somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প দা তি ক

১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিংক----- পদাতিক/২০

২১
এক সময়ে শোনা যেত নদী-তীরগুলোই ছিল মানুষের আবাস স্থল হিসেবে প্রথম পছন্দের।জীবন, জীবনের সম্পদ তৈরি করার জন্য নদী-তীর থেকেই মানুষের যাত্রা শুরু হতো। কিন্তু আজ বুঝি এই চিত্রটা বদলে গেছে। নদীর জায়গা নিয়েছে রেল লাইন। সেই মানুষের জায়গা নিয়েছে এক নতুন প্রান্তিক মানুষ। রেল লাইনের ধারে ধারেই আজ গড়ে উঠেছে সেই প্রান্তিক মানুষের জীবন। নির্মিয়মান এই জীবনে টিকে থাকার জন্য দরকার শুধু শরীর। অথচ শরীর এক ভঙ্গুর জিনিস। ভাঙা, খোঁড়া, মালিন্য তার আবহমানের সঙ্গী। তবু শরীরময়তা দিয়েই শরীরের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে হয় এখানে। এখানে অন্য কিছু কাজে আসে না। সুবোধ ক্রমশঃ চিনে ফেলছে এই শরীরের জাত।

শহরতলী বুঝি এটাকেই বলে ! না, শহরের তলা ! জাহানারার কাছে কথাটাও নতুন, জায়গাটাও নতুন। ঘরের দরজা খুললেই পাশাপাশি অনেক ক’টা রেল লাইন। অনবরত রেলগাড়ি যাচ্ছে আর আসছে। লোকে গিজগিজ করা কামরা। এত মানুষ কোথায় যায় ! কিন্তু এ-সবই নতুন আর ভয়াবহ তার কাছে। অবাক হওয়ার চেয়ে সে ভয়ই বেশি পায়। একটানা অনেকদিন নতুন আর ভয়াবহতার চাপে জাহানারা এখন আর কোনো কিছুকেই সহজে মেনে নিতে চায় না। সুবোধ লক্ষ্য করে যে পৃথিবীর সব ভয় যেন জাহানারার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তত তার চোখ দেখে সুবোধের তাই মনে হয়।

বর্ডার পেরিয়ে এপারে ঢোকার পর সুবোধ একবার তার টাকার হিসেব করেছিল। তারপর আর করে নি। ঊর্মিলার ওখানে কিছু খরচ করার পর যা ছিল তা একটা খামের মধ্যেই এতদিন ছিল। এবার খরচ করতে করতে একদিন ভাবলো যে গুনে দেখে টাকাটা। মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় ঘরটা নেয়ার পর আজই তারা দু’জনে মিলে সামান্য কিছু বিছানাপত্র, থালা বাসন, একটা কেরোসিন স্টোভ ও আরো কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কেনার জন্য যাবে বলে স্থির করেছিলো। কিন্তু জাহানারার পক্ষে বাজারে যাওয়া অসম্ভব মনে হলো। তার পরনে সেই থেকে একখানি-ই কাপড়, যার অবস্থা এখন খুব খারাপ। ঘাম-চিটে ব্লাউজও তার আর গা’এ নেই। ঘরের কোণে ফেলে রাখা হয়েছে। কাপড়টাই কোনোমতে গা’এ জড়ানো। অগত্যা সুবোধ একাই গেল। বালিগঞ্জ স্টেশনের ওপাশ থেকে সে কেনা কাটা করলো। তার মধ্যে জাহানারার জন্য দুটো অল্প দামের শাড়ি,দুটো ব্লাউজ ও সায়া কিনলো। জীবনে প্রথম মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্রাদি কিনতে কিনতে সুবোধের এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। অনর্থক মনে একটা খুশির ভাবও তৈরি হলো কেন কে জানে। ঘরে ফিরে সমস্ত জিনিস নামাতে নামাতে জাহানারাকে বললো—এখুনি শাড়িটা পালটে নতুন শাড়িটা পরে ফেল। একসাথে এতগুলো জিনিস দেখে জাহানারা বাকরুদ্ধ। সুবোধ জাহানারার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করে টাকা গুনতে বসে গেল। গুনে দেখলো আর মাত্র একশ চল্লিশ টাকা পড়ে আছে। আরো কিছু কেনা দরকার। মানুষ-তো দু’জন। কিন্তু বসবাস করতে গেলে আরো কতকিছু লাগে। টাকা গুনে পকেটে ঢুকিয়ে সে বাইরে গিয়ে বিড়ি ধরালো।

