একটা হাদিসের কথা বলি, যেখানে রাসূল সাঃ বলেছেন, ''আমি অচিরেই লোকদের উপর এমন একটি সময় আসার আশংকা করছি, যখন কেবলমাত্র নাম ছাড়া ইসলামের আর কিছুই বাকি থাকবে না এবং কুরআনের লিখিত রূপটি ছাড়া তার বাস্তবায়ন থাকবে না। মসজিদগুলো চাকচিক্যে ভরপুর হলেও মানুষ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। ঐ সময়কার আলেমরা হবে আসমানের নিচে বিচরণকারী সর্বনিকৃষ্ট জীব। তাদের থেকেই বিভিন্ন ফিতনা ছড়াবে এবং তারা নিজেরাও সেই ফিতনায় আবর্তিত হবে।'' -(হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত, সুনানে বায়হাকী)
এই যামানাই কি হাদিসটির সমর্থণ করেনা? ইসলাম কি অাজ নামে অাবদ্ধ নয়? শান্তি কোথায়? যেখানে শান্তি নেই সেখানে ইসলামও নেই । কুরআনের লিখিত রূপ অর্থ্যাৎ কোটি কোটি কোরঅানের কপি সমস্ত পৃথিবীতে রয়েছে । প্রতিদিন কী পরিমাণ কোরঅান তিলাওয়াত, তাফসীর করা হয় তার হিশেব দেয়া সম্ভব নয় । কিন্তু সেই কোরঅানের বাস্তবায়ন কোথায়? অামাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন কোথাও কোরঅানের বাস্তবায়ন নেই । বলতে পারেন, অামরা তো ব্যক্তিজীবনে কোরঅান মানি । হ্যা মানেন, তবে ওগুলো যেগুলো মানলে অাপনাকে দেখতে ধার্মিক মনে হবে, যেগুলো মানলে ধর্মকে পুঁজি করে অাপনার ধর্মব্যবসা, রাজনীতিতে ফায়দা হবে, যেগুলো মানলে সমাজে অাপনাকে মানুষ সম্মান দিবে । অামরা অাজ এমন মুসলিম, একটা বস্ত্রহীন-বাসস্থানহীন, অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করার চাইতে মসজিদে সাহায্য করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি । শুধু তাই নয়, সাধারণ ধর্মপ্রিয় মানুষকে বুঝানোর জন্য মাইক দিয়ে ওয়াজ-নসিহত-ও করা হয় এই বলে যে, অাল্লাহর ঘরে দান করলে বৃথা যাবেনা । অাখেরাতে এর প্রতিদান পাবেন । অার অামরাও সেই কথা মেনে নিয়ে দান-খয়রাত করি । কিন্তু একবারও ভাবিনা এই টাকাটা অামি একজন দুস্থ পরিবারকে দিয়ে সাহায্য করতে পারতাম । কারণ, এই টাকাটা মসজিদের থেকে অাজ ঐ অসুস্থ ব্যক্তি যে চিকিৎসার অভাবে মরতে চলেছে তার ভীষণ প্রয়োজন । অাল্লাহ এতোটা স্বার্থপর, সংকীর্ণমনা নই রে ভাই । অাপনি অামি উনার সম্পর্কে যতটুকুন জানি, তিনি তারও অনেক অজ্ঞাত ঊর্ধ্বে । মসজিদ তো তিনি ইচ্ছে করলেই তাঁর মালায়েক (ফেরেশতাদের) দ্বারা যখন তখন বানিয়ে নিতে পারবেন । তাছাড়া তিনি তো কারো মুখাপেক্ষী নন, তিনি অমুখাপেক্ষী (সামাদ) ।
কই, অালেমরা তো খুৎবা, ওয়াজ-মাহফিলে ভুল করেও বলেন না, “বেরেদারানে মুসলিম ! কোরঅানে অাল্লাহ বলেছেন, “যারাই ঈমান অানবে ও সৎকাজ (পুণ্য বা নেক অামল) করবে তাদের জন্যই জান্নাত” এটা কোরঅানের পরতে পরতে [রেফারেন্স-১] বলা অাছে । এই সৎকাজ বা পুণ্য মানেই নামায-রোজা নয় । কারণ অাল্লাহ কোরঅানের সূরা বাকারাহর ১৭৭ নং অায়াতে বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ করাতে সৎকর্ম নেই বরং সৎকর্ম হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।” তাই অাসুন অামরা সবাই অর্থ দিয়ে ঐ পাশের বাড়ির দরিদ্রপীড়িত মানুষটার জন্য একটা ঘর করে দিই । একটা ব্যবসা ধরিয়ে দিই । অাসুন অামরা সবাই মিলে ঐ পরিবারের মেধাবী সন্তানটির পড়ালেখার খরচ চালাই । অাসুন অামরা সবাই মিলে মসজিদে টাইলস, পাকাকরণ না করে গ্রামের এই রাস্তাটা মেরামত করি, সাকোটা ঠিক করি । এগুলোই অামাদের প্রকৃত পুণ্য, এগুলোই অামাদের নেক অামল, এগুলোই অামাদেরকে জাহান্নামের অাগুন থেকে মুক্তি দিবে, এগুলোই অামাদেরকে জান্নাত দিবে” অামাদের অালেমরা এসব বলেন না । কেনো বলেন না? শুক্রবারে মসজিদগুলোতে নামাজ পড়ার জন্য সামান্য জায়গা পাওয়া যায় না । তারমানে কি অামরা খুব ভালো মুসলিম হয়ে গিয়েছি? অথচ এই নামাযীদের বেশিরভাগই সুদখায়, ঘুষ খায়, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাই-বোনের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভোগ করে, মানুষকে ঠকায়, ওজনে কম দেয়, সবসময় মানুষের অনিষ্ট চায়, সমাজে-রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করে, মসজিদে কে সামনে বসবে কে পেছনে বসবে এ নিয়ে মনমালিন্য হয়, এমনকি মসজিদে জুতো চুরি হয় । এমনটি তো হওয়ার কথা ছিলো না । মসজিদের মুসল্লীদের তো এমনটি করার কথা ছিলো না । কেনো হচ্ছে? বাপ-মা যদি চুরি-ডাকাতি করে তাহলে কী করে অাশা করেন তার সন্তানটি চুরি-ডাকাতি না করে সৎকাজ করবে? হ্যা, অামরা সাধারণ ধর্মপ্রিয় মানুষদের কাছে অালেমরাই অামাদের পিতা-মাতাস্বরূপ , তাঁরাই অামাদের শিক্ষক । তাঁরা অামাদের যা শিখাবেন, অামরা তো তাই শিখবো । তাঁরা শিখিয়েছেন বকধার্মিকতা, তাই অামরা ধার্মিকের বেশে সেজে থাকি ঠিকই, কিন্তু যখনই সুযোগ পাই সেই ধার্মিক ছদ্মবেশ ধরে কাজে লাগানোর, সেই সুযোগ হাতছাড়া করিনা । তাঁরা শিখিয়েছেন, সারাজীবন পাপ কাজ করে একবার হজ্জ করতে পারলেই সব মাফ । তাই অামরা সারাজীবন সুদ-ঘুষ, ওজনে কম, ক্রেতাকে ঠকিয়ে, মানুষকে ঠকিয়ে অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ি । তারপর সেগুলো ভোগ করতে করতে শেষ বয়সে একটা হজ্জ করে এসে ভাবি, যাক, এখন নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে ! অনেকে হয়তো হজ্জ না করে সেই টাকাগুলো একটা মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করে নিজের পাপের বোঝাটা কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করে থাকেন । কী সাংঘাতিক অাল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি ! অাল্লাহকে এই মানুষগুলো কী পরিমাণ বোকা ভাবে ! এই প্রশ্রয় কারা দিয়েছে? অামাদের অালেম সমাজ তো পারতো সুদখোর, ঘুষখোর, হারামখোর, সন্ত্রাসী, চোর-ডাকাতদের ঘৃণা করতে । তাদেরকে মসজিদে না অাসার হুকুম দিতে, তাদের বাড়িতে যেকোনো অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে-জানাযা ইত্যাদিতে যোগ না দিতে । তারা পারতো এভাবে পাপের প্রতিবাদ করতে । তারা যদি এটা করতো সমাজে-রাষ্ট্র অন্যায়-অশান্তি বলে কোনো শব্দ থাকতো না । সবাই বাধ্য হতো অালেমদের কথা শুনতে ।
অাল্লাহ তো কোরঅানে বলেছেন,
﴿ﻛُﻨﺘُﻢۡ ﺧَﻴۡﺮَ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺃُﺧۡﺮِﺟَﺖۡ ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ ﺗَﺄۡﻣُﺮُﻭﻥَ ﺑِﭑﻟۡﻤَﻌۡﺮُﻭﻑِ ﻭَﺗَﻨۡﻬَﻮۡﻥَ ﻋَﻦِ ﭐﻟۡﻤُﻨﻜَﺮِ ﴾ [ ﺍﻝ ﻋﻤﺮﺍﻥ : ١١٠]
‘‘তোমরা সর্বোত্তম জাতি, তোমদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করবে। আর আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করবে।” [সূরা আলে ইমরান: ১১০]
