somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিরু ও পাগল ছেলেটা -২য় লিখন

২১ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিরু ছোটখাট গড়নের মানুষ। একেবারে সাদা সিদে। তার জন্ম হওয়া দরকার ছিল বছর চল্লিশ আগে। যখন সুচিত্রাদের জন্য ছেলেরা হন্যে হয়ে ঘুরতো। সহপাঠীরা যখন হৈচৈ করে আড্ডা দেয় নিরু নিভৃতে কবিতা পড়ে। চাপা স্বভাবের। আয়নার সামনে আবৃত্তি করে। হিন্দোলে গান শিখেছে । বড় বোনের বিয়ের পর, তার হার্মোনিয়ামের সদ্ব্যবহার করছে। এখন যে সিমেন্টের বেদীতে সে বসে আছে, পা দুলছে, হাত নাড়াচ্ছে কবিতার ছন্দে, তার মাথার উপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ। ডান পাশে টিএসসির সবুজ লন। চঞ্চল পাখীদের আনাগোনা। ভিতরে মঞ্চে বৈশাখী অনুষ্ঠানের জন্য সব ঠিক ঠাক।

নিরু যেন এখনো এসব কোলাহলে অভ্যস্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টা অর্ধেক চেনা বন্ধু। আর বন্ধু বলতে একজনই - স্কুলের বান্ধবী শ্যামা । সে প্রায়ই সহজ হতে বান্ধবী শ্যামাকে ডেকে আনে। সঙ্গে গল্প করতে বসে। সময় কাটায়। আজকেও শ্যামার আসার কথা। সে অপেক্ষায়। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এত বড় মঞ্চে এত মানুষের সামনে পার্ফর্মেন্স, কী না কি ভজঘট পাকিয়ে যায়। বুকটা ধুক ধুক করে কাঁপছে। সে নার্ভাস হয়ে পর পর দু কাপ লেবু-চা খেয়ে ফেলল। মঞ্চে ওঠার আগে শ্যামাকে শোনাতে চাইল। আবৃত্তির সময় ও সামনে থাকলে সাহস পায়। শ্যামা অবশ্য স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। কবিতা নিয়ে আগ্রহ কম। যেটা শুনবে বলবে, "ওয়াও, তুই কেমনে পারস? ঘ্যান ঘ্যান কথাগুলাও তোর গলায় জোস লাগে"।

শ্যামাকে দু'বার কল করল। "দোস, আমি কাটাবনের ঐ খানে বইসা আছি। আর দুইটা মিনিট দেখি জাম না ছুটলে হাইটা রওনা দিমু"। কল কেটে গেল।

কোন উপায় না দেখে নিরু নিজেকেই আবৃত্তি শোনাতে থাকল। (হয়তো পাশের রক্তজবা গাছটাও বোদ্ধা শ্রোতার মতো তাকে শুনছিল)

উত্তমাশা অন্তরীপ
পাড়ি দিয়ে আশার জলস্রোত, প্রদীপ হাতে আমি নারী
জ্বলে আছে, তোমাকে ভালবেসে – আমাকে বলেছিলে অন্ধকারে পেখম ময়ূর
তুমি তো এসব ভুলেই থাক? ভুলে যাও কুয়াশা কেটে গেলে”

নিরু দেখতে পেল শ্যামা আসছে। চশমা পড়া শ্যামার বন্ধুকে সে চিনতে পারল। তার পাশে হেটে আসছে একটা অপরিচিত ছেলে।

*
শ্যামা বলল, দ্যাখ কারে আনছি। এ হইলো আদনান। কবিতার সমঝদার। যুবনাট্য নাটক দলের হিরো।

লম্বা ছেলেটা কবিতাটা চোখ বন্ধ করে শুনলো। তার পর বিজ্ঞের মতো বললো, "এই কবিতা! এইটা তো আমার সিমি খালার খুব প্রিয় ছিল।"
"তুই কি কইতে চাস নিরু তোর খালা?"
নিরু লজ্জা পেলে, ছেলেটা বিব্রত গলায় বলে
"তুই যে কী শ্যামা, মুখের ছিপি নাই। খালি ফাইজলামি করস"
"আদনান, খালার আমলের কবিতা তো তোরই ডায়লগ"

কথা বার্তা শুনে নিরুর রাগ হচ্ছিল। সে শুধু বলল, "তার মানে আবৃত্তিটা ভাল হচ্ছে না?"
আদনান ধীর গলায় জবাব দেয়, "ভাল হচ্ছে, কিন্তু পরের অংশটা স্লো হবে এই রকম"। সে নিজেই শুরু করল,

জলধির শেষ ঘাটে
মুফতে মুক্তো কিনে সওদাগর, নোনা ঝড়ে
ভেসে এল বিরহের দ্বীপ,
বলেছিলে ফিরে এসো মেয়ে
দেখে নিও কৃষ্ণমণি, তাকাও একবার দু' চোখে


আদনানের চোখ স্থির, কবিতাটা সে এত সুন্দর করে আবৃত্তি করেছে! শেষ অংশে ছেলেটা কবিতায় মিশে যায়। নিরু পলক ফেলতে পারে না।

শ্যামা খোঁচা দিয়ে বলল, "নিরু, এইবার তোর চান্স। ক, এইটা তোর অমুক খালুর আবৃত্তি"।

ছেলেটা বলল, "হাসির বিষয় না, সিমি খালা আমার মায়ের সৎ বোন। তার কথা বললাম অন্য কারণে। ছোট বেলা থাইকা তার জন্য আমরা তিন ভাইবোন পাগল। উনার মুখে যে কত কবিতা শুনতাম, তারপরে যখন হাইস্কুলে পড়ি, একটা দু:খজনক ঘটনা হইছিল তার।

নিরু কবিতা থামিয়ে বলেছিল, কী হয়েছিল সিমি খালার?

*
বিকেলে ফিরে ক্লান্ত শরীরে নিরু ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় খুব ঝড় হয়েছে। বিদ্যুৎ ছিল না। কাজের মেয়েটা হারিক্যান জ্বেলে দিয়ে গেছে। নিরু বৃষ্টি সিক্ত পথে পানি ছিটিয়ে যাওয়া গাড়ির আওয়াজ শুনছিল আর নতুন লম্বা ছেলেটার কথা ভাবছিল।

শ্যামা সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ফোন করল। বলল, "আদনানকে তোর কেমন লাগল?"
"ভাল, ক্যান?
"এমনি, এ কিন্তু একটু পাগল। ক্রনিক সিজেফ্রেনিক? এমনিতো পোলাডা ভালা। কথা বলার সময় টের পাস নাই? তাকানিটা অন্যরকম তো।"
"না তো, নরমাল মনে হৈছে।
"ট্রিটমেন্ট চলতাছে। পুরা ফ্যামিলির হিস্টিরি অইন্য, আমার কাছে তোর ফোন নম্বর চাইছে, দিমু"
"তোর ইচ্ছা।"

*
ভোরে উঠেও নিরু কোন মিসকল দেখতে পায় নি। নিরু কি তাহলে তার ফোনের জন্য অপেক্ষায় ছিল? ক্লাসে ঢোকার সময় মোবাইল বাজল। ভারী একটা গলা শুনতে পেল । ওপাশের ছেলেটা অল্প কথা বলে। তারপর পরে কথা হবে বলে রেখে দেয়। সে কিন্তু কথা বলছে ভাল ভাবেই, তাকে মানসিক রোগী ভাবতে কষ্ট হয়। এর পর অনেক বার ফোনে কথা হয়েছে।

একদিন দুপরে সে একটা ফোন পায়, "নিরু, আজকে ফ্রী আছ? নিরবে যাবো। যাবা?"

নিরু যেন সম্মোহিত হয়। অন্য কেউ হলে দু'বার ভাবতো কিন্তু সে রাজি হয়ে যায়।

কোন ছেলের সঙ্গে এভাবে প্রথম রিক্সায় চড়া।
"তোমারে রাতে মিসকল দিসিলাম"
"হ্যা, আম্মা ছিল, ঘরে"
"আমারে জানো প্রত্যেকে এভয়েড করে"
"ক্যান"
"একটা সমস্যা আছে। আমি ট্রিটমেন্টে আছি"
(নিরবতা)
"একটা টিউশনি করতাম। স্টুডেন্ট ভাল রেজাল্ট করত। যেই শুনছে মাথা খারাপ, ছাড়ান দিসে"
"কেমনে জানল"
"জানিনা, পাগল হৈলে ভাবে বুঝতে পারে"
(নিরবতা)
"আচ্ছা আমারে কি অন্যরকম লাগে? কও?"
"না তো"
"আমি কিন্তু পাগল না। তোমারে একটা কথা বলি, মাইন্ড করবা না"
"কি কথা"
"আমি যদি কারো জন্য পাগল হৈতে চাই, তোমার জন্য হব"

নিরু নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলনা যেন!কি বলে ছেলেটা?? সাথেসাথে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল-
"বুঝতে পারছো তুমি কি বলছ?"
"আমি বুঝেই বলছি। আমি পাগলামি করছি না। সুস্ত চিন্তাতেই বলছি। আমি জানি সবাই আমাকে এড়ায়। আমি সুস্থ হলেও কেউ আমাকে ভালবাসবে না। কিন্তু খোদার কসম, আই লাভ ইউ! আই লাই ইউ নিরুপমা"।

নিরু চুপ করে রইল
সে ভুলে গেল আদনানের ইতিহাস, পরিচয়। সে সাধারণ মেয়ে। কেউ তো কখনো এভাবে ভালবাসার কথা বলে নি। বুকের ভেতর একটা কষ্ট আর ভালবাসা মিশে বাষ্পের মত বের হয়ে আসছিল।
পাগল ছেলেটা বুক পকেট থেকে এটা লাল গোলাপ বের করে দেয়। সারা পৃথিবীটা যেন গোলাপে ছেয়ে যায়।

নিরুর মনে হয় আদনানকে সে প্রথম দিন থেকেই ভালবেসে আসছে।

*
বিকেলে আদনান তাকে তরঙ্গের কাউন্টারে নামিয়ে দেয়।
শ্যামা মোবাইলে কল করে, "নিরু, আসস"?
নিরু যেন ধরা খেয়ে লুকিয়ে যেতে বলে, "আছি, ক্যান"?
"কিছু না, তোরে দেখলাম আদনানের লগে ঘুরতাসস, কৈ গেছিলি"?
"নিরবে"
"হুম্ম, তলে তলে এই কান্ড। আমারে ডাকলি না যে?"
নিরু চুপ ছিল। গোলাপটা সে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল।
"একটা ঘটনা বলি, পোলাডা কিন্তু পাগল না! আমি হেই দিন যাস্ট ফান করছি। আমারে জিগাইছিল, নিরু কি পছন্দ করে।
আমি কইছি পাগলামি"

---
আগের ভারশনটা লয় কমে যাচ্ছিল। যেহেতু অলরেডি অনেকগুলো কমেন্ট এসেছে ঐ পর্বে তাই নতুন পোস্ট দিলাম। ব্লগের নিরীক্ষামূলক পোস্ট গুলো স্কেচ খাতার মতো আনন্দময়!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:১২
১৫টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×