somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও তাঁর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা

০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শতবর্ষীয় মিষ্টি মাসিক পত্রিকা, যা বাংলার শিশু ও কিশোরসাহিত্যকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে, যে পত্রিকার গল্প,কবিতার মধ্যে দিয়ে বাঙালির গত কয়েক প্রজন্মের বড়ো হয়ে ওঠা, ১৯১৩ সালে সেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে বাংলা শিশু সাহিত্যের পিতৃপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাত ধরে ।


প্রথম বর্ষ , প্রথম সংখ্যা , বাংলা ১৩২০ সন।

উনিশ শতকের শেষের দিকে , ছোটদের জন্য বাংলা ভাষায় যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হত , সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি হল - সখা , সাথী , সখা ও সাথী , মুকুল ও বালক । উপেন্দ্রকিশোর নিয়মিত লিখতেন এই পত্রিকাগুলোতে । কিন্তু মন ভরছিল না তাঁর । ঐ সব পত্রিকার বেশির ভাগ লেখাই বিদেশী গল্প প্রবন্ধ ইত্যাদির ছায়া অবলম্বনে রচিত । বাংলা শিশু সাহিত্যের নিজস্ব কোন চরিত্র তখন গড়ে ওঠে নি । উপেন্দ্রকিশোরের হাতেই যেন ঘটলো প্রথম প্রাণ প্রতিষ্ঠা । ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হল তাঁর লেখা ছোটদের রামায়ণ । এরপর একে একে বেরুলো ছোটদের মহাভারত , সেকালের কথা , টুনটুনির বই ।

সত্যি মনে পরে "টুনটুনির বই" এর ছেলে ভুলানো গল্পগুলোর কথা , ছোট্ট রামায়ণের সেই মন -কাড়া বর্ণনা , ছেলেদের মহাভারতের সরস কৌতুকময় গদ্যভঙ্গী । ইতিহাস , বিজ্ঞান , প্রাণীতত্ত্ব প্রভৃতি শিক্ষামূলক জটিল বিষয়ও ছোটদের কাছে কেমন রমণীয় হয়ে উঠেছে তাঁর নির্ভার কথকতায় । ছোটরা বোধহয় সেই প্রথম সাহিত্যের স্বাদ পেতে শিখল, খুঁজে পেল নিজেদের ভাবনা ও কল্পনার একটা আলাদা জগৎ ।

শুধু ছোটদের মনের মতো লেখাই নয় , তার সঙ্গে চাই শোভন সুন্দর মনমাতানো ছবি । ছোটদের মনটাকে ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন , ধরতে পেরেছিলেন তিনি । তাই তাঁর কলমে তুলিতে আঁকা হতে লাগলো কত মজাদার , কত চমৎকার সব ছবি । কিন্তু হলে কি হবে , তখনকার ছবি ছাপাবার পদ্ধতি যে একেবারে সেকেলে ! ছাপার পর আর ছবির মজাটাই খুঁজে পাওয়া যায় না । অথচ ছোটদের লেখায় ভালো ছবি যে চাই -ই চাই ! তাই নিজেই কোমর বাঁধলেন উপেন্দ্রকিশোর । নিজের পয়সায় লন্ডন থেকে আনলেন ছবি ছাপার আধুনিক যন্ত্রপাতি । নিজের বাড়িতে শুরু করে দিলেন ছবি ছাপার নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। আবিষ্কার করলেন হাফটোন ছবি ছাপার উন্নত পদ্ধতি । বাঙালি শিশুদের এবার চোখ জুড়িয়ে গেল সেইসব ছবি দেখে ।

শেষমেশ নিজের বাড়িতেই তিনি খুলে ফেললেন এক ছাপাখানা । ইউ রায় এন্ড সন্স । এখানেই ঘটলো বাংলা শিশু সাহিত্যের সেই যুগান্তকারী ঘটনা , ১৯১৩ সালের এপ্রিল অর্থাৎ বাংলা ১৩২০ সনের বৈশাখ থেকে প্রকাশিত হতে লাগলো শিশু সাহিত্যের সেই কিংবদন্তীতুল্য মাসিক পত্রিকা "সন্দেশ " । সম্পাদক , প্রকাশক , মুদ্রক , লেখক ও চিত্রকর স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী । যেন কল্পলোকের মায়াবী দরজা খুলে গেল ছোটদের সামনে । কত রঙ , কত বাহার , কত বৈচিত্র্য তার ! এমনটি ভাবা যায় নি কখনো । শুধু নিজেই লিখলেন না , সন্দেশ পত্রিকা ঘিরে তৈরি করলেন ছোটদের নতুন ধারার নতুন লেখক গোষ্ঠী । ৩২ টি সংখ্যা প্রকাশ ও সম্পাদনা করার পর ১৯১৫ সালের ২০ এ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর মারা যান মাত্র ৫২ বছর বয়সে ।



সন্দেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এর লেখা

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর এর সম্পাদনার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেয় তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়। বাংলা শিশু সাহিত্য সুকুমার রায়ের যাদুকরী স্পর্শে আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছিলেন ১০৩টি কবিতা, ৮৮টি গল্প, ১২২টি প্রবন্ধ, ৮টি নাটক আর ২টি বড়ো গল্প, শুধু তাই নয় পত্রিকায় প্রকাশিত সব ছবিও তিনি-ই আঁকতেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে এই অসামান্য প্রতিভাবান কবি সাহিত্যিকের মৃত্যু শিশুসাহিত্য জগতের ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি । সুকুমার রায়ের ,পাগলা দাশু ,আবোল-তাবোল,হ-য -ব -র -ল মানে আক্ষরিক অর্থে ছোট্ট ও কিশোর পাঠকদের জন্য ‘সব পেয়েছির আসর’ নিয়ে হাজির হয়েছিল এই ‘সন্দেশ’ পত্রিকা ।

সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত ১৯৬১ সালের প্রথম সংখ্যা

পিতার মৃত্যু পর পত্রিকার দায়িত্বভার হাতে তুলে নেয় তাঁর পুত্র সত্যজিৎ রায় ।তবে প্রথমে তিনি সন্দেশ পত্রিকার হাল ধরেননি,ধরে ছিলেন সুকুমার রায়ের ভাই সুবিনয় রায়। তবে ১৯২৫ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে, আর্থিক ক্ষতির জন্য পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ বন্ধ হয়ে যায় ।এর সাথে সাথে প্রায় তিন দশক ধরে বন্ধ হয়ে গেলো ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। ১৯৬১ সালে, আবার প্রকাশ হতে শুরু করলো ‘সন্দেশ’ পত্রিকা, সম্পাদকের দায়িত্বে থাকলেন সত্যজিৎ রায়, সহসম্পাদক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমারের সন্দেশ ছিলো কেবলই ছোট্টদের পত্রিকা; সত্যজিতের হাত ধরে তা কিশোরদেরও হয়ে উঠলো; সত্যজিতের দুই অমর চরিত্র ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুর আবির্ভাব এই সন্দেশেই । তবে সন্দেশে সত্যজিতের প্রথম যে গল্পটি প্রকাশিত হয়, সেটি অবশ্য তেমন পরিচিত নয় । গল্পটির নাম, ‘বঙ্কু বাবুর বন্ধু’। সত্যজিৎ পরে এই গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমার স্ক্রিপ্টও বানান, ‘দি এলিয়েন’ নামে । শেষ পর্যন্ত তিনি আর সিনেমাটি বানাতে পারেননি ।

১৯৬৩ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বদলে সহসম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন সত্যজিতের পিসি লেখিকা লীলা মজুমদার।
১৯৬৩ সালেই সত্যজিৎ রায় ‘সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি’ নামে একটি অলাভজনক সমবায় সমিতিকে সন্দেশ পরিচালনার ভার অর্পণ করলেন ।এমনকি এখনো এই সমিতি-ই ‘সন্দেশ’ চালাচ্ছে । সত্যজিৎ রায় তাঁর পিতার মতো পত্রিকাতে বিজ্ঞান, কমিক ট্রিপ, লিমেরিক প্রভৃতি নানান বিষয় যোগ করেন । ১৯৯২-৯৩ সালে,মাত্র ১৪ মাসের মধ্যেই মারা গেলেন সত্যজিৎ রায়,নলিনী দাস (সহ-সম্পাদক) আর অশোকানন্দ দাস। পরের বছর লীলা মজুমদার অসুস্থ হয়ে পড়েন ।

সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার পর, তাঁর পুত্র সন্দ্বীপ রায় সন্দেশের সম্পাদনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । আর প্রকাশনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন নলিনী দাস-অশোকানন্দ দাসের ছেলে অমিতানন্দ দাস । কিন্তু এতোসব কিছুর পর সন্দেশ তার আগের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতো পারলো না । নতুন যুগের নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী- কমিক্স, রংবেরঙের ছবিওয়ালা পত্রিকা, আর নতুন নতুন টেলিভিশন চ্যানেল সব মিলিয়ে নিয়মিত সন্দেশ প্রকাশ করা-ই কঠিন হয়ে উঠল । মাঝে মাঝেই দু-একটা সংখ্যা বাদ পড়তে লাগলো । ২০০৬ সালে, চারটি অপ্রকাশিত সংখ্যার পর, নতুনকরে নতুন রূপে আর্থিক সাহায্যে "সন্দেশ" পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে । সন্দীপ রায়ের সম্পাদনায় "সন্দেশ" ফিরে পেয়েছে তার হারানো গৌরব ! এ বছর শারদীয় সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত হয়েছে ।


এ বছরের শারদীয় সন্দেশ

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ,সত্যজিৎ রায়ের ‘সন্দেশ’ হলো একটি আবেগ ।রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুনীল গাঙ্গুলী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ নানান গুণীজনের লেখা প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকায়। সাদাকালো থেকে রঙিন হয়ে ওঠার নানান ভাঙা-গড়ার, ওঠা-নামার গল্পের ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন “সন্দেশ” ।








সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যোগ্য কে???

লিখেছেন জটিল ভাই, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪১

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)




(সকল... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতান্ত্রিকভাবে লীগকে ক্ষমতার বাহিরে রাখা যাবে আজীবন।

লিখেছেন শাহিন-৯৯, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:১৩



লীগ সদ্য বিতাড়িত কিন্তু তাদের সাংগঠিক কাঠামো এখনো পূর্বের মতই শক্তিশালী শুধু ছোবল দিতে পারছে না, স্থানীয় নেতারা বিএনপির নেতাদের বড় অংকের টাকার বিনিময়ে ইতিমধ্যে এলাকায় প্রবেশ করছে তবে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেললেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৪১


মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী লম্বা রেইসের ঘোড়া মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া হতে বেডরুমে যার নিয়োগ নিয়ে অস্বস্তি আছে তিনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন কিভাবে মানুষের মাথা ঠান্ডা করতে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:২৪

গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন.......

চীনের চড়ুই পাখি নিধন কর্মসূচী ও প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ!
প্রকৃতি তার আপন গতিতে বয়ে চলে পাহাড়ি ঝর্ণার মতন। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রকৃতির নিয়মের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে হারিয়ে গেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

''ভারতের থাপ্পর'' ব্লগ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৪ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫২


ছবি : তানভীর জুমার এর লেখা পোস্টের মন্তব্য থেকে নেওয়া


মন্তব্যটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। জানিনা ভারতে কয়জন ইউনুস আছেন। যদি থেকেও থাকেন তাদেরকে ব্যক্তি হিসেবে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×