সমস্ত মুসলমিদের দায়িত্ব ছিলো সৎকাজের অাদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা । যেহেতু সাধারণ মুসলিমদের ইসলাম শেখানোর মতো গুরু দায়িত্ব অালেমরা নিয়েছেন, তাঁদের তো অবশ্যকর্তব্য ছিলো এটা করা । কিন্তু তারা কী এটা করেছে বা করে থাকে? কেনো করেনা? কারণ ঐ যে পেটে লাথি লাগবে ! মসজিদের ইমাম তো অাজ নামে ইমাম, অাসল ইমাম হলো মসজিদ কমিটি । অার এই কমিটির টাকা অার ক্ষমতার জোরে মসজিদের ইমাম মিম্বরে বসে হাঁকডাক করতে পারে । মসজিদের বাইরে ম্যাও ডেকেই চুপ । অাল্লাহ কী এমনি এমনি ধর্মের বিনিময় নেয়াকে হারাম করেছেন, ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মব্যবসায়ীকে এমনি এমনি অাগুনখোর, জাহান্নামী বলেছেন? [রেফারেন্স-২]
উপরের হাদিসটিতে রাসূল সাঃ অারো বলেছেন, "ঐ সময়কার আলেমরা হবে আসমানের নিচে বিচরণকারী সর্বনিকৃষ্ট জীব। তাদের থেকেই বিভিন্ন ফিতনা ছড়াবে এবং তারা নিজেরাও সেই ফিতনায় আবর্তিত হবে।" হলো তো এবার প্রমাণ ! অালেমরা তো নিজেদের মানসম্মান হারিয়েছেই তার সাথে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করেছে, সর্বনাশ করেছে ইসলামের, সমগ্র মানবজাতির ।
জানি অামার এই ক্ষীণকন্ঠের অাওয়াজ অমন জাঁদরেল ধর্মবিশারদ অালেমদের কর্ণগহ্বরে পৌঁছাবেনা । পৌঁছালেও জ্ঞানের অহংকারের সমুদ্রে ঠাঁয় পাবে না । না পেলে নাই । কিন্তু সত্যকে কতদিন অহংকারের কালিমা দিয়ে চেপে রাখবেন । একদিন না একদিন সেই সত্য সকল মানুষ জানবে । সেদিন অাপনাদের অহংকারে তাসের ঘরের ন্যায় নাশ অাসবে - ভেঙ্গে চুরমার হবে অাপনার অহংকার । সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে এবং মানুষকে ফাঁকি দিয়ে না হয় অাপনি ইহজীবন পার করে দিতে পারবেন অনায়াসে কিন্তু অাল্লাহকে ফাঁকি দিবেন কী দিয়ে???
পাদটীকা ও রেফারেন্সঃ
১. [সূরা আল আনকাবুত, আয়াত সংখাঃ ৬৯ ], [ সূরা লোকমান, আয়াত সংখাঃ ৩৪ ], [সূরা আল-যুমার, আয়াত সংখাঃ ৭৫ ], [সূরা আর রহমান, আয়াত সংখাঃ ৭৮], [সূরা আল জাসিয়া, আয়াত সংখাঃ ৩৭], [সূরা নাহল, আয়াত সংখাঃ ১২৮ ], [সূরা হুদ, আয়াত সংখাঃ ১২৩ ], [সূরা আল আ’রাফ, আয়াত সংখাঃ ২০৬ ] সহ অারো বহু অায়াত ।
২. إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلَ اللّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً أُولَـئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلاَّ النَّارَ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“নিশ্চয় যারা সেসব বিষয় গোপন করে, যা আল্লাহ কিতাবে নাযিল করেছেন এবং সেজন্য অল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই ঢুকায় না। আর আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদের সাথে না কথা বলবেন, না তাদের পবিত্র করা হবে, বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। “ [সূরা বাকারাহঃ ১৭৪]
أُولَـئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُاْ الضَّلاَلَةَ بِالْهُدَى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِ فَمَآ أَصْبَرَهُمْ عَلَى النَّارِ
“এরাই হল সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করেছে এবং (খরিদ করেছে) ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে আযাব। অতএব, তারা দোযখের উপর কেমন ধৈর্য্য ধারণকারী।” [সূরা বাকারাহঃ ১৭৫]
সূরা ইয়াসীনের ২১ নং অায়াতসহ কোরঅানের বহু অায়াত ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:২৭