা করছি? মোটেই না। এরকম একটি বাদ্যযন্ত্র সত্যিই আছে, আর ২০২০ সালে তা আবিস্কারের ১০০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে! এই অদ্ভুত যন্ত্রটির নাম থেরামিন, যা বাজানোর জন্যে আপনাকে এটি স্পর্শ পর্যন্ত করতে হবেনা।

শুরুর কথা
থেরামিনের আবিস্কারক রুশ বিজ্ঞানী লেভ সের্গেইভিচ তেরেমেন। প্রথমে এর নাম ছিল তেরেমেনভক্স, পরে ইথারফোন নাম দেয়া হলেও এখন আমরা তেরেমেন'র নামানুসারে একে থেরামিন বলেই জানি। রুশ বিপ্লবের শুরুর দিকে জন্ম থেরামিনের। রুশ সিভিল ওয়ারে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের খুঁজে বের করার নতুন নতুন কায়দা নিয়ে কাজ করছিলো সোভিয়েত সরকার। সেরকম একটি প্রযুক্তি ছিলো প্রক্সিমিটি সেন্সর, যার ব্যবহার এখন আমাদের স্মার্টফোন গুলোতেই আমরা দেখতে পাই। এই প্রক্সিমিটি সেন্সর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তেরেমেন আবিস্কার করে ফেলেন একটি বাদ্যযন্ত্র, ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে, আর এটাই থেরামিন। এর সুর দারুণভাবে পছন্দ করেছিলেন বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। থেরামিন নিয়ে তেরেমেন ইউরোপে বেশ বড়সড় একটা ট্যুর দেন। সংগীত পিপাসুদের কে তিনি নিজেই থেরামিন বাজিয়ে শোনাতেন এসব শো গুলোতে। ১৯২৮ সালে তেরেমেন আমেরিকায় চলে আসেন ও থেরামিনের প্যাটেন্ট করান নিজের নামে।


লেভ তেরেমেন থেরামিন বাজিয়ে শোনাচ্ছেন

কিভাবে কাজ করে থেরামিন?



থেরামিনের গড়নটা বেশ অদ্ভত। একটি পেঁচানো আনুভূমিক এবং আরেকটি উলম্ব এন্টেনা নিয়ে তৈরী হয় এর মূল অংশ। ভেতরে থাকে সার্কিক্ট্রি। আনুভূমিক ইউ লুপ আকৃতির এন্টেনাটি কাজ করে ভলিউম ট্রিগার হিসেবে, হাত উপরে নিচে নামানোর মাধ্যমে ধ্বনির তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উলম্ব এন্টেনাটি কাজ করে পিচ কন্ট্রোলার হিসেবে। এই দুই এন্টেনার মাঝে বিশেষ কায়দায় হাত নাড়িয়ে বিভিন্ন মাত্রার সুর তৈরী করতে হয়, যন্ত্রটিকে স্পর্শ করা ছাড়াই। থেরামিন কিভাবে সুর তৈরী করে এর পেছনের ফিজিক্স সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি না। সেটা জানতে এই ছোট ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন-



মিউজিকে থেরামিন
থেরামিন কে প্রথম ইলেক্ট্রো মিউজিক ঘরানার ইন্সট্রুমেন্ট বলা যায়। ফাজি মিউজিক আর ক্রিঞ্জি টিউনের আইডিয়াও হয়ত থেরামিনের মাধ্যমেই এসেছে। থেরামিন যখন বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মোটামুটি পরিচিত তখনো ইলেক্ট্রিক গিটার কিংবা সিন্থ এর প্রচলন হয়নি মিউজিক সিনে। তাই অর্গানের ন্যাচারাল অ্যাকুয়েস্টিক সাউন্ডের তুলনায় নতুন মাত্রার সুর সৃষ্টিকারী "জাদুর বাক্স" খুব সহজেই সংগীতের জগতে নিজের স্থান করে নিয়েছিলো।

যদিও প্রথম বানিজ্যিক ভাবে তৈরী করা তেরেমিনভক্স (তখনকার নাম) ৫০০টি ইউনিটের আশেপাশে বিক্রি হয়, কিন্তু আমেরিকায় থেরামিন অনেকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিল। ক্ল্যাসিকাল মিজিশিয়ান ক্লারা রকমোর আমেরিকার অনেক শহরে ট্যুর করেন থেরামিন নিয়ে। এসব শো গুলোতে মাঝে মাঝে যোগ দিতেন পল রবসন।


ক্লারা রকমোর বাজাচ্ছেন "দ্য সোয়ান"

