মিশ্র অনুভূতি নিয়ে লেখাটা শুরু করছি। ভালো লাগছে এটা ভেবে যে ৪১ বছরের পুরনো কিছু আগাছা উপড়ে ফেলে সোনার বাংলাকে কলঙ্কমুক্ত করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা আজ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শেষের পথে, দুজনের রায় ইতোমধ্যে হয়েও গেছে। জাতি হিসেবে আমরা একটু একটু করে দায়মুক্ত হচ্ছি। যুদ্ধ দেখিনি কিন্তু যে দায়টা বীর বাঙ্গালীর রক্তে লাল এই বাংলাতে জন্মের পর থেকেই অনুভব করে আসছিলাম তার বাস্তবায়ন দেখে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। উপমা হিসেবে যদি বলি আমি আজ খুশিতে আত্মহারা,বাড়িয়ে বলা হবেনা একটুও। এই খুশি আমার পূর্বপুরুষের কাছে আমার দায়মোচনের, যারা এতগুলো তাজা প্রানের বিনিময়ে আমাদের দিয়ে গিয়েছে গর্ব করার মত এক অতীত। তবে এই মুহূর্তে যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি এনে দিয়েছে তা হচ্ছে একাত্তরের পরবর্তী প্রজন্মকে জাগতে দেখা । আমার দেশের ইতিহাস যতটুকু সমৃদ্ধ আর যতটুকু গর্বের তার পুরোটাই এসেছে তারুন্যের হাত ধরে । সেই তরুণরা আজ আরও একটিবার জেগে উঠেছে, তারা আবারও সোচ্চার হয়েছে তাদের দাবী আদায়ে, এর চেয়ে ভালো লাগার আর কি হতে পারে!
দেশ নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে, দেশাত্মবোধক গান শুনলে চোখের কোনা ভিজে উঠে! দেশ আমাদের আবেগের এতোটা জায়গা জুড়ে। কোথায় যেন বছরখানেক আগে লিখেছিলাম, আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হই, আমরা এমন এক জাতি যারা স্বার্থের প্রশ্নে নিজ সহোদরকেও সামান্য ছাড় দিতে রাজি না, কিন্ত আমি বাজি ধরে বলতে পারি, দেশ নিয়ে আবেগের জায়গাটাতে আমরা অন্যদের চাইতে অনেক এগিয়ে, এতোটাই দেশপ্রেমিক জাতি আমরা। অনেকে এটা বলতে পারেন, তাহলে হচ্ছে না কেনো? আমি বলবো, ভাই, আমাদের বাঙ্গালিদের প্রব্লেমটাই তো আসলে এখানে! সবাই সবকিছু দেখছে শুনছে, কিন্তু আমি একা কি করতে পারব! এই ধারনার জাল ছিঁড়ে বেরুতে পারেনি। মেজাজ খারাপ লাগছে তো বাসায় পেটানোর জন্য বউ তো আছেই! আমার পরিচিত এক আঙ্কেল ছিলেন উনি সন্ধায়ে চা দোকানে বসে দেশের হালচাল নিয়ে সমবয়সীদের সাথে অনেক গুরুগম্ভীর আলোচনা করতেন আর মেজাজ খারাপ করে বাসায় ফিরে পত্নীর উপর চড়াও হতেন। প্রবীণরা ভাবেন, আমরাতো অনেক করেছি, স্বাধীনতা এনে দিয়েছি, এখনকার তরুন যারা তারাই করুক তাদের দেশ রক্ষা, আমরা আর কয়দিনই বা আছি! কিন্তু যাদের উপর ভরসা করে যাদের হাতে দেশের দায়ভার সব চেপে দিয়ে আমাদের প্রবীন সমাজ বসে আছেন, তারা কি জানেন না যে, এখনকার তারুন্য অতি প্রয়োজন ছাড়া টয়লেটেও যেতে চায় না, আলস্য আর পরমুখিতার উপর নির্ভরশীলতা এতোটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাদের। দেশ নিয়ে যে তারা একেবারেই ভাবে না, তা না! সবাই অপেক্ষায় থাকে, কেউ আমাকে ডাকুক আমি থাকব! কিন্ত নিজে থেকে এগিয়ে যাওয়ার মানসিক সাহসটাই তৈরি হয়নি এখনো। যাই হোক, ৪১ বছর পর হলেও আমাদের ঘুম ভেঙ্গেছে ভাবতেই ভালো লাগছে, এই জাতিকে এখন ঠেকায় কে!!
শুরুতে যে মিশ্র অনুভুতির কথা বলে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেই মিশ্র অনুভুতির অন্য অনুভুতিতা হচ্ছে, আফসোস! তরুণদের নিয়ে তো অনেক বললাম, আসুন এবার এদের উপর কিছু রাগ ঝাড়ি! বিষয়টা আমার মাথায় আসে আমার এক মেয়েবন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটি হাহাকার দেখে!যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের যুবসমাজ গত তিনদিন ধরে রাজপথে। জাগরন তাদের হয়েছে ঠিকই কিন্ত একটু বেশীই দেরীতে নয় কি! ভারতে দামিনীর ধর্ষণের ব্যাপারটা নিয়ে কি তোলপাড়টাই না হলো। ভাবতে ভালো লেগেছিল এই ভেবে, এই নরপশুদের বিরুদ্ধে মানুষ একতাদবদ্ধ হলে এরা আর সাহস পাবে না। কিন্ত কি হলো! এই ঘটনার পরপরই ধর্ষক সমাজ যেনো নতুনভাবে উদীপ্ত হলো, প্রতিদিনই নতুন নতুন একাধিক নিউজ আসতে থাকল। পেপার আর টিভির সংবাদ দেখে অনেকেরই মনে হলো ওই একটা সপ্তাহে ধর্ষণের হার যেন হঠাত করেই বেড়ে গেলো! আসল ব্যাপারটা কি তাই? নাকি নিত্যদিনের এই অত্যাচারে অত্যাচারিত সেই মেয়েটি বা তার পরিবার সামাজিক লজ্জা আর সমাজপতিদের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে এই ব্যাপারটিকে জনসম্মুখে আনল, যাতে ওই ধর্ষক তাদের এই ক্ষতিটা করার পর পার না পেয়ে যায়। এতদিন যা হয়নি, তা আজ হঠাত করে কিভাবে সম্ভব হল! হোক না তারা অন্তত সপ্তাহ দুয়েকের জন্য হলেও তাদের ভয়কে জয় করতে পেরেছে! ভারতে আন্দোলনের কোন ভূমিকাই কি নেই এখানে!কি মনে হয় আপনার, আমরা যদি আমদের ধর্ষিত বোনটার পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক একইভাবে জমায়েত হতাম তাহলে হয়ত তার লজ্জাটা একটু হলেও কমত! একটু হলেও ভয় ধরত সমাজের নিচুতম কীট ওইসব মানুষদের। পরিমল অথবা জলিলের মত শিক্ষকদের কাছে আমাদের ছোটো ছোটো বোনগুলা এভাবে অপমানিত হত না। কিন্ত কি হল! আমরা কিছুই করিনি। আমার বন্ধু/পরিচিতদেরদের মধ্যে যারা আজকের শাহবাগে জমায়েত তাদের অনেককেই টরেন্টে এর ভিডিও খুঁজে বেড়াতে দেখেছি। আগেকার দিনে মানুষ কন্যাসন্তান নিত না কারন কম কাজ করতে পারে,আয়ের উৎস হতে পারত না। আর এখন মানুষ কন্যাসন্তান নিতে ভয় পাবে এই জন্য বড় হলে না এই মেয়ের জন্য তাদের সমাজে ছোট হতে হয়! এমনটা হয়ত হবে না, কিন্তু কষ্ট লাগে, সত্যিই খুব কষ্ট লাগে যখন আমাদের উঠতি প্রজন্মকে দেখি তাদের বিবেক বলে কিছু থাকলেও বিবেকের প্রতি কোন তাড়না না থাকতে দেখে! আমরা কি আসলেই কিছু করতে পারতাম না, অবশ্যই পারতাম। যার প্রমান আজকের এই জাগ্রত তরুন সমাজের অগ্নিমূর্তি। কিন্ত আমরা কিছুই করিনি, আমরা দেখেছি দামিনীর অনুকরনে চলন্ত বাসে ধর্ষণ হতে, আমরা দেখেছি ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আসামীকে জামিনে মুক্তি পেয়ে সেই ছোট মেয়েটাকে মেরে ফেলতে! আমি আর কিছু বলব না।
ব্যাক্তিগত ভাবে আমি যেকোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। ব্যাপারটাকে আমার ভয়ঙ্কর মনে হয়, তা সেই অপরাধী যত বড় অন্যায়ই করুক না কেনো। বিবেক বর্জিত অপরাধীকে আমাদের বিবেকবান সমাজ মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সমাজ থেকে হয়ত একটি ক্ষতিকর কীট কমাচ্ছে কিন্ত এটা সত্যিই অমানবিক। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কয়েদীর মৃত্যুর অপেক্ষায়ে থাকা শেষ দিনগুলোর কথা ভাবলে মানুষ হিসেবে নিজেকে অনেক ছোটো মনে হয়। তবে দুইটি ক্ষেত্রে আমার বিবেক আমাকে আটকাবে না। যুদ্ধাপরাধ এবং ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত, এখানে কোন লঘু শাস্তির সু্যোগ থাকা উচিত না । নিজ দেশের সাথে যে প্রতারনা করতে পারে তাকে জনসমক্ষেই ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। তবে গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায়ে আর স্বাধীনতার প্রায় ৪১ বছর পার হয়ে যাওয়ায় এই বিচার প্রক্রিয়াটা বিতর্কিত হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আমার মুক্তিযোদ্ধা নানাজান প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন যে উনি নিজে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে সন্মানটা না পেয়েছেন, তার পরিচিত কয়েকজন রাজাকার তাদের দল ক্ষমতায় থাকার সময় মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে এই পরিচয়ে এখন দাপট নিয়ে চলছেন। নানাজান তাই নিজেকে এখন আর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দেন না! আওয়ামিলীগ সমর্থক কিন্ত হাসিনা খালাকে আর তার মন্ত্রিপরিষদের কাউকে তো দুই চোখেই দেখতে পারেন না। জিগ্যেস করলে বলেন, আমি শেখের রাজনীতি করি হাসিনার আওয়ামিলীগ করি না!
ব্যাক্তিগতভাবে আমি কার্ল মার্ক্সের ধারণায়ে বিশ্বাসী। আমার দেশে এর প্রয়োগ কখনোই সম্ভব না নিশ্চিত জেনে আমি সরকারের সমালোচনাতেই সীমাবদ্ধ। যেই কাঠামো্র শাসনই থাকুক না কেন দেশপ্রেম না থাকলে সব কিছু আক্ষরিক অর্থেই অচল। আমরা (সাধারন জনগন) গণতন্ত্রের সুফল তো পাচ্ছিই না বরং এর সবচেয়ে নোংরামির শিকার হয়ত আমরাই, প্রতিভাবান নির্লজ্জ রাজনীতিবিদদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে হয় আমাদের। আমি প্রতিটা যুদ্ধাপরাধীর নির্মমতম শাস্তি দাবি করি। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়ে থেকে কোন যুদ্ধাপরাধী যাতে সুবিধা না পায়। কসাই কাদেরের ফাঁসি নিয়ে যখন আমাদের মন্ত্রীপরিষদের এক রাজাকার মন্ত্রীকে মন্তব্য করতে শুনলাম, মেজাজটাই পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল এই বিচার প্রক্রিয়া আর শাসনব্যবস্থার উপর। চোরের উপর বাটপারি সহ্য হয় না। এই ট্রাইব্যুনা্লের স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও অনেক ক্ষোভ আছে দেখলাম। অবশ্য গণতান্ত্রিক দেশ, প্রব্লেম নাই! এই ট্রাইব্যুনাল যদি জীবিত থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি। এক দল অন্যদলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে তো অন্যদল সেই দলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে! সব রাজাকার মরে সাফ, জাতি হিসেবে আমরাও দায়মুক্ত হই। কি বলেন, গণতন্ত্রের কিছু সুফলও আছে দেখা যাচ্ছে !!
যুদ্ধাপরাধী সে যে দলেই হোক না কেনো সবাইকেই এই বাংলার মাটিতে ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে মরতে হবে, যেই মৃতদেহে থুতু ফেলবে আমাদের ইতিহাস,রক্ত আর লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম। সবার প্রতি একটা অনুরোধ, আসুন আমরা আজকের মত আমাদের সব জাতীয় সন্মান আর স্বার্থের প্রশ্নে, বর্ডারে নিরীহ বাঙালি হত্যা বন্ধ করতে, ধর্ষকদের রুখে দাঁড়াতে, সমাজ থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে তদুপরি কালো বিড়াল বের হওয়ার পরেও কেউ যাতে নাক উঁচু করে বুক ফুলিয়ে কথা বলতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এমনিভাবে একত্রিত হয়ে প্রতিহত করি।আমাদের এই মহান জাতিকে আমরাই পারি আরো মহান করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে।
ওহ আরেকটা কথা, সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনে মুখরিত শাহবাগ মোড়কে আপনারা কেউ “তাহরীর স্কয়ার” এর নকলে “শাহবাগ স্কয়ার” বলবেন না প্লিজ। এটা আমাদের “প্রজন্ম চত্বর”।।