(১)
ঘটনাটা নতুন কিছু নয়, আজ বেশ কয়েক মাস, না হয়তো বছর খানেক হলো ঘটছে। সে যাকগে সময়ের হিসেব কে-ই বা রাখে!
(২)
অবশ্য ইদানিংকালে সবই স্বাভাবিক মনে হয় সুপ্তির। ওফ্ হো না না সুপ্তি নয় নাদিয়ার। এমন মুরতাদি মালু নাম উচ্চারণ না করাই শ্রেয়। নাসারা বাংলা নাম রাখবে কাফের-রা। খাঁটি মুসলমান নাম হবে আরবীয় - ধর্মীয় ভাবধারী। যেমন - নাদিয়া। কি চমৎকার নাম। অর্থ আহবানকারিনী, নামেই ফুঁটে ওঠে ধর্মমাহাত্ম্য!
(৩)
হ্যা, যা বলছিলাম, স্বাভাবিক, সবই অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক...হোয়াইটচ্যাপেলের ম্যাচবক্স এ্যাপার্টমেন্টটাও ইদানিংকালে ঘর ঘর ঠেঁকে। আসলে কি-ই বা নেই? দু'টো ঘর, ফ্লাটস্ক্রিন হেইচ.ডি টিভি, মেঝেতে তিন শিশু, জরায়ুতে নতুন প্রাণ, মাথাপিছু মাসিক £২৫০ ভাতা, ষান্মাষিক স্বামী আসিফ...সত্যি সবই তো আছে।
তবে আসিফ-কে হোয়াইটচ্যাপেলের অন্যান্য স্বামীদের চাইতে কিছুটা ব্যতিক্রম-ই বলতে হয়। মাঝে মাঝে তো রীতিমত রোমান্টিক। মাস দু মাস পর পর রেস্টুরেন্ট থেকে ঘুরতে আসা অন্যান্য স্বামীদের মতো শরীর আঁটকে পড়ে থাকে না সে। আদর করে, সোহাগ করে, চাহিদা মত সবকিছু সামনে হাজির হয়। আর কি-বা লাগে! আসিফের মতে,
'Relationship is a take and give in i(t)? যেতা চাইবায় ফাইবায়, Da(r)ling world is a fucking race, you havta accept that, I love you, bu(t) don'(t) trya fucking play wiv me, if you do I gonna destroy you তুমরা দেশর মানুষ আমরার এগেইনস্ট কিসু করবার পারতায় নি? না, আমরা হইরাম ঠু বিগ!'
ভালোই লাগে নাদিয়ার যখন আসিফ তার কাছে আসে তাকে ভালবাসে। নতুন নতুন প্রাণের আব্দার করে। প্রথম দিকে অবশ্য বেশ ভয় পেয়েছিল সে।বলত,
-এত তাড়াহুরার কিতা আসে?
-যেতা বুজবার নায় মাতিও না (আসিফ)
-কিতা বুজতাম নায়?
-যেতা কইসি হুনো...আমরা সিলটীরা আইজ ফন্চাশ বৎসর ধরি আসি ব্রিটনো। Do ya fink (think) they love us...no no...each day we a(re) flipping fighting wiv (with) them. বাইচ্ছা অইলে £২৫০ ফি মাসত। আর তুমার-আমার লেবার বোনাস তো লগেই আসে। টিহা দরকার আসে, নাই-নি? (আসিফ)
-কিন্তু তোমার তো নিজের-ই ব্যবসায় আছে...
-নাড়ুয়ার নাড়ুয়া অহনো সিলটী মাত হিকিশ নাই। সাদে কি আমি তরে বেক্কল কই! রেস্টুরন দেহায় কেঠা? ওলায় যত আইবো হব Under the table. Ya go(t) me love? (আসিফ)
ভাল লাগে নাদিয়ার। ভাল লাগে আসিফকে। ভাল লাগে আসিফের মুখে নাড়ুয়া শুনতে। অন্য সকলের মতো না বুঝিয়ে চাঁপিয়ে দেয়নি সে, বুঝিয়েছে এক এক করে। সিলেটী ভাষা আসিফের কাছ থেকেই শেখা। নাড়ুয়া শব্দটা প্রথম বুঝতে পারত না, পরে আসিফ-ই বললো যে এর মানে যারা সিলেটী নয়।
-কিন্তু আমি তো সিলেটী
-মাতবার ফারো না তো কোয়াই সিলেটী অইলায়? (আসিফ)
(৪)
তবে নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মানতেই বাধ্য হয় সে। তার পরিবার ও বন্ধুরাও তাই মনে করে। প্রথম দিকে দেশে যেতে চাইত। তখন তারা থাকত শ্বশুর-শ্বাশুরির সাথে লেটনে ৩ রুমের এক বাসায়। তার দেশে যাবার কথা শুনলে শ্বাশুরি মাঝে মাঝে বলে উঠতো-
-এইসব চুতিয়ামী মাত আমার লগে মাতিও না। দেশো খিতা আসে? দেশোর বাই-বোইনরে গিয়া কি আমগোর ব্যবাক লুটি-ফুটি দিবা নি?
