বিজ্ঞান কি ও কেন
লেখেছেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
পড়তে বা ডাউনলোড এখানে
লেখকঃ
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: ১৯ নভেম্বর, ১৯১৮ - মৃত্যু: ৮ মে, ১৯৯৩) ভারতের একজন প্রখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক। তিনি প্রাচীন ভারতের দর্শনের বস্তুবাদকে উদ্ঘাটন করেছেন। তার সবচেয়ে বড় কাজ হল লোকায়তের প্রাচীন দর্শনকে তিনি বিরুদ্ধপক্ষের বিকৃতি হতে রক্ষা করেন এবং তা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও তিনি প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি সম্পর্কেও গবেষণা করেছেন বিশেষ করে প্রাচীন চিকিৎসক চরক ও শ্রুশ্রুত সম্পর্কে।
১৯৯২ সালের জুনে দেবীপ্রসাদ যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, তখনো তিনি ইতিহাসের বাঁকবদলের নানা দিক সম্পর্কে নতুন কিছু লেখার কথা ভেবে যাচ্ছিলেন। সে বিষয়টিও আমাদের জানিয়েছেন তার স্নেহভাজন শিষ্য তপতী চক্রবর্তী। দেবীপ্রসাদের মৃত্যুর প্রায়-অব্যবহিত পূর্বেকার এক দিনের স্মৃতিচারণ করে রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন-
“তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা তাঁর মৃত্যুর মাসখানেক আগেÑ তাঁর বাড়িতে। অলকাদি [দেবীপ্রসাদের স্ত্রী] ফোন করে জানালেন দেবীদা আমাকে একটা কাজে খোঁজ করছেন। দেবীদাকে সেদিন খুব কষ্ট পেতে দেখেছিলাম। পিঠের অসহ্য যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী, তার সঙ্গে তাঁর চিরসঙ্গী শ্বাসকষ্টও অব্যাহত। একটা কথা বললে দ্বিতীয় কথার জন্য প্রায় পাঁচ মিনিটে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শয্যাপার্শ্বে বসে আমি ও বন্ধুবর শান্তনু দুজনেই সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালাম, ‘দেবীদা, আজ থাক, পরে আবার বসব, একটু সুস্থ হয়ে উঠুন।’ হাত তুলে আমাদের নিরস্ত করলেন। তারপর অপরিসীম যন্ত্রণাকে চেপে রেখে প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে বললেন কেন আমায় ডেকেছেন। তাঁর বিশেষ প্রিয় বিষয় ছিল আর্যভট। আর্যভটের অসামান্য গণিতচর্চা কি নিছকই জ্ঞানচর্চা, না তার কোনো সামাজিক অভিঘাত ছিল? দেবীদার মাথায় ঘুরছিল মধ্যযুগের অন্তিমপর্বে ও প্রাক-আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসের কথা। ইতালিতে গণিত ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানের যে যুগান্তকারী অগ্রগতি ওই সময়ে হয়েছিল, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল ইতালির সমুদ্রবাণিজ্যে সাফল্যের তাগিদ। এমনভাবে কি আর্যভটের তত্ত্বকে দেখা যায় না? বিশেষ করে দেবীদা বলেছিলেন অন্তত একজন প-িতের মতে আর্যভট উত্তর ভারতের নয়, কেরালা উপকূলের মানুষÑ যে উপকূল ভারতে ও ভারত মহাসগরের সমুদ্র ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ভারতের সমুদ্র ইতিহাস চর্চায় যে আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে তা দেবীদা বিলক্ষণ জানতেন। ফলে কোনোক্রমে বললেন, তুমি চেষ্টা করে দেখা না আর্যভটের গাণিতিক ও জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক তত্ত্ব ও মালাবার উপকূলের সমুদ্রবাণিজ্য নিয়ে কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় কি না। এরই সঙ্গে প্রায় এক নিশ্বাসে বলে গেলেন আর্যভট সম্বন্ধে কিছু প্রামাণিক বইপত্র ও প্রবন্ধাবলী; উদ্দেশ্য, আমি যেন ঐগুলো পড়ে যথাশীঘ্র ওর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি ও নিবন্ধ লেখায় হাত লাগাই।”
কী অসামন্য ও বিস্ময়কর জীবনচেতনা! রোগযন্ত্রণাকে তুচ্ছ করে, মৃত্যুভয়কে মনের কোণেও ঠাঁই না দিয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধানে নিরত থাকতে পারেন, বিজ্ঞানের আলোকে নিজে প্রদীপ্ত হয়ে উঠতে ও অন্যকেও সে রকম হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন- দেবীপ্রসাদের মতো এমন আশ্চর্য মানুষের সংখ্যা তো সারা পৃথিবীতেই একেবারে অঙ্গুলিমেয়।
আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি : দেবীপ্রসাদ মৃত্যুর অন্তরে প্রবেশ করেও অমৃতের সন্ধান করে গেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
পৃথিবীর ইতিহাস : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্র, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
ভারতীয় দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এনবিএ, কলকাতা।
লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা।
ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
ভাববাদ খণ্ডন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
বিজ্ঞান কি ও কেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মুক্তধারা।
লেখকের আরো বই পড়ুন এখানে