বাংলাদেশে হরহামেশাই শিক্ষারমান নিয়ে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। তা হোক। এসব বিতর্কের ভালমন্দ দু'দিক রয়েছে। সমস্যা উত্তরণে ও উৎকর্ষ সাধনে যুক্তিতর্কের বিকল্প নেই। কিন্তু কেবল বিতর্কে জয়ী হবার নিমিত্তে কুতর্ক করা অর্থহীন। নবীন প্রবীণের অংশ গ্রহণ বিতর্ককে করছে প্রাণবন্ত। জীবনযুদ্ধের শেষ প্রান্তে চাওয়া-পাওয়ার গরমিলে প্রবীণেরা হতাশ। কিন্তু তরুণেরা চিরকালই আশাবাদী। এটাই স্বাভাবিক। আশাবাদী তরুণেরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বুনতে পারে। এসব স্বপ্ন সারথীদের অনুসন্ধিৎসু মনের উৎকর্ষই সফলতার পূর্বশর্ত।
অনেকে বলেন আমাদের শিক্ষার মানের অবনমন ঘটেছে। কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। তবে এটি অনস্বীকার্য যে আধুনিক সভ্যতার সাথে তালমিলিয়ে পা রাখতে পারছে না বাংলাদেশ। এটা প্রমাণ করার জন্য ঝানু বিতার্কিক বা তর্কবাগিশ হবার দরকার নেই। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। একটা সময়ে ইরান, ইরাক, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও আফ্রিকার দেশ গুলো থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। সংখ্যাটা এখন প্রায় শূণ্যের কোটায়। এখন আমরা দলদলে দেশ ত্যাগ করি। কারণ অনেক। মোটা দাগে- রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, শিক্ষাব্যবস্থার অপকর্ষতা অথবা অন্যদের তুলনায় আমাদের পিছিয়ে পড়া দায়ি। দায়ি আমাদের লক্ষ্যহীন নিরুদ্দেশ যাত্রা।
নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ পরিহার করে ইতিবাচক হতে দোষ কি? অনেক অতৃপ্তি আছে, তথাপি আমাদের শিক্ষণ পদ্ধতি একেবারে মন্দ নয়। স্বপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বেশ সুনামের সাথে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে ও গবেষণা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন বা গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় আমাদের অবস্থান তলানীতে। এক্ষেত্রে আমাদের মান ও অবস্থান মোটেই সুখকর নয়। সংখ্যায় আমরা সমৃদ্ধ হলেও মানে বিতর্কিত। তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কি?
বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর র্যা ঙ্কিং(ক্রম) নিয়ে হৈচৈ হয়। ধুমকেতুর মত উঁকি দিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সমালোচনার সাথে সাথে কারণ অনুসন্ধান করে সমাধানের চেষ্টা করাই সমীচীন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো উচ্চতর গবেষণায় এত পিছিয়ে আছে যে বিশ্ব সভায় এদের স্থান করে নেয়া এত সহজ নয়। আমাদের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় (Primarily Undergraduate University) টিচিং বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও প্রতিবছর বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রী পাচ্ছে বা নিচ্ছে। তথাপি সারাদেশে এক মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে (Comprehensive University) সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় বলা যেতে পারে। কানাডাতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে জাতীয়ভাবে অবস্থানের ক্রম ঠিক করা হয়। যেমনঃ Primarily Undergrade University, Comprehensive University, Doctoral University. কানাডাতে ১৬-১৭টি ডক্টরাল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় (Graduate studies and Research) গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সে অর্থে বাংলাদেশে কোন ডক্টরাল বিশ্ববিদ্যালয় নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আমাদের নেই। নেই উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেই, নেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। তবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ঠিকই আছে। আর সহযোগিতা (Collaboration)-তা সুদূর পরাহত।
যুক্তরাজ্যে প্রতি ছয় বছর অন্তর জাতীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর গবেষণা কর্মের মূল্যায়ণ করে পরবর্তী ছয় বছরেরে গবেষণা অনুদানের সরকারী বরাদ্দের অংশ ঠিক করা হয়। এবছর অক্সফোর্ড তালিকার প্রথম স্থানে আছে। আমাদের দেশে এভাবে মূল্যায়ণের সুযোগ সীমিত। কারণ সুস্থ প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত। আমরা পদার্থবিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাসে (অবজ্ঞার্থে নয়) সমান বরাদ্দ দিই। যুক্তরাজ্যে ২৪-২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা গবেষণায় অধিকতর গুরুত্ব দেয়। যে গুলো রাসেল (Russel Group University) গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
আমাদের সম্পদ অপ্রতুল, সুযোগ সীমিত, সমস্যা পাহাড়সম। তাই বলে রণে ভঙ্গ দিলে চলবে না। চাই সম্পদের সুষম বন্টন। শেয়ার করা বা সহযোগিতার মানসিকতা। যাতে যৎসামন্য সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা যায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা অন্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোর মাঝে বিনিময়ের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। যাতে সীমিত সম্পদে সবার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এর বিকল্প নেই। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগ দিতে হবে। এমুহূর্তে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই ফিবছর একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্বাচন করে সংস্কার কাজ করতে হবে। পক্ষান্তরে, সরকার একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান করতে পারে যাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশাধিকার থাকে। জেলায়-জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মানোন্নয়নে মনোনিবেশ করাই শ্রেয়। উচ্চশিক্ষার মানের বিষয় অনমনীয় মনোভাবে পোষণ করতে হবে। উচ্চশিক্ষা অধিকার নয়। এটা অর্জন করার বিষয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ''আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার লালবাগ থেকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগারের নয় একর জায়গা জনগণের জন্য একটি পার্ক ও দুটি জাদুঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হবে'' (সূত্রঃ প্রথম আলো,২৩শে ডিসেম্বর,২০১৪)।'' নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতী উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করলে জায়াগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব। জাতীয় নেতৃত্বকে বুঝতে হবে শিক্ষাবিপ্লব ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। উচ্চতর গবেষণা শিক্ষাবিল্পবের দ্বার উম্মোচন করতে পারে।
কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গাটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেবার জন্য বেশকিছু লেখালেখি হয়েছে। জগন্নাথকে না দিলে, কারাগারের জায়গাটাতে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যার স্টেকহোল্ডার হতে পারে ঢাকবিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, লেদার টেকনোলোজি তথাপি সমগ্র বাংলাদেশ। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিয়ে, উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আধুনিক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে পারে নতুন প্রজন্ম। উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির সাথে একটি বিজ্ঞান জাদুঘর ও একটি সাইন্সপার্ক হতে পারে। এতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ণ হতে পারে। উক্ত অঞ্চল ঘিরে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন দেখতে পারে। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ যেমনটি করেছিল যুক্তরাজ্যে। আমাদের দেশে দু'য়েকটি প্রথাগত উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও দেশ খুব বেশীকিছু পায়নি।
সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণাবিমুখ শিক্ষকদের ফিরিয়ে আনতে পারে শিক্ষণ ও গবেষণা কর্মে। বন্ধ হবে নোংরা শিক্ষক রাজনীতি। দেশের বাহিরে স্বনামধন্য গবেষকদের ফিরিয়ে আনা যেতে পারে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। ভারতে যে কাজটি পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু করেছিলেন ৬৫ বছর আগে। যার ফল ভোগ করছে আজকের ভারত। বর্তমানে যেমনটি করছে ভারতে প্রেসিডেন্সি ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্ভব না হলে সৌদি আরবের King Abdullah University of Science and Technology (KAUST) এর মত স্বনামধন্য বিদেশী গবেষকদের আমন্ত্রণ করা যেতে পারে। অন্যরা পারলে, আমরা কেন নয়। কারাগারের জায়গাটি থেকে বাংলাদেশের কারামুক্তির সূচনা হোক।