-আম্মা বাদ দেও। বিয়াক্কলে কিতা না মাতে...আমি যাইতে দিলো তো!! (আসিফ)
প্রথম প্রথম খুব কাঁদত। সবার সামনে নয় লুকিয়ে। মা-কে ফোন করে বলতো দেশে ফেরত যাবে। মা বোঝাতো সমাজের কথা আর বলত,
-চিন্তা করিস না, প্রথম প্রথম এরকম হবেই। দেখবি সব ঠিক হয়ে গ্যাছে। আর দেশে ফেরত আসার কথা ভুলেও ভাববি না লহ্মী মা আমার। দেখ তোর বাবা এখন রিটায়ার্ড। তোর ছোট বোন আছে। ওর বিয়ে দিতে হবে। তুই চলে আসলে সমাজে কী মুখ থাকবে আমাদের! কে করবে ওকে বিয়ে!
মা ঠিকই বলতেন। এখন সবই ঠিক হয়ে গেছে। এখন আসলে কি-ই বা নেই? দু'টো ঘর, ফ্লাটস্ক্রিন হেইচ.ডি টিভি, মেঝেতে তিন শিশু, জরায়ুতে নতুন প্রাণ, মাথাপিছু মাসিক £২৫০ ভাতা, ষান্মাষিক স্বামী আসিফ...সত্যি সবই তো আছে।
কই এখন তো আর ফেলে আসা সম্পর্কগুলো ভাবায় না। মনে পড়ে না বাবাকে-মাকে-ভাইকে-বোনকে-বন্ধুদের এমনকি পাগল ওই ছেলেটিকেও।
(৫)
ছেলেটি পাগল ছিল, কবি ছিল। নিজেকে উত্তর অত্যাধুনিক মহাকবি শান্ত বলে দাবি করতো। গান গাইতো...স্বপ্ন দেখতো...হাসতো আর হাসাতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিক থেকেই নাদিয়া লক্ষ্য করতো খ্যাত ছেলেটি তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাঁকিয়ে থাকে। পাড় গেঁয়ো হলে যা হয় আর কি! একদিন সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-এই ছেলে শান্ত বা অশান্ত যাই নাম হোক না কেন, মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই?
-জ্বি আমাকে বলছেন?
-বাংলা ফিল্মের ডায়ালগ মারো?
-না, তবে মারতে পারলে বেশ হত।
-নিজেকে কি মনে কর?
-শান্ত বা অশান্ত বাংলা ফিল্মের পরবর্তী নায়ক।
-তোমার নামে কমপ্লিন দিলে কি হবে জানো?
