

জাহাজ ভাঙ্গা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ। তাই এ কাজে প্রতি মহুর্তেই ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় শ্রমিকদের। এসব জেনেও বেশিরভাগ ইয়ার্ড মালিক, কন্ট্রাক্টর ও শ্রমিক কেউই সাবধানে কাজ না করায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাহাজ আমদানির সময় পরিবেশ ও বিষ্ফোরক আইন না মানায় শিপইয়ার্ডে প্রায়ই দূর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আর এসব কারণে বিগত চার দশকে এখানে দূর্ঘটনায় প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু ও কমপক্ষে ২০ হাজার শ্রমিক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।৪ দশকে নিহত প্রায় ৩ হাজার, আহত ২০ হাজারেও বেশি
সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডগুলোতে নানা কারণে দূর্ঘটনা ঘটে। এসব কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাটা জাহাজের প্লেট চাপা পড়া, বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হওয়া, বিষ্ফোরণ, ও্যয়ার ছিড়ে এবং তেল বা গ্যাসের ট্যাংকারে পড়ে গিয়ে শ্রমিক বা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই প্রানহানি হয়। এদিকে এসব কারণে এখানে প্রায়ই দূর্ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ দূর্ঘটনা ঘটে প্লেট চাপা পড়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জরিপ মতে এসকল কারণে সংঘটিত দূর্ঘটনায় এখানে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একজন শ্রমিক নিহত ও প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজন শ্রমিক আহত হয়।
আর নানা কারণে শিপইয়ার্ডে দূর্ঘটনা ঘটলেও এখানে ভয়াবহ দূর্ঘটনাগুলো ঘটে মূলত গ্যাস সিলিন্ডার বা তেলের ট্যাংকার বিষ্ফোরণে। এদিকে দূর্ঘটনার উপর কারো হাত না থাকলেও এখানে দূর্ঘটনার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইয়ার্ড মালিকদেরই দায়ী করা হয়। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণও আছে।
বেশিরভাগ ইয়ার্ড মালিকই ইয়ার্ড নির্মাণ থেকে শুরু করে জাহাজ আমদানি পর্যন্ত সময়ে যেসব নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক তা মানেন না। অনেকের কাছেই নেই পরিবেশ ও বিষ্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও। ছাড়পত্র না নিয়ে এবং আইন না মেনে নিজের ইচ্ছে মত জাহাজ কাটতে গিয়ে সেসব মালিকের ইয়ার্ডে প্রায়ই দূর্ঘটনা ঘটলে সমগ্র জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যদিকে এর জন্য যে শুধু যে কতিপয় মালিক দায়ী তা-ই নয়, এখানে যেসকল বিষ্ফোরণ অথবা বিষাক্ত তৈল,গ্যাসজনিত দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য অনেকাংশে সরকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলিও সমানভাবে দায়ী। কারণ, ইয়ার্ডগুলোতে কোন জাহাজ বিচিং করার পূর্বে ওই জাহাজের আয়েল ট্যাংক, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সব গ্যাস ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ অবমুক্ত করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হয়। আর বিষয়গুলো দেখার জন্য সরকারী দপ্তর রয়েছে। এসব দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই জাহাজগুলি ইয়ার্ডে বিচিং করে। এরপরও ইয়ার্ডে বিষাক্ত তৈল, গ্যাসে আক্রান্ত হওয়া অথবা বিষ্ফোরণের ঘটনাগুলি সেসব দপ্তরের ভূমিকাকেও সমানভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অন্যদিকে দূর্ঘটনার জন্য সরকারী দপ্তরগুলিকেও অনেকাংশে দায়ী করা হলেও সেসব দপ্তরগুলি কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাহাজ ইয়ার্ডে বিচিং করার পর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল গ্যাস ও তেল ফ্রি হলে তা পর্যবেক্ষন করে স্থায়ী সনদপত্র প্রদান করা হয়। পেট্রোলিয়াম আইন ১৯৩৭ এর ৩৮ ধারা অনুযায়ী জাহাজ বিচিং করার পূর্বে বহিঃনোঙ্গর-এ এবং জাহাজ ইয়ার্ডে বিচিং করার পর দ্বিতীয় বার গ্যাস ফ্রি করার বাধ্যতামূলক। কিন্তু দ্বিতীয় বার গ্যাস ফ্রি করা হয়েছে কি না তা পরিদর্শন করতে গেলে অনেক ইয়ার্ড মালিক বিষ্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মীদের ইয়ার্ডের ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় না বলেও ঐ কর্মকর্তা অভিযোগ করেন। তাই সবসময় বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পক্ষে গ্যাস ফ্রি করা হয়েছে কি না তা যাচাই করা সম্ভব হয় না বলে তিনি দাবী করেন।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইনের ৪ ধারায় শিপইয়ার্ডগুলোতে অগ্নি-এসিটিলিটি শিখা ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ( ছাড় পত্র) নেয়া বাধ্যতামূলক।
১৯৯৭ সালের পর থেকে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে জাহাজ কাটার জন্য কোন ছাড়পত্র নেয়া হয়নি। অবশ্য এই ছাড়পত্র না নেওয়ার নেপথ্যেও একটি অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। তা হলো, ছাড়পত্র প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের দায়ের করা একটি রিট পিটিশনের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টি স্থগিত করে দেয়। তাই সমুদ্র অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই পুরাতন জাহাজগুলো বিচিং হচ্ছে। যদিও এরপর আবার বাংলাদেশ জাতীয় মেরিন সংস্থা ২০০১ সালে ছাড়পত্র গ্রহন করা বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু ওই আদেশ জারি করা হলেও পিশ ইয়ার্ড মালিকরা তা মানছে না।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল সোবাহন বলেন, সীতাকুণ্ডের শিপ ইয়ার্ডগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়ার বিধান থাকলেও তারা এ নিয়ম মানছে না। এ বিষয়ে আমরা পূর্বেও নোটিশ জারি করেছিলাম। তারা পরে নোটিশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের আপিল বিভাগে রিট করলে হাই কোর্ট তা স্থগিত করে দেয়। এদিকে ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ আমদানি প্রসঙ্গে সা¤প্রতিক সময়ে বারবার লেখালেখি হওয়ায় এখন পরিবেশ অধিদপ্তর পুনরায় সীতাকুণ্ডের ৮৪টি শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষকে নোটিশ জারি করছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সাংবাদিকদের জানান। এদিকে শিপইয়ার্ডে দূর্ঘটনার জন্য যে বা যারাই দায়ী হোক না কেন দূর্ঘটনা ঘটছে এবং তাতে প্রতিবছর অসংখ্য শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটছে এট্ইা সত্যি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এসকল কারণে ইয়ার্ডগুলোতে বিগত চারদশকে প্রায় তিন হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর পাশাপাশি আহত হয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। যার মধ্যে বিগত এক যুগে মারা গেছে ১৩শ এবং বিগত একবছরে মারা গেছে ২৭ জন শ্রমিক।
আমরা বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে যথাযথ নিয়ম মেনে ছাড়পত্র নিয়ে জাহাজ কাটি। এতদিন পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন ছাড় পত্র নিতে হতোনা তাই নিই নি। আর দূর্ঘটনা কেউ ইচ্ছে করে ঘটায় না। আমরা মালিকরা সবসময় চেষ্টা করি যেন শ্রমিকরা নিরাপদে জাহাজ কাটতে পারে। এরপরও দূর্ঘটনা ঘটলে আমরা শ্রমিকদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করি। আর এখন শুধু শ্রমিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য ভাটিয়ারীতে ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিএসবিএ হাসপাতাল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