জীবন বুঝি এভাবেই শুরু হয়! সুবোধ ক্রমশঃ বুঝতে পারছে এটা ভাবনাতেই সম্ভব। বাস্তবে একদম না। জীবন শুরু করার জন্য আজকের পর আগামীকাল বাঁচতে হয়।তার বা তাদের বাঁচার জন্য কী আছে? কিছু না। তবে প্রয়োজনে বাঁচার জন্য ভিক্ষা দিয়ে শুরু করা যায়। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? না, সম্ভব না। তাই এই মুখচোরা ছেলেটিকে বদলাতে হবে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতে হবে। আর কিছু না, একটা কাজ যে করেই হোক যোগাড় করতে হবে।
বস্তি থেকে চলে আসার পর আজই প্রথম তাদের এক ঘরে, এক সঙ্গে থাকা। জাহানারার পক্ষে এটাও একটা ঘটনা, যা তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। সুবোধকে সে কতটুকু জানে, কতটুকু বিশ্বাস করে—এটা আবার নতুন করে সে ভাবতে চাইছে। ভাবতে চাইছে তার ছোট্ট একটা জীবন কীভাবে ভাসছে—ভাসার মধ্যে স্বস্তি কোথায়, আনন্দ কোথায়—এত শুধু ভয় আর ভয়। নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভয়।
তবু আজ একটা ঘর পাওয়ার অনুভূতি জাহানারার সর্বাঙ্গে। সুবোধ ‘একটু আসছি’ বলে আবার বের হয়ে গেলো। এই সুযোগে সে একটু আগে স্নান সেরে এসেছে। আঃ ক’দিন পরে স্নান! শরীর জুড়িয়ে গেছে যেন। খুব লজ্জা লাগছিল নতুন কাপড় পরতে। পরতে-ত হবেই, কারণ পরনের কাপড়-তো আর গা’এ রাখা যাচ্ছিল না। কী লজ্জার কথা! এই সুযোগে সে যত্ন করে সেটা ধুয়েও নিয়েছে । জিনিস পত্র একটু গোছ-গাছ করে সে তাড়াতাড়ি বিছানাও বিছিয়ে নিল চৌকির উপর। ভাড়ার ঘরে এই একটি মাত্র জিনিসই ছিল। পরনে নতুন কাপড়, চৌকির উপর নতুন বিছানা, তার ভেতর এক অদ্ভুত অবিশ্বাস তৈরি করতে শুরু করলো। অতিক্রমের এই ধাপ সে যেন গ্রহণ করতে পারছে না। খুব অসহায় লাগছে তার। সুবোধ ঘরে নাই বলে অনেকক্ষণ সে মাথায় কাপড় রাখেনি। সঙ্গে আনা পুরনো শুকনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভেজা চুল ভাল করে জড়ানো। কিন্তু চোখে তার জল। কিছু সময় সুবোধের না-থাকাটা যেমন তার স্বস্তি তৈরি করেছিল, তেমনি এখন সুবোধের না-আসাটাও তার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে। এই সব ভাবতে ভাবতে সে বিছানার একপাশে এক সময় নিজের অজান্তেই একটু কাত হলো ।

