উৎসর্গ
নাসরিন জাহান
১
গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে, আমাদের দেশে যখন উদযাপিত হচ্ছে বিজয় দিবস, তখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের দিল্লীতে ফিজিওথেরাপির এক ছাত্রী গণধর্ষিত হন। বলা দরকারঃ ধর্ষণ উপমহাদেশের ও বিশ্বের নারীজীবনে নতুন কোনো ঘটনা নয়, সারা পৃথিবীর নারীরা বাসই করেন যে-কোনো মুহূর্তে যে-কারো দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার এক পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতায়। কিন্তু এই ঘটনাটি একটু অভিনব এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ ধর্ষণের এই ঘটনাটি ঘটেছে প্রকাশ্যে, চলন্ত বাসের ভিতরে, এবং ঘটিয়েছে পাঁচ-ছয় জন পুরুষ ও উপভোগ করেছে উপস্থিত অন্যরা। এটা আক্ষরিক অর্থেই একটা গণধর্ষনের ঘটনা, কারণ অংশগ্রহণকারী থেকে উপভোগকারী উপস্থিত প্রত্যেকেই শারীরিক বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই অমানবিক অপরাধে অংশ নিয়েছে। আমরা জানি, প্রকাশ্যধর্ষণের ঘটনা সাধারণত ‘শান্তির’ সময়ে ঘটে না, কখনো কখনো ঘটে ‘যুদ্ধের’ সময়ে। কিন্তু ভারতে তো সে-দিন কোনো যুদ্ধ চলছিল না! বা, কে জানে, হয়তো নারীর বিরুদ্ধে সবসময়ই যুদ্ধ চলছে সারা দুনিয়ায়, কখনো গোপনে ও কখনো প্রকাশ্যে। নিজেকে বাঁচানো লড়াইয়ে নারী কখনো সফল হচ্ছে, কখনো বা ব্যর্থ। সে-বিবেচনায়, এই ভারতীয় ছাত্রী সেই সার্বক্ষণিক যুদ্ধের এক সাম্প্রতিক শহিদ। বলছি, কারণ আজ সকালের পত্রিকায় যদিও বলা হয়েছিল ভিকটিম জীবন মৃত্যুর মাঝখানে আছে; একটু আগে টেলিভিশন মারফত জানতে পারলাম চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা ও স্বজনদের সকল প্রার্থনা ব্যর্থ করে দিয়ে মেয়েটি মারা গেছে।
২
কবি আল মাহমুদ তার বিখ্যাত “সোনালী কাবিন” কাব্যগ্রন্থের ‘প্রকৃতি’ কবিতাটি শুরু করেছিলেন একটি প্রশ্ন দিয়েঃ “কতদূর এগোলো মানুষ?” এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দিন কে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রগতিশীলতার কারণে মানুষ নাকি অনেক এগিয়েছি, মানুষ নাকি পেরিয়ে গেছি সভ্যতার অজস্র অধ্যায় নানা উত্থান পতনে, মানুষ নাকি ফেলে এসেছি বর্বরতা অনেক পেছনে। কিন্তু দিল্লীর ঘটনাটি, এবং এ-প্রকার নানান ঘটনা, সভ্যতার মাদকতাময় অগ্রযাত্রার আকর্ষণীয় বিবরণকে প্রায়শই অস্বস্তিতে ফেলে। ফরাশি বিপ্লবের অন্যতম সড়কনির্মাতা জাঁ-জ্যাক রুশো বিশ্বাস করতেন না প্রগতিতে, তাঁর কাছে তথাকথিত বর্বরতা ছিল তথাকথিত সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক, তাই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন মানুষ সেই আদিম জীবনের সামাজিক চুক্তির পুনঃবাস্তবায়ন ঘটাবে আধুনিক জীবনে এবং জটিল নাগরিকতার প্রতিস্থাপন ঘটাবে সরল আরণ্যকতায়। রুশোর প্রত্যাশা অনিবার্য কারণেই ব্যর্থ হয়ে গেলেও আজও এমন ঘটনা ঘটে যে হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে রুশোপন্থী, তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে সভ্যতার সমস্ত দালানকোঠা। হয়তো সেই অভিলাষেই কবি মাদল হাসানের মত কেউ কেউ আজও রচনা করে যান সভ্যতাবিরোধী কল্পস্বর্গীয় উলোটপুরাণ, অসম্ভব প্রত্যাশা ধারণ করেন পাথরের পাঠশালায় প্রত্যাবর্তনের।
