
সীতাকুন্ডের সলিমপুর থেকে কুমিরা সমুদ্র উপকূল জুড়ে ৭টি জেলেপাড়া। এই জেলেপাড়ার জেলে স¤প্রদায় যুগ যুগ ধরে নিয়োজিত ছিল সামুদ্রিক মাছ ধরার পেশায়। কিন্তু গত এক যুগ ধরে সমুদ্রের উপকূলে জাহাজ ভাড়া শিল্পের ব্যাপক প্রসারে ফলে এই অঞ্চলের জেলে স¤প্রদায়ের বিঘিœত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙ্গা বিভিন্ন বর্জ্য ও তৈলজাত দ্রব্য এসব এলাকার সমুদ্রের পানি ও মাটিকে দুষিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে সমুদ্রগামী জাহাজ চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট, ভাটিয়ারী, সোনাইছড়ি ও কুমিরা এলাকার ৪৫টি ইয়ার্ডে কাটা হয়। জাহাজগুলো কাটার সময় তেল ট্যাংকারের তলানিতে জমে থাকা বিপুল পরিমাপ অপরিশোধিত তেল, অন্যান্য লুব্রিকেল্ট এবং ইঞ্জিনের তেল বিভিন্ন জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে থাকে। এই বর্জ্য মিশ্রিত তেল সমুদ্রের পানিতে মিশে পানিকে দুষিত করে দারুনভাবে। এই দূষনের ফলে তৎসংলগ্ন সমুদ্র সৈকতের স্বাভাবিক অবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা বিপর্যয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনষ্ট্রিটিউটের অধ্যাপক এম.এম.হোসাইন ও অধ্যাপক এম.ইসলাম এই অঞ্চলের সমুদ্রের পানি ও মাটি দুষণ সংক্রান্ত ‘জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রম এবং চট্টগ্রাম উপকুলীয় এলাকায় এর প্রভাব’ বিষয়ক এক গবেষণায় দেখা যায়, জাহাজ ভাঙ্গা বা মেরামতের সময় ভাঙ্গা জাহাজের অপরিশোধিত তেল, ভারী ধাতু এবং রাসায়নিক বিভিন্ন বর্জ্য উপকূলের বিস্তির্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শুধু উপকূলে নয়, এসব ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের পানিতেও।
তাদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার মাটিতে বিষাক্ত ধাতু ছড়িয়ে পড়ে। তারমধ্যে পারদ রয়েছে ০.৫-০.২৭ পিপিএম, সীসা রয়েছে ০.৫- ২১.৮ পিএম, ক্রোমিয়াম রয়েছে ২২০ পিপিএম, ক্যাডামিয়াম রয়েছে ০.৩-২.১ পিপিএম, ক্যালসিয়াম রয়েছে ৫.২-২.১০ পিপিএম এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে ৬.৫-১.৫৭ পিপিএম।
গবেষণায় আরো উলে¬খ করেন যে, সমুদ্রের পানির উপর যে তেল ও বর্জ্য জমা হয় তা সূর্যের আলোকে পানির নীচে পৌছতে বাধা দেয়। এতে পানির নীচের উদ্ভিদ জগতের সালোক সংশে¬ষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। এসকল উদ্ভিদ ছোট ছোট মাছ ও ক্ষুদে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ করে। সালোক সংশে¬ষণ প্রক্রিয়া বাধা পেলে উদ্ভিদের জন্মনো এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ২১ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী, সোনাইছড়ি ও কুমিরা সমুদ্র উপক’লে মৎস্য আহরণকারী জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০বছরে সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপক’লে মৎস্য আহরণ ৮০ শতাংশের মতো কমেছে। স্থানীয় ভাবে পরিচিত লাল চিংড়ি, ট্যাংরা (গুইল¬্যা মাছ), লইট্যা মাছ, রিটা মাছ, পোপা মাছ, ছিরিং মাছ, রিস্শা মাছ, হোন্ধরা মাছ, বাইলা মাছ, ইছা মাছ এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাওয়া যেতো প্রচুর রুপালী ইলিশ, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, একসময় গাংচিল, রাজ হাঁস, পানকৌরি, বক, রাজহাঁস, শামুক কেচা, হারগিলা, শারস, পানকোড়ি, মানিক জোড় জাতীয় পাখিরও বিলুপ্তি ঘটছে।
উপকুলীয় জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. হারুণ জানান, জাহাজভাঙা কর্মকান্ডের কারণে চট্টগ্রাম উপকুলীয় অঞ্চলের মৎস্য ও প্রানীকুলের উপর নৈতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস জানান, এই অঞ্চলগুলো ছিল এক সময় বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। গভীরতার কারণে এখানে এক সময় মাছেরা ডিম পাড়তে আসত। এখন তা আর নেই। জাহাজ ভাঙ্গা ঘাটার পাশে বির্স্তৃত এলাকা জুড়ে পানিতে তেল ভাসতে দেখা যায়। ফলে ঐ এলাকার পানিতে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। এ কারনে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
সীতাকুণ্ড উপকুলীয় বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা জামিল মোহাম্মদ জানান, পতেঙ্গা থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে শিপ ব্রেকিং শিল্প গড়ে উঠার আগে উপকূলীয় ভাঙ্গন রোধ কল্পে ব্যাপক হারে বনায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু উক্ত এলাকায় এই শিল্পের প্রসারের ফলে এলাকার বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহৃ হয়ে যায়। ফলে ভাঙ্গন বিস্তৃতি লাভ করে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ জানান, জাহাজ কাটার সময় বর্জ্য পর্দাথগুলো পানিতে না ফেলার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে মালিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপরও বিশাল জাহাজ কাটতে গিয়ে অসাবধানবশত পানিতে পড়তেই পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