কনসার্ট মিউজিকের জন্যে থেরামিনের মিউজিক লিখেছেন ক্রিস্টিয়ান উলফ, পার্সি গ্রেঞ্জার, জোসেফ শিলিঞ্জার, মরিটজ এগার্টের মত সংগীতকাররা। পার্সি গ্রেঞ্জার ৪ অথবা ৬ টি থেরামিনের সাহায্যে এন্সেম্বল ও রচনা করতেন।

রক মিউজিকে প্রথম থেরামিন ব্যবহার করে "লোথার অ্যান্ড দ্য হ্যান্ড পিপল" নামের একটি ব্যান্ড, ১৯৬৫ তে। লেড যেপেলিনের জিমি পেইজ "Whole Lotta Love" এবং "No Quarter" গান কনসার্টে পারফর্ম করার সময়ে থেরামিন ব্যাবহার করতেন। রোলিং স্টোনস ১৯৬৭ সালে "Between the Buttons" আর "Their Satanic Majesties Request" অ্যালবাম দুটিতে থেরামিন ব্যাবহার করেছিলো।

১৯৩১ সালে নির্মিত "ওদনা" মুভিটির মিউজিক কম্পোজার দিমিত্রি শস্তাকোভিচ তার অর্কেস্ট্রাল মিউজিকে থেরামিন ব্যাবহার করেন। এটাই ফিল্মে থেরামিনের প্রথম ব্যবহার। রিনরিনে স্পুকি সাউন্ডের কারণে অনেকগুলো ফিল্মেই থেরামিন ব্যবহৃত হয়েছে আগে পরে। Spellbound, The Red House, The Lost Weekend, The Spiral Staircase, Rocketship X-M, The Day the Earth Stood Still, The Thing (From Another World), Castle In the Air সহ বেশ কিছু মুভিতে থেরামিন ব্যাবহৃত হয়েছিল। আমাদের সমসাময়িক সময়ে ক্রিশ্চিয়ান বেল অভিনীত "দ্য মেশিনিস্ট" বা "ফার্স্ট ম্যান (২০১৮)" মুভিতেও থেরামিন ব্যবহৃত হয়েছে মিউজিক স্কোরে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় থেরামিনিস্টদের একজন হলেন জার্মান মিউজিশিয়ান ক্যারোলাইনা আইক। তিনি থেরামিন নিয়ে কনসার্ট করেন, লাইভ সেশন করেন, শেখান ও নিজের গানে ব্যাবহার করেন মেইন ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে। থেরামিন নিয়ে টেডএক্স টকেও হোস্ট হয়েছেন ক্যারোলাইনা।


ক্যারোলাইনা আইকের একটি মিউজিক স্কোর

কনসার্ট ফর দ্য এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়ালস
মস্কো থেরামিন সেন্টার ২০০১ সালে একটা মজার কাজ করে বসল। তারা পৃথিবীর বাইরের বুদ্ধিমান প্রাণীদের জন্যে রেকর্ড করে পাঠালো থেরামিনে বাজানো ৭ টি ভিন্ন ভিন্ন মেলোডি। ইয়েভপ্যাটোরিয়া ডিপ স্পেস কমিউনিকেশন্স কমপ্লেক্স থেকে ইন্টারস্টেলার রেডিও সিগন্যাল হিসেবে সেই রেকর্ড গুলো ৩ দিন সময় ধরে ৬ বার করে বাজানো হয়েছিলো। কে জানে সেই ইন্টারস্টেলার রেডিওতে এলিয়েনরাও থেরামিন শুনেছে কিনা!

ইতি থেরামিন
থেরামিনের সুরে একধরনের করুণ আর্তনাদ আছে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আপনাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলতে পারে এর সুর। কিছুটা কি ইচ্ছে করছে নিজেই এই অদ্ভুত যন্ত্রটি বাজিয়ে দেখতে? আমার জানামতে কোন বাংলাদেশি থেরামিনিস্ট নেই। প্রথম হবার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন চাইলে। কারণ একটা প্রফেশনাল থেরামিনের মালিক হতে গেলে আপনাকে ১০০ ডলারের আশেপাশে খরচ করতে হবে। অন্য বাদ্যযন্ত্রের তুলনায় অংকটা খুব একটা বেশি না কিন্তু!


তথ্যসূত্রঃ উইকি এবং thereminworld.com





------
কোথা থেকে এলো সিরিজের আগের পোস্টঃ প্যারেন্টাল অ্যাডভাইজরিঃ এক্সপ্লিসিট কনটেন্ট
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৩১
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×