কাজের সন্ধানের কথাটা সুবোধের মাথাতেই ছিল। একটু আগে সে যে দোকান থেকে বেশ কিছু জিনিস কিনেছে তার মালিককেই দাম দেয়ার সময় অনুরোধ করেছিল যে কাজ কর্মের কোন খোঁজ আছে কিনা—যে কোন ধরণের কাজ। দর-দাম করার সুত্রে তার পছন্দ হওয়াতেই সে জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেয়েছিল। দোকান মালিক তখন তাকে কিছু সময় পরে যেতে বলে। আপাতত সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে সেই কথা-বার্তা হলো। এদিকে দেরি হচ্ছে দেখে সুবোধ নিজেই ভাবছিলো জাহানারা ভয় পেতে পারে। তাই সে কথা-বার্তা সেরে সস্তার এক হোটেল থেকে তাদের দু’জনের জন্য রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এল।

হন্তদন্ত হয়ে সুবোধ ফিরলো প্রায় এক ঘণ্টা পর। সন্ধে উতরে গেছে । দোর ভেজানো। ভেতরে অন্ধকার। বাইরের দিকে রাস্তার আলো রয়েছে ভাল। সুবোধ ঘরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে দেখে জাহানারা শুয়ে আছে। পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করে সে প্রথমে আজই কিনে আনা মোমবাতি খুঁজে নিয়ে আলো জ্বালালো। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল জাহানারা শুয়ে আছে । পরনে নতুন কাপড়। বোঝা গেল গভীর ঘুমে। ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতে সে ডেকেই বসলো—এই-যে ওঠ, খাবে না—কী হলো, ওঠ--। কিন্তু জাহানারার কোন সাড়া নেই। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সামান্য’হা’ হয়ে আছে মুখ। চুপসানো। গালের হনু দুটো বেশ উঁচু হয়ে আছে। মাথার চুল খোলা। কেমন যেন অচেনা লাগছে। জাহানারাই-তো, নাকি অন্য কেউ!
আসলে জাহানারার মুখ কি সে ঠিক মতো দেখেছে কখনো? একজন মানুষকে সনাক্ত করতে গেলে যা যা দেখা দরকার তার কিছুই-তো সে দেখেনি। সেই থেকে আজ অবধি সে জাহানারার সম্পূর্ণ মুখ কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। আচ্ছাদনের বাইরে থেকে একটা ছোটখাটো কাঠামো দেখা আর ফ্যাসফ্যাসে একটা গলার স্বর শোনা ছাড়া তার আর কোন স্মৃতি নেই। সুবোধ খুব বিপন্ন বোধ করতে লাগলো।
কতক্ষণ এভাবে সময় কাটছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা কঁকিয়ে ওঠা আওয়াজ—ভাবলো, জাহানারা জেগেছে। তড়ি ঘড়ি নিভিয়ে দেয়া মোমবাতিটা জ্বালাতে গিয়ে চমকে উঠলো। শুনতে পেল জাহানারা কান্না-চাপা গলায় বলছে—কেডা, ঘরের মইধ্যে কেডা। ‘আমি আমি’ বলে সুবোধ যতই মোমবাতিটা নিয়ে কাছে এগোয়, জাহানারা ততই প্রায় নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা বালিশ চাপা দিয়ে—‘না না না’করতে লাগলো। সুবোধ আর সাহস পেল না আলোটা নিয়ে এগোতে। সেটা সামনে নিয়েই মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। সে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লো যে, টের পেল তার দু’চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। জাহানারার দিকে সরাসরি আর না তাকিয়ে আড়চোখে একসময় দেখলো যে জাহানারা আবার শুয়ে পড়েছে। এবার সুবোধ আর বাতিটা নেভালো না। চুপচাপ বসে রইলো।