-দিলে জানতে পারব।
-তোমার মতো পাবলিকের নামে কমপ্লেন দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। যাই
-যাবেন যান। তবে আপনার উত্তর শুনে যান আমি আমার চারপাশে ছেলে-মেয়ে দেখি না। দেখি শুধু মানুষ। আর শুধু তাদের দিকেই 'ড্যাবড্যাব' করে তাঁকিয়ে যারা স্বপ্ন দেখায়।
ছেলেটি পাগল ছিল, কবি ছিল। নাদিয়া ভেবেছিল হয়তো কমপ্লিন-এর ভয়ে এখন দুরে থাকবে...কিন্তু আশা হলো দুরাশা পরদিন-ই ছেলেটি প্রথমবার তার কাছে আসে।
-কালকের কথার পর ভাবছিলাম, আপনি যখন রাজি আছেন চলেন আমরা বন্ধু হয়ে যাই (শান্ত)
-ভাই কে বললো তোমাকে যে আমি তোমার বন্ধু হইতে চাই।
-নিজে থেকেই তো আমার সাথে কথা বলতে আসলেন গতকাল আর আমার সাথে বন্ধুত্ব হলে আপনার-ই লাভ। (শান্ত)
-বাহ আমার এমন মহান লাভের কথা তো জানতাম না! তা কি শুনি
-ধরুণ আপনার সমস্যা আমি আপনার দিকে তাঁকিয়ে থাকি, তা বন্ধু হলে বন্ধু তো বন্ধুর দিকে তাঁকাতেই পারে (শান্ত)
সেদিন না হেসে পারেনি নাদিয়া। সত্যি ছেলেটা অদ্ভুত ছিল, পাগল ছিল, কবি ছিল আর তার বন্ধু ছিল।
ছেলেটি বন্ধুত্বের বেশি কখনো কিছু শোনাতে চায়নি, কিন্তু স্বপ্ন দেখাতো। বলতো,
-এতদিন আকাশ, শরৎ, পাখি, মেঘ, দোতালার কার্নিশে টুকরো টুকরো রোদ আর একলা থাকা নদীর কাছে ঋণী ছিলাম। আর এখন তোমার কাছে আমার ঋণের হাইরাইজ।
মাঝে মাঝে অদ্ভুত বায়না ধরত। রাত বারোটায় ফোন করে তিন তলার সিড়ি ভেঙে দোতলার ডায়েট বারান্দায় যেতে বলতো। অপর পাশের দোতলার বাসাটা যে তার সে জন্য। সে বলতো-
-হাত দিয়েছি, সিঁড়ি ভাঙো Please, একটু নিচে এস। আকাশ যেমন রোজ ভোরে আমার জানালায় স্থির হয়..ঠিক এমনি স্থায়িত্ব আর সমান্তরাল হবার ইচ্ছে আছে।
অদ্ভুত লাগতো নাদিয়ার। ভাল-খারাপ সে জানেনা। বিশ্লেষণের সীমার বাইরে। জিজ্ঞেস করতো-
-যা বলছো, কনসাসলি বলছো তো!
ছেলেটা উত্তর দিত না মাথা চুলকাত। কখনো কখনো হয়তো মৃদু হাসতো, উদাসী গলায় বলতো,
-শুনেছি সাবকনশাসলি মানুষ সত্যি কথা বলে।
ও ছিল ডায়ালগের রাজা। বাংলা ফিল্মের নায়ক হতে চায় হয়তো তাই। যদি চড় মারার ভয় দেখানো হয় সেখানেও ডায়ালগ
-চড় হলেও তোমার স্পর্শ তো থাকবে...
(৬)
কই এখন তো আর ফেলে আসা সম্পর্কগুলো ভাবায় না। মনে পড়ে না বাবাকে-মাকে-ভাইকে-বোনকে-বন্ধুদের এমনকি পাগল ওই ছেলেটিকেও। আর মনে পড়বেই বা কেন? আসলে কি-ই বা নেই এখন? দু'টো ঘর, ফ্লাটস্ক্রিন হেইচ.ডি টিভি, মেঝেতে তিন শিশু, জরায়ুতে নতুন প্রাণ, মাথাপিছু মাসিক £২৫০ ভাতা, ষান্মাষিক স্বামী আসিফ...সত্যি সবই তো আছে।
(৭)
হঠাৎ করেই কলিং বেল-এ জিংগেল বেল বেজে ওঠে। আসিফ আসলো না-কি! আজ তো আবার এক বিয়েতে যাওয়ার দাওয়াত। তবে সেজেগুজে প্রস্তুত নাদিয়া। আসিফ চায় তার স্ত্রী সবসময় সেজেগুজে বেরুবে। স্বামীকে সুখী রাখতে পারলেই না হল গুণী স্ত্রী।
উঠে দাড়ায় নাদিয়া। হিজাবটা বের করার জন্য আলমারির দিকে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায় সে।
#ঘটনাটা নতুন কিছু নয়, আজ বেশ কয়েক মাস, না হয়তো বছর খানেক হয়েছে ঘটছে। সে যাকগে সময়ের হিসেব কে-ই বা রাখে! এতদিনের মতো আজো গল্পটা শেষ করা হলো না নাদিয়ার। পারলোনা সবার চোখ লুকিয়ে রাখা পাতায় - এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক কথাটি লিখতে।
[নাদিয়ার মতো কোনো ডিসক্লেইমার দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বলতে পারিনি এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক। বিবেকটা যেন কোথায় একটু বাঁধে]
*এটি আমার লেখা প্রথম গল্প। সকলের কন্সট্রাকটিভ পরামর্শ কাম্য
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪৬