বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ২০তম কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের সর্বসম্মতিক্রমে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন জনাব ওবায়দুল কাদের। তিনি এমন একসময় দায়িত্ব পেয়েছেন যখন আওয়ামীলীগ তার যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত। ৬৭ বছরের পুরানো আওয়ামীলীগ অনেক পরিণত। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছে। প্রতিনিধিত্ব করছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অসামান্য আশা জাগিয়েছে বর্তমানে সরকারে থাকা দলটি। এমন একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকে পদ অলংকৃত করা যেমন আনন্দের তেমনি চ্যালেঞ্জিং বটে।
কথায় আছে, Think global be local. সম্ভবত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জনাব ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনে এ দর্শন কাজ করেছে। মেঘনার পূর্বপাড়ে আওয়ামীলীগ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহের তুলনায় খানিকটা পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামীলীগের জনসমর্থন ও সাংগঠনিক অবস্থা তেমন ভাল নয়। এক সময়ে মালেক উকিল, মিজানুর রহমান ও মোহামুদুল্লার মত ডাকসাইটে আওয়ামীলীগ নেতা থাকা সত্ত্বেও মেঘনার ওপারে আওয়ামীলীগের রাজনীতি ততটা বিকশিত হয়নি।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার উত্থান ঘটে। খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় হবার কারণে এতদঞ্চলে বিএনপি’র একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরী হয়। বিএনপি’র সাথে গাটঁছাড়া বেঁধে জামাত মেঘনার পূর্বপাড়ে বড় একটা শক্তি সঞ্চয় করে। কথিত আছে, কেবল বৃহত্তর নোয়াখালীতে ইসলামী ছাত্রীসংস্থার প্রায় তিন হাজার সক্রিয় কর্মী আছে। মেঘনার ওপারে যে বিএনপি, জামাতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে তা আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে প্রতিয়মাণ হয়। এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির পুরোপুরি দখলে নেয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও অত্র অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিবির ও ছাত্রদলের সুপ্ত তবে প্রকট প্রভাব রয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে তা যে কোন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিচালনা অথবা মালিকানায় কোন না কোনভাবে শিবির বা জামাত জড়িত। সে সব দিক বিবেচনা করে অতিসম্প্রতি বৃহত্তর নোয়াখালীর অধিবাসী মুকবু্ল আহাম্মদকে জামাতের নায়েবে আমির নির্বাচিত করা হয়। মেঘনার ওপারের লোকেরা ঐতিহ্যগতভাবে কিছুটা ধার্মিক হয়। তাদের এই ধর্মভক্তিকে কাজে লাগিয়ে এতদঞ্চলে সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করার পরিকল্পনা রয়েছে জামাতের। অত্র অঞ্চলের ব্যাংক-বীমা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজকল্যাণ সংস্থা, মাল্টিপারপাস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বিএনপি জামাত সমর্থকদের দখলে।
মেঘনার ওপারে আমোয়ামীলীগের সাংগঠনিক অবস্থা বাহ্যত ভাল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ততটা সংগঠিত নয়। অতীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট হয় যে, দেশের অপরাপর অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে আওয়ামীলীগ অনেক পিছিয়ে আছে। পক্ষান্তরে, বিএনপিকে এক সময় বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতি বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি’র অনেক নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া ২০১৪ সালে আন্দোলনের সময় গোপালী ও গোপালগঞ্জ আর থাকবে না এরূপ অবিমৃশ্যকারী মন্তব্য করে আঞ্চলিকতার চেতনা উস্কে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় বিএনপি ধীরে ধীরে ঘুঁটিয়ে নোয়াখালী ও বগূড়ার দিকে যাচ্ছে। আর শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগকে সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত করার জন্য নোয়াখালীকে প্রমোট করছে। তাতে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের নেতৃ বলে বিবেচিত হচ্ছেন। গণমাধ্যম বিষয়ক সচিব হিসাবে জনাব ইকবাল সোবাহান ও সেনাবাহিনীর প্রধান জনাব শফিউল হকের নিয়োগ ও ঢাকার মেয়র আনিসুল হককে নেতা বানানোর পিছনে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। এক্ষেত্রে তার পুরানো দিনের সহচর জনাব আবদুল আউয়াল মিন্টুকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি সঞ্চিত হয়েছে।
দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে শেখ হাসিনা যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জন করেছেন তার প্রতি আওয়মীলীগের সকল স্তরের নেতা কর্মীর আস্থা রয়েছে। জনাব কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজনীতির খেলায় সূক্ষ একটা চাল দিয়েছেন তিনি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ভদ্র ও সজ্জন ব্যক্তি। মৃদুভাষী এ রাজনীতিক নেতা দলে খুব জনপ্রিয়। ২০০৮ সালে উত্তাল রাজনীতির ভাঙ্গাগডার খেলায় পরীক্ষিত এ রাজনীতিবিদ দলের হাইকমান্ডের খুব আস্থাভাজন। কিন্তু ভোটের ও মাঠের রাজনীতিতে তাঁর নিষ্ক্রিয়তা প্রায়শ আলোচিত হয়েছে। তাই ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে খুব বিচক্ষণতার সাথে ওবায়দুল কাদেরকে দৃশ্যপটে নিয়ে এসেছেন। বর্ণাঢ্য রাজনোইতিক জীবনে জনাব কাদেরের জনসম্পৃক্ততা প্রশ্নাতীত। পরিশ্রমী, সুশিক্ষিত, পরিশীলীত, কিছুটা নাটকীয় ও বাগ্মী প্রাক্তন এ ছাত্রনেতা হাটে-ঘাটে বিচরণের অভ্যেস ভোটের রাজনীতিতে আনুকূল্য লাভের প্রচলিত প্রন্থা।
তাছাড়া প্রেসিডেন্ট, স্পীকার, প্রাক্তন সধারণ সমাপদক ও ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জনাব জিল্লুর রহমান বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিধায় এ অঞ্চলে আওয়ামীলীগের শক্ত অবস্থান রয়েছে। ঢাকা, খুলনা আওয়ামীলীগের অবস্থান তেমন মন্দ নয়। আসাদুজ্জামান নূর, জুনায়েদ আহমদ পলক ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের কারণে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের নবীন প্রবীনের মাঝে আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। সিলেট অঞ্চলে দলটির অবস্থা বরাবরই ভাল ছিল। তাছাড়া জনাব সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর বিয়োজনে বাবু সুরঞ্জিত, নাহিদ ও মূহিত মিলে সিলেটে একটা জোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছে। সে তুলনায় মেঘনার ওপারে আওয়ামীলীগের নড়েবড়ে বললে অত্যুক্তি হবে না। সে বিবেচনায় জনাব কাদেরর সাধারণ সম্পাদক পদের যথার্থতা প্রশ্নাতীত। জাতীয় ও অন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ শেখ হাসিনা সূদূর প্রসারী লক্ষ্য সামনে রেখে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করেছেন এবং নেতা-কর্মীরা তা বিশ্বাসও করেন।
আওয়ামীলীগের রাজনীতির জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে অনুর্বর অঞ্চলে সাধারণ সম্পাদকের বীজ বপন করে জননেত্রী যে দেশনেত্রীও তা প্রমাণ করেছেন। ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার জন্য জনাব কাদেরের জনসম্পৃক্ততা আওয়ামীলীগের জন্য সম্পদ। তাছাড়া দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিরোধী দলের অনেক নেতার সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ সম্পর্ক ও তার ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা ভোটের রাজনীতিতে সুফল বয়ে আনতে পারে।
তথাপি সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জনাব কাদের কতটা সফলতা দেখাতে পারেন সে প্রশ্ন সময়ের কাছে রেখে দেয়াই উত্তম। আমরা আশাবাদী হতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুভ সময় ফিরে আসুক। মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হোক। তা রাজনৈতিক দল গুলোর মাঝে সঞ্চারিত হোক। আমরা যে যেই মতবাদ ধারণ করি না কেন দিনশেষে দেশটা কিন্তু আমাদের সবার। জয় হোক বাংলাদেশের।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:৪৩