somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প দা তি ক

১৭ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিংক----পদাতিক/২১



২২
রেললাইনের পাশে বস্তি হলেও এটা শহর কলকাতার উপকণ্ঠ। শিলিগুড়ির সেই বস্তির সঙ্গে এর অনেক তফাৎ। ঐখানে সামাজিকতা ছিল না। এখানে আছে। ধীরে ধীরে সুবোধ এই শহরের স্পন্দন নিজের ভেতর অনুভব করতে শুরু করলো। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এখানে সড়গড় হয়ে উঠলো জাহানারা। মহিলারা মহিলাদের সঙ্গে খুব সহজেই কথা বলতে পারে এখানে। সে হিসেবে এখানে দু’একজন মহিলার সঙ্গে সে পরিচিতও হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। বাসাবাড়ির কাজেরও কথাও কেউ কেউ বললো। বোঝা যায় এখানকার অধিকাংশ বউ ঝি’রা ‘বাসাবাড়ির কাজ’ নামক একপ্রকার কাজ করে থাকে। জাহানারার জানা ছিল না কাজটা আসলে কী। তবে পরিচিতরাই তাকে বলে দিল কাজের ধরন, কাজের খবর। প্রতিদিনের এই জন-জীবনের অভিজ্ঞতা সুবোধ আর সে সাধারণত রাতেই বিনিময় করে। তাদের কথা বলার বিষয় এখন তাদের নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা।

এই করে করে জাহানারার কাছে ‘নতুন’ মানে ভয়, এটা কিছুটা কেটেছে মনে হলো। এদিকে দিন তিনেক ঘোরাঘুরি করে সুবোধও একটা কাজ জুটিয়ে ফেলল। সুবোধের সঙ্গে কথা বলে জাহানারা একটি কাজের বাড়ি ঠিক করে নিলো। একবেলা খাওয়া সহ মাসে তিনশ টাকা বেতন। টাকার অংক শুনে জাহানারা বিশ্বাস করতে পারে নি। মাস শেষ হলে সে হাতে তিনশ টাকা পাবে? এই প্রথম তার শরীরী ভাষায় আনন্দ আর বিস্ময় এক সঙ্গে ধরা পড়লো। কাজ কী করতে হবে? না—রান্না ছাড়া ঘরের যাবতীয় কাজ । তা হউক, এই কাজ আর এমন কী ! তবে দু বেলাই তাকে যেতে হবে। রান্না গিন্নি-মা’ই করবেন। তবে সব জোগাড় করে দিতে হবে হাতে হাতে।

দিনে একবেলা খাবারও জুটে যায়। কাজের বাড়িতে না খেয়ে জাহানারা সেই খাবার ঘরেই নিয়ে আসে। বাড়ি এসে সে স্নান-টান করে খায়। এদিকে লেখাপড়া জানার সুবাদে সুবোধ শেষপর্যন্ত এক ঠিকাদারের কাছে কাজ পেয়েছে। সকাল আটটার মধ্যে তাকে চলে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত ন’টা। ফলে জাহানারা কাজের বাড়ি থেকে ফিরে সন্ধেবেলা রান্না করে। সুবোধ ফিরলে দুজনে একসঙ্গে খায়।