৩
কিন্তু ফেরা অসম্ভব, আমরা জানি। ইতিহাসের চাকা কখনো পিছনের দিকে যেতে পারে না, আরণ্যিক জীবনকে আধুনিক জীবনে পুনঃনির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া জীবনের জটিলতা থেকে পলায়নের শামিল। তাই এই সভ্যতাতেই থাকতে হবে আমাদের, এরই মানবিকায়ন ভিন্ন আমাদের পরিত্রান নাই।
৪
কিন্তু ধর্ষণ কেন ঘটে? হেলা ফেলা করে খাড়া করা যায় অনেক উত্তর। যেমনঃ নারীর প্রোভোকেটিভ পোষাক পরিধান (চার বছরের শিশুর শরীর তবে কেন কাউকে প্রভোক করে?), ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় (ধর্মতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যীয় রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ষণের হার তবে এত বেশি কেন? এত কম কেন ধর্মনিরপেক্ষ স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোতে?), পুরুষের যৌন কামনা (তবে স্বমেহনের বদলে ধর্ষণ কেন?) ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের কিছুই নয়, বর্তমান বিশ্বে ধর্ষণের আদি কারণ সুপ্রাচীনকাল থেকে মানবসমাজে বহমান পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা যাকে ব্যাপকভাবে টিকিয়ে রেখেছে স্বীয় স্বার্থে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ভোগবাদী সংস্কৃতি।
খবরের কাগজ থেকে টেলিভিশনের পর্দা, পাঠ্যপুস্তক থেকে বিলবোর্ড সর্বত্র নারীর পণ্যায়ন ঘটছে খুব স্বাভাবিকভাবে। নারীশরীরের প্রদর্শন পণ্য বিক্রির জন্য সুবিধাজনক, তাই সারা দুনিয়ার বিপণন-বিশেষজ্ঞরা শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনেও নারীশরীরের নিরর্থক প্রদর্শনীতে পিছপা হচ্ছেন না। শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলা-নাটক-সিনেমা সব জায়গায় নারীকে “দ্যাখানো” হচ্ছে বস্তু হিশেবে, এভাবে ঘটছে নারীর বস্তুকরণ। এবং নারীরা নিজেও যে এইসব অপকাণ্ডের প্রভাবমুক্ত নন সম্পূর্ণভাবে, তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী কারিনা কাপুরের একটি মন্তব্যে। যেখানে তিনি দাবী করেছেন, “আবেদনময়ী” হওয়াই নারীজীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা!!!
এমন পরিস্থিতি ধর্ষণের জন্য পরিস্থিতি তৈরি করবে তা আর বিচিত্র কি? আমরা যে মানবিকায়নের কথা বলছি, তার পথে এই ধরণের পরিস্থিতি এক বড় বাধা।
৫
বাংলাদেশে যখন ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এণ্ড কলেজে একজন ছাত্রী এক শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষিত হল, তখন প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল ঢাকা। দিল্লীর ঘটনাটিও ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণ বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এসব শুভ লক্ষণ। কিন্তু আলোর অন্যদিকে অন্ধকারের ভয়ও থাকে। দুটি ঘটনাতেই ভিকটিম স্বচ্ছল পরিবারের। কিন্তু ধর্ষণ তো উপমহাদেশের গ্রামেগঞ্জে-মফস্বলে-শহরতলীতে ঘটে চলেছে অনেক নিম্নবিত্ত নারীর সাথেও। সেইসব ঘটনার কোনো প্রতিবাদ হয় না কেন নাগরিক পরিসরে? ভারতে ও বাংলাদেশে? বলা দরকারঃ ইয়াসমিন ধর্ষণের প্রতিবাদে যখন ফুঁসে উঠেছিল দিনাজপুরের গণমানুষ, তখনও কিন্তু সেই আন্দোলনের ঢেউ তেমনভাