somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নটরডেম ক্যাথেড্রাল দেখতে যাওয়া আর কৈশোরে ‘হাঞ্চব্যাক অভ নটরডেম’ পড়ে সেই আবেগের অনুরণন ......

২৮ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকেই আমার মুখে নটরডেম আর নটরডেম, যার বাংলা মূল উচ্চারণ সম্ভবত নোত্রঁ-দাঁম, আইফেল টাওয়ার বা মোনালিসা এইসব ‘বিখ্যাত’ দর্শনীয় নিয়ে একটা শব্দ ও নাই; আমার দুই সহকর্মী মোটামুটি ক্লান্ত!

এসমেরালদা আর কোয়াসিমোদো, আমার আবেগী কৈশোর বয়সের দুই চরিত্র, ভিক্টর হুগো এর ‘হাঞ্চব্যাক অভ নটরডেম’ পড়ে তৈরি। প্যারিসকে আমার চেনা বইয়ের পাতায় এডভেঞ্চারের শহর হিসাবে , শিল্পকলার শহর হিসাবে নয়! আলেকজান্দ্রার দ্যুঁমা’র টানটান এডভেঞ্চার কাহিনীগুলো
বা জুলভার্নের জন্মশহর বলেও হয়তোবা । তাই প্যারিস আমার কাছে ক্লদ মোঁনে, রেনোঁয়া ,কামিল এর যতোনা, তার চাইতে বেশী ডিঁ আরতানা বা জুলভার্ন এর শহর।



ষোড়শী জিপসি তরুণী এসমেরালদা প্যারিসের আমজনতার কাছে ছিলো মোহিনী, তার ছোট্ট ছাগল জালিকে নিয়ে প্যারিসের পথে নেচেগেয়ে দিন কাটাত। রাজার বাহিনীর ক্যাপ্টেন ফিবাস এর কাছে সে কামনার বস্তু , আর্চ বিশপ ক্লঁদ ফেলোর কাছে ভালোবাসার – ধর্মের বন্ধন এর সাথে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে, আর কোয়াসিমোদোর কাছে নিবেদনের দেবী; বিশেষত ক্লঁদ ফেলোর নির্দেশে এসমেরালদাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে গিয়ে সৈন্যদের হাতে ধরা পরার পর যখন তাকে চাবকানো হয়; এই মমতাময়ীই কাছে এসে তাকে পানি খাইয়েছিলো সেবা দিয়েছিলো।

নটরডেমের কুঁজো কোয়াসিমেদোর হৃদয় কখন দখল হয়েছিলো সে জানে না, কিন্তু এসমেরালদাকে ফিবাস এর হত্যাচেষ্টার (নাকি প্রথমদিকে হত্যাই? অনেকদিন আগের পড়া, বইটা ও কাছে নাই , পুরোপরি নিশ্চিত নই। প্রতিশোধকাতর আর্চবিশপ ই এই চেষ্টা করেছিলেন) জন্য দায়ী করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, কোয়াসিমেদো তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে নটরডেমে আশ্রয় দেয়। এসমেরালদা তার কাছে প্রার্থনার চাইতেও বেশী নিবেদনের মানুষ, সে ফিবাস কে পছন্দ করে, কোয়াসিমোদো তাই মেনে নেয় । ( ‘আ টেল অভ টু সিটিজ’ এর সিডনি কার্টনকে মনে পড়ে।)

এসমেরালদার মন কাতর সুদর্শন ক্যাপ্টেন ফিবাসকে নিয়ে , যে ফিবাস অভিজাত এক রমণীর সাথে বাগদত্তা, এসমেরালদা তার কাছে কেবলই কামনার বস্তু। প্যারিসের জনগণের ঘৃণার পাত্র ছিলো কোয়াসিমোদো- তার বিকট দানবীয় আকৃতি আর প্রতিবন্ধীতা, সবাইকে পাত্তা না দিয়ে গির্জার কার্ণিশে ঝুলে ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দেবার জন্য; এসমেরালদার কাছে ও প্রথমে তাই