এখন জাহানারা একটি বাড়িতেই কাজ করে। কিন্তু আরো দুই বাড়িতে করার জন্য তাকে খবর দিচ্ছে। সে যায় না। সুবোধ বারণ করেছে। এই-তো স্বাস্থ্যের অবস্থা। কাজের ধকল সহ্য করতে না পারলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই নিয়ে প্রতিবেশী দু’একজন কাছাকাছি বয়সী মহিলা রসিকতাও করে। বলে—ওমা বউ এর শরীলের দিকে কত্ত নজর-গো কর্তার ! কী ভালো-মানুষ কর্তা-গো তোমার ! কত ভাগ্য তোমার। অবশ্য নতুন বউ—অত কাম দিয়া দরকার কি! বলে আর চোখ টিপে হাসে তারা। জাহানারা লজ্জায় মাথা নিচু করে। সে ভেতরে ভেতরে একটু কেঁপেও ওঠে। হায়, সুবোধ আমার স্বামীও না—তার সঙ্গে আমার বিয়েও হয়নি—আসলে সে আমার কে—সেটাই-তো এখনও জানি না । তবু সে একজন যুবক—এক সঙ্গে, এক ঘরে থাকি—পরিচয়, স্বামী স্ত্রী—মিথ্যা পরিচয়। এই মিথ্যার এত ওজন আমি বই কেমনে? পেছনে আছে কমল নামক পাষণ্ডের কব্জায় কয়েক মাসের বন্দী জীবন। সেটাই বা মুছি কেমনে। হায় আল্লাহ্‌,—দয়া কইরা আমারে একটু পথ দেখাও। দয়া কইরা আমার মুখে কথা জুগাইয়া দ্যাও—আমি-তো কিছু কইতেও পারিনা, সইতেও পারি না—নাইলে মানুষের কথা শুইন্যা-তো একদিন বুক ফাইট্যা মরুম আমি---।

কাজের ফাঁকে জাহানারা দুপুরে একবার ঘণ্টা তিনেকের জন্য ঘরে আসে। একটু শুয়ে বসে কাটায়। ইদানীং তার ভয়টা কেটে গেছে। রাতে ঘুমনোর আগে প্রতিদিনের ফোঁপানিটাও এখন আর নেই। হিন্দু বউদের মত সে মাথায় কপালে সিঁদুর পরতে ভোলে না। বাসাবাড়ির কর্ত্রীও ক’দিন থেকে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে । তাঁর কথা হলো—হাতে শাখা নেই কেন—বিয়ে কতদিন হলো—বাচ্চাকাচ্চা নেই কেন—বাপের বাড়ি কোথায়—সাবধানে থেকো মেয়ে—বস্তির পরিবেশ—গুণ্ডা বদমাইশের অভাব নেই—ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে মনে ভাবে সুবোধকে বলতে হবে একজোড়া শাঁখা আনার জন্য। যদিও কর্ত্রীকে বলেছি কাজের সুবিধার জন্য খুলে রাখার কথা। তাহলেও হাতে নাকি লোহার কী একটা পরতে হয়। এসব কথা সুবোধকে বলা যে কত লজ্জার তা কে বুঝবে ! এ ছাড়াও বলতে হবে দুপুরে একবার আসার জন্য। বাইরে বাইরে কী খায় না খায়, এলে এক সঙ্গে বেশ, যা থাকে তাই খাওয়া যায়। কিন্তু বলতে পারে কই। এসব নিজের কোন কথাই সে আর বলতে পারে না। রাতে ফিরে সুবোধ এত ক্লান্ত থাকে যে বেশি কিছু কথা বলার উপায় থাকে না। খাওয়ার পর খুব বেশি জেগেও থাকতে পারে না।


দুপুরে আজ ঘরে ফিরে জাহানারা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। অথচ এই প্রান্তিক মানুষদের সামাজিকতা তাকে অনেকটাই উৎফুল্ল করে তুলেছিল। সুবোধও লক্ষ্য করতো যে একটা বয়সোচিত চাপল্য এসেছে জাহানারার মধ্যে। মনুষ্য-শিকড়ে সে জল পেতে শুরু করেছে। কিন্তু আজ রাতে ঘরে এসে সুবোধ টের পেলো জাহানারা একটু গম্ভীর । কথা প্রায় বলছেই না। খাওয়া দাওয়ার পর সে নিজের খাটিয়ার উপর বসেই বিড়ি ধরায়। খাটিয়াটা বাইরে পড়েছিল। ঘরের মালিককে বলে সেটা সে ঘরে টেনে এনেছে। এটাই তার বিছানা হয়েছে। আজ সে খাটিয়ায় না বসে জাহানারার চৌকিতে গিয়ে বসল। তার বিড়ি-খাওয়া শেষ হতে হতে জাহানারাও এসে গেল। জিজ্ঞেস করলো—
--আচ্ছা, তোমার কি হয়েছে আজ—এত চুপচাপ? এখানে কি এখনও ভয় করে?
--ক্যান, এই কথা জিগাইছেন ক্যান?
--না, কাজের বাড়ি বাদ দিলে বাকি সময়টা-তো প্রায় একা একা থাক—কেউ কিছু জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে না তো?
--না-তো!
--ঠিক আছে, ভাবছি হাতে-তো কিছু টাকা জমেছে—এর সঙ্গে সামনের মাসের টাকাটা পেলে ওপারে চলে যাব। এক দালালের খোঁজও পেয়েছি। তার বাড়ি হাবরার দিকে। দু’জনের জন্য তিনশ টাকা নেবে। এটাই তার রেট।
জাহানারা সুবোধের কথাগুলো একদমে শুনে শেষে দম ছাড়লো। ভাবতে লাগলো কী বলা যায়। এরমধ্যে সে ব্যস্ততা দেখানোর জন্য সুবোধের বিছানা দ্বিতীয়বার ঝেড়ে পাতলো। তারপর একসময় নিজের বিছানার এক কোণে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লো। ধীরে ধীরে ভাবতে লাগলো সুবোধ একজন এমন মানুষ যাকে সে এখনো চিনে উঠতে পারে নি। জন্মাবধি দেখা খুব কাছের বা পরিচিত জনের মধ্যে এমন কাউকে সে কস্মিনকালেও দেখেনি। এটা তারই ব্যর্থতা। ভাবতে ভাবতে জাহানারা একবার বুকভরা দম ছাড়লো। কিন্তু চুপচাপই আছে।
কিছু বলছে না দেখে সুবোধ আবার জিজ্ঞেস করলো—
--কী যাবে-তো?
--না।
--না মানে?—আসার সময়ই-তো বলছিলে বাপের কাছে দিয়ে আসার জন্য—
--আপনে কই যাইবেন? বলছিলেন যে ওপারে গেলে আপনের বিপদ আছে—
--আমার কথা বাদ দাও। আমি যেখানে খুশি থাকতে পারি, যেতে পারি—আমার ব্যাপার—থাক ও সব কথা। তোমার কথা কও।
--হ—‘না’—ই আমার কথা। যামু না কোথাও। মরলে বাঁচলে এখানেই—তখন বলছিলাম—তখন কি মাথার ঠিক আছিল না কি—আপনেরও দেখি মাথা-ডা গেছে—ঘর ছাইড়া আসা মাইয়া মানুষেরে ওপারে গেলে বাপ ক্যান, আল্লারও ক্ষেমতা নাই ঘরে তোলে। আপনে আমারে এইসব কথা কইয়েন না আর।
বলতে বলতে জাহানারা কেঁদে ফেলল। আর এই প্রথম কাঁদতে গিয়ে সে মুখও লুকোলো না, মাথার থেকে সরে যাওয়া কাপড়ও ঠিক করলো না। এবার সে সুবোধের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কাঁদতে থাকলো। বলতে লাগলো—আমি যামু না—না না না—এই কথা আমারে কইয়েন না—এই কথা শুনার থাইক্যা আমার মরণও ভালা---
সুবোধ খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগলো। না জেনে কি খুব কঠিন কিছু আঘাত করে বসলাম! আমি-তো ওর বলা কথাটাই ওকে বললাম! কাঁদতে থাকা জাহানারার এই খোলামেলা মুখ দেখে সুবোধ আবার একটা বিভ্রমে নিজের চিন্তা ভাবনাই গুলিয়ে ফেলতে শুরু করলো।
(ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×