সেদিন জাহানারার দুঃস্বপ্নও একসময় শেষ হয়েছিল। এক সময় সুবোধ তাকে রুটি সব্‌জি আর জল খাওয়াতে পেরেছিল। আর ভয় পায় নি। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর জাহানারা নিজের মনেই একবার হেসেছিল—কেন কে জানে! সুবোধ ততক্ষণে আরো ভাল করে জাহানারাকে দেখলো—দেখলো যে ঘরে এক পূর্ণাঙ্গ নারী। একটানা আতংক আর উৎকণ্ঠার সঙ্গী তার। উভয়ের বাঁচার জন্যই বাধ্যত যাকে ‘স্ত্রী’র পরিচয় দিতে হয়েছে। নাম দিতে হয়েছে—নমিতা মন্ডল। স্বামী, জয়দেব মণ্ডল। সাকিন—জলপাইগুড়ির এক গ্রাম, মাধবপুর। সবই শুনেছে জাহানারা। যা বোঝার বুঝেও নিয়েছে। রাতে সুবোধ বিছানায় শোয়ার পর সে পাশে বসে থেকেছে অনেকক্ষণ। ঘুমন্ত সুবোধকে আবছা অন্ধকারে যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে চেয়ে দেখে গেল সে। একসময় পাশে শুয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো।
২২
রেললাইনের পাশে বস্তি হলেও এটা শহর কলকাতার উপকণ্ঠ। শিলিগুড়ির সেই বস্তির সঙ্গে এর অনেক তফাৎ। ঐখানে সামাজিকতা ছিল না। এখানে আছে। ধীরে ধীরে সুবোধ এই শহরের স্পন্দন নিজের ভেতর অনুভব করতে শুরু করলো। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এখানে সড়গড় হয়ে উঠলো জাহানারা। মহিলারা মহিলাদের সঙ্গে খুব সহজেই কথা বলতে পারে এখানে। সে হিসেবে এখানে দু’একজন মহিলার সঙ্গে সে পরিচিতও হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। বাসাবাড়ির কাজেরও কথাও কেউ কেউ বললো। বোঝা যায় এখানকার অধিকাংশ বউ ঝি’রা ‘বাসাবাড়ির কাজ’ নামক একপ্রকার কাজ করে থাকে। জাহানারার জানা ছিল না কাজটা আসলে কী। তবে পরিচিতরাই তাকে বলে দিল কাজের ধরন, কাজের খবর। প্রতিদিনের এই জন-জীবনের অভিজ্ঞতা সুবোধ আর সে সাধারণত রাতেই বিনিময় করে। তাদের কথা বলার বিষয় এখন তাদের নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা।

এই করে করে জাহানারার কাছে ‘নতুন’ মানে ভয়, এটা কিছুটা কেটেছে মনে হলো। এদিকে দিন তিনেক ঘোরাঘুরি করে সুবোধও একটা কাজ জুটিয়ে ফেলল। সুবোধের সঙ্গে কথা বলে জাহানারা একটি কাজের বাড়ি ঠিক করে নিল। একবেলা খাওয়া সহ মাসে তিনশ টাকা বেতন। টাকার অংক শুনে জাহানারা বিশ্বাস করতে পারে নি। মাস শেষ হলে সে হাতে তিনশ টাকা পাবে? এই প্রথম তার শরীরী ভাষায় আনন্দ আর বিষ্ময় এক সঙ্গে ধরা পড়লো। কাজ কী করতে হবে? না—রান্না ছাড়া ঘরের যাবতীয় কাজ । তা হউক, এই কাজ আর এমন কী ! তবে দু বেলাই তাকে যেতে হবে। রান্না গিন্নি-মা’ই করবেন। তবে সব জোগাড় করে দিতে হবে হাতে হাতে।

দিনে একবেলা খাবারও জুটে যায়। কাজের বাড়িতে না খেয়ে জাহানারা সেই খাবার ঘরেই নিয়ে আসে। বাড়ি এসে সে স্নান-টান করে খায়। এদিকে লেখাপড়া জানার সুবাদে সুবোধ শেষপর্যন্ত এক ঠিকাদারের কাছে কাজ পেয়েছে। সকাল আটটার মধ্যে তাকে চলে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত ন’টা। ফলে জাহানারা কাজের বাড়ি থেকে ফিরে সন্ধেবেলা রান্না করে। সুবোধ ফিরলে দুজনে একসঙ্গে খায়।