আইন অনুযায়ী নটরডেম ক্যাথেড্রাল 'স্যাংচুয়ারি' অর্থাৎ অভয়াশ্রয়। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্ম ও রাষ্ট্র ছিলো একে অপরের ক্ষমতার পরিপূরক, সেই সুবাদেই নটরডেমের এই ক্ষমতালাভ। গ্রিগোঁরি (এসমেরলদার নামকাওয়াস্তে স্বামী, প্যারিসের ভবগুরে কবি) আর বদমাশদের রাজা ক্লোপিন এর প্ররোচনায় প্যারিসের ভবঘুরে-অপরাধীদের দল এসে নটরডেমের সামনে ভীড়করে, উদ্দেশ্য এসমেরালদাকে ছিনিয়ে নেয়। এই বিশৃঙ্খলা দেখে রাজার আদেশে নটরডেমের স্যাংচুয়ারী ক্ষমতা বাতিল করা হয়, প্রতিশোধউম্মাদ প্রত্যাখিত বিশপ ক্লদ ফেঁলো এসমেরালদা কে তুলে দেন রাজার সৈন্যেদের হাতে। কোয়াসিমেদো ক্ষোভে উম্মত্ত হয়ে তার প্রভু তার অনেকটা ঈশ্বর ফেঁলোকে ক্যাথেড্রাল এর উপর থেকে ফেলে দেয়। এর পর তাকে আর দেখা যায়নি নটরডেমে প্রাকাশ্যে।

সিস্টার গুঁদুলে, তার ছোট্ট মামণি এগনেসকে হারাবার শোকে যে বাকী জীবন নিজের ইচ্ছায় এক অন্ধকার ঘরে মামণির জুতো বুকে চেপে ধরে পার করে দেয়; জিপসীদের উপর ঘৃণায় এসমেরালদাকে কঠিন সব অভিশাপ দিত। শেষ মূহুর্তে এসমেরালদা পালাতে পারেনি গুঁদুলে এর কঠিন হাত থেকে, আর তখনই সিস্টার গুঁদুলে বুঝতে পারে, এসমেরালদাই তার হারিয়ে যাওয়া মামণি এগনেস!

দুইবছর পরে নটরডেমের পাতালে খননকাজ চলাকালে দুইটি কঙ্কাল আবিস্কৃত হয়। একটা কঙ্কাল কোন এক তরুণীর, সোনালীচুলো; তাকে জড়িয়ে ধরে আছে উচুঁ পিঠের হাড়ের ভাঙা ঘাড়ের আরেকটি কঙ্কাল, পরম মমতায়!

(পড়া বইগুলোর মুভি দেখতে আমি অপছন্দ করি অনেককারণে। তীব্র বেদনার অনুভুতির এগনেস এর সাথে মা গুঁদুলের বুঝতে পারার জায়গাটি এই কাহিনী নিয়ে তৈরী পনেরোটি মুভির কোথাও বিশেষভাবে নেই। আমি দেখেছিলাম সালমা হায়েক এর করা ১৯৯৬ এর মুভিটি, ডেমি মুরের অভিনীত একটা আছে, সব ছাপিয়ে ১৯১১ এর নির্বাকটাই ভালো লেগেছে। ইউ টিউবে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে অনেক.)

অনেক বকবক হলো, আসেন নটরডেম গির্জাটাই দেখিঃ



নটরডেমের সম্মুখভাগ। প্রথমে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম । সেন্ট নিকোলাস চার্চ এর বিশালত্ব এখানে নাই। কিন্তু পুরো দেখার পর...। একসময় ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রকাঠামো আর্চবিশপ অভ প্যারিসকেই মুখ্য করে প্রাধান্য দিতো, ভ্যাটিকানের প্রভাব কমানোর জন্য। নটরডেম তাই ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর অনেক ঘটন-অঘটন-পরিবর্তনের স্বাক্ষী।






নটরডেমের কারুকার্যময় জানালা, বিভিন্ন সন্তদের ছবি আর নানা কাহিনী খোদিত আছে জানালাগুলোতে। সূর্যের আলো যখন জানালার মাঝ দিয়ে আসে অপূর্ব সুন্দর লাগে, ছবি তুলতে খেয়াল নাই।






লম্বাটে আরেকটি অলঙ্কৃত জানালা। প্রাগ বা বার্লিন মিট্টে’র আরো দুইটি চার্চ এ গিয়েছিলাম - প্রথমটা ষোড়শ শতাব্দীর , পরেরটা এক হাজার বছরকার আগের, সেগুলোতে প্রায় একই ধরনের জানালা। খুবই সুন্দর ।





ভেতরে , ক্যামেরার ফ্রেমে আসে না এত বিশাল। রোববারে যাওয়ায় আমাদের সৌভাগ্য, প্রার্থনা সঙ্গীত চলছিলো, বিশাল কক্ষটিতে প্রতিধধনি হয়ে ঘোরাক্রান্ত মনে হচ্ছিলো...