এখন জাহানারা একটি বাড়িতেই কাজ করে। কিন্তু আরো দুই বাড়িতে করার জন্য তাকে খবর দিচ্ছে। সে যায় না। সুবোধ বারণ করেছে। এই-তো স্বাস্থ্যের অবস্থা। কাজের ধকল সহ্য করতে না পারলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই নিয়ে প্রতিবেশী দু’একজন কাছাকাছি বয়সী মহিলা রসিকতাও করে। বলে—ওমা বউ এর শরীলের দিকে কত্ত নজর-গো কর্তার ! কী ভালো-মানুষ কর্তা-গো তোমার ! কত ভাগ্য তোমার। অবশ্য নতুন বউ—অত কাম দিয়া দরকার কি! বলে আর চোখ টিপে হাসে তারা। জাহানারা লজ্জায় মাথা নিচু করে। সে ভেতরে ভেতরে একটু কেঁপেও ওঠে। হায়, সুবোধ আমার স্বামীও না—তার সঙ্গে আমার বিয়েও হয়নি—আসলে সে আমার কে—সেটাই-তো এখনও জানি না । তবু সে একজন যুবক—এক সঙ্গে, এক ঘরে থাকি—পরিচয়, স্বামী স্ত্রী—মিথ্যা পরিচয়। এই মিথ্যার এত ওজন আমি বই কেমনে? পেছনে আছে কমল নামক পাষণ্ডের কব্জায় কয়েক মাসের বন্দী জীবন। সেটাই বা মুছি কেমনে। হায় আল্লাহ্‌,—দয়া কইরা আমারে একটু পথ দেখাও। দয়া কইরা আমার মুখে কথা জুগাইয়া দ্যাও—আমি-তো কিছু কইতেও পারিনা, সইতেও পারি না—নাইলে মানুষের কথা শুইন্যা-তো একদিন বুক ফাইট্যা মরুম আমি---।

কাজের ফাঁকে জাহানারা দুপুরে একবার ঘণ্টা তিনেকের জন্য ঘরে আসে। একটু শুয়ে বসে কাটায়। ইদানীং তার ভয়টা কেটে গেছে। রাতে ঘুমোনোর আগে প্রতিদিনের ফোঁপানিটাও এখন আর নেই। হিন্দু বউদের মত সে মাথায় কপালে সিঁদুর পরতে ভোলে না। বাসাবাড়ির কর্ত্রীও ক’দিন থেকে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে । তাঁর কথা হলো—হাতে শাখা নেই কেন—বিয়ে কতদিন হলো—বাচ্চাকাচ্চা নেই কেন—বাপের বাড়ি কোথায়—সাবধানে থেকো মেয়ে—বস্তির পরিবেশ—গুণ্ডা বদমাইশের অভাব নেই—ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে মনে ভাবে সুবোধকে বলতে হবে একজোড়া শাঁখা আনার জন্য। যদিও কর্ত্রীকে বলেছি কাজের সুবিধার জন্য খুলে রাখার কথা। তাহলেও হাতে নাকি লোহার কী একটা পরতে হয়। এসব কথা সুবোধকে বলা যে কত লজ্জার তা কে বুঝবে ! এ ছাড়াও বলতে হবে দুপুরে একবার আসার জন্য। বাইরে বাইরে কী খায় না খায়, এলে এক সঙ্গে বেশ, যা থাকে তাই খাওয়া যায়। কিন্তু বলতে পারে কই। এসব নিজের কোন কথাই সে আর বলতে পারে না। রাতে ফিরে সুবোধ এত ক্লান্ত থাকে যে বেশি কিছু কথা বলার উপায় থাকে না। খাওয়ার পর খুব বেশি জেগেও থাকতে পারে না।


দুপুরে আজ ঘরে ফিরে জাহানারা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। অথচ এই প্রান্তিক মানুষদের সামাজিকতা তাকে অনেকটাই উৎফুল্ল করে তুলেছিল। সুবোধও লক্ষ্য করতো যে একটা বয়সোচিত চাপল্য এসেছে জাহানারার মধ্যে। মনুষ্য-শিকড়ে সে জল পেতে শুরু করেছে। কিন্তু আজ রাতে ঘরে এসে সুবোধ টের পেলো জাহানারা একটু গম্ভীর । কথা প্রায় বলছেই না। খাওয়া দাওয়ার পর সে নিজের খাটিয়ার উপর বসেই বিড়ি ধরায়। খাটিয়াটা বাইরে পড়েছিল। ঘরের মালিককে বলে সেটা সে ঘরে টেনে এনেছে। এটাই তার বিছানা হয়েছে। আজ সে খাটিয়ায় না বসে জাহানারার চৌকিতে গিয়ে বসল। তার বিড়ি-খাওয়া শেষ হতে হতে জাহানারাও এসে গেল। জিজ্ঞেস করলো—
--আচ্ছা, তোমার কি হয়েছে আজ—এত চুপচাপ? এখানে কি এখনও ভয় করে?
--ক্যান, এই কথা জিগাইছেন ক্যান?
--না, কাজের বাড়ি বাদ দিলে বাকি সময়টা-তো প্রায় একা একা থাক—কেউ কিছু জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে না তো?
--না-তো!
--ঠিক আছে, ভাবছি হাতে-তো কিছু টাকা জমেছে—এর সঙ্গে সামনের মাসের টাকাটা পেলে ওপারে চলে যাব। এক দালালের খোঁজও পেয়েছি। তার বাড়ি হাবরার দিকে। দু’জনের জন্য তিনশ টাকা নেবে। এটাই তার রেট।
জাহানারা সুবোধের কথাগুলো একদমে শুনে শেষে দম ছাড়লো। ভাবতে লাগলো কী বলা যায়। এরমধ্যে সে ব্যস্ততা দেখানোর জন্য সুবোধের বিছানা দ্বিতীয়বার ঝেড়ে পাতলো। তারপর একসময় নিজের বিছানার এক কোণে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লো। ধীরে ধীরে ভাবতে লাগলো সুবোধ একজন এমন মানুষ যাকে সে এখনো চিনে উঠতে পারে নি। জন্মাবধি দেখা খুব কাছের বা পরিচিত জনের মধ্যে এমন কাউকে সে কস্মিনকালেও দেখেনি। এটা তারই ব্যর্থতা। ভাবতে ভাবতে জাহানারা একবার বুকভরা দম ছাড়লো। কিন্তু চুপচাপই আছে।
কিছু বলছে না দেখে সুবোধ আবার জিজ্ঞেস করলো—
--কী যাবে-তো?
--না।
--না মানে?—আসার সময়ই-তো বলছিলে বাপের কাছে দিয়ে আসার জন্য—
--আপনে কই যাইবেন? বলছিলেন যে ওপারে গেলে আপনের বিপদ আছে—
--আমার কথা বাদ দাও। আমি যেখানে খুশি থাকতে পারি, যেতে পারি—আমার ব্যাপার—থাক ও সব কথা। তোমার কথা কও।
--হ—‘না’—ই আমার কথা। যামু না কোথাও। মরলে বাঁচলে এখানেই—তখন বলছিলাম—তখন কি মাথার ঠিক আছিল না কি—আপনেরও দেখি মাথাডা গেছে—ঘর ছাইড়া আসা মাইয়া মানুষেরে ওপারে গেলে বাপ ক্যান, আল্লারও ক্ষেমতা নাই ঘরে তোলে। আপনে আমারে এইসব কথা কইয়েন না আর।
বলতে বলতে জাহানারা কেঁদে ফেলল। আর এই প্রথম কাঁদতে গিয়ে সে মুখও লুকোলো না, মাথার থেকে সরে যাওয়া কাপড়ও ঠিক করলো না। এবার সে সুবোধের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কাঁদতে থাকলো। বলতে লাগলো—আমি যামু না—না না না—এই কথা আমারে কইয়েন না—এই কথা শুনার থাইক্যা আমার মরণও ভালা---
সুবোধ খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগলো। না জেনে কি খুব কঠিন কিছু আঘাত করে বসলাম! আমি-তো ওর বলা কথাটাই ওকে বললাম! কাঁদতে থাকা জাহানারার এই খোলামেলা মুখ দেখে সুবোধ আবার একটা বিভ্রমে নিজের চিন্তা ভাবনাই গুলিয়ে ফেলতে শুরু করলো।


(ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৭:২৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×