নটরডেমের মডেল, পাশ থেকে। চরম বিস্ময় লাগে, গথিক স্ট্রাকচারে এতো দারুণ এই চার্চটি বানানো হয়েছিলো সেই ১১৬০ সালে ! আমি স্থাপত্য বুঝি না, এক বন্ধু পরে বলেছিলো নটরডেম মূলত তার ভিন্ন আর নতুনত্বে ভরা নির্মাণরীতির জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে গথিক কাঠামোতে বাইরে থেকে সাপোর্ট দেয়া প্রবৃদ্ধি আর বেলফ্রাইগুলো।





নটরডেমের পূর্বের টাওয়ার থেকে প্যারিস আর সেঁইনে নদী। দূরে দেখা যায় আইফেল টাওয়ার , ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যের বাড়িঘর। ভাবি, কোয়াসিমোদোর চোখে কেমন ছিলো এই শহর ?




টাওয়ারে ঊঠতে লাইন ধরতে হয়েছিলো আড়াই ঘন্টা , আইফেল বা মোনালিসা দেখার লাইনের চাইতে বেশী। যাক ,সমঝদার পাবলিক দুনিয়াতে এখনো আছে । :) লাইনে এক জাপানী তরুণের সাথে বেশ গল্প হলো, কিন্তু তার ঠক ঠক করে শীতে আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে কাঁপা দেখে ভয়ই হচ্ছিলো কখন না টেঁসে যায়। তাও লাইন ছাড়বে না সে, কোয়াসিমোদোর ঘন্টা শুনেই যাবে.



কোয়াসিমোদোর ঘন্টা। ছুঁয়ে কি যে অদ্ভুত লাগছিলো...। জন্মকালা ও আধাঅন্ধ কোয়াসিমোদোর প্রিয় শব্দ ছিলো এই ঘন্টার শব্দ।





প্যারিস হচ্ছে ব্রিজের শহর। সেঁইনে নদীর উপর কম করে হলেও পঁচিশটা ব্রিজের ছবি তুলেছি আমি। পন্ট আলেকজান্দ্রেরের রাত... আহা ব্রিজ ও একটা দেখার জিনিষ হতে পারে ঃ) একটা ঠাট্টা শুনলাম, ফ্রেঞ্চরা নাকি প্রতি যুদ্ধে জিতলে একটা ব্রিজ বানায় স্মৃতিস্বরুপ হারলেও একটা। :) কে জানে, যে বলেছিলো সে জার্মান, পচানোর জন্যই হয়ত ঠাট্টাটা বানিয়েছে।


[ছবি আর বেশী দেয়া যাবে না মনে হয়, বড় হয়ে গিয়েছে অনেকখানি, এম্নিতেই কাটাকুটি করে দিতে দিতে বেহাল গলদঘর্ম অবস্থা :( ]

রাতের আলোকিত ক্যাথেড্রালটি না দেখে মনে হয় আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু উপায় ও ছিলো না, কারন প্রতিরাতেই আমরা গারে-দ্যু-নর্দ এর এক মরোক্কিয়ান দোকানে ডোনার খেতে যেতাম, তারপর লা-শাপেলে মেট্রো পরিবর্তন করে অলিম্পাইডেস এর আস্তানায়, পা টেনে টেনে।


বিকেলে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি নিয়ে নেমে আসি নটরডেমের টাওয়ার থেকে। কৈশোরের স্বপ্নের জায়গাগুলো আচম্বিত দেখা হলো। নদীর ওপারে মনে হয় ডিঁ আরতানা হয়তো এখনই ছুটে আসবে এথোস, পর্থোস আরামিসকে নিয়ে..., না হয় বাস্তিলের বিপ্লবী। বোটাবাসে উঠে নদীপথে যাত্রা শুরু করি, গন্তব্য আইফেল টাওয়ার, কারোকাছে প্যারিসের অন্যতম দর্শনীয় স্থান, কারো কাছে লোহালক্কড়ের একটা স্তুপ..
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০০৯ ভোর ৬:৫১
৬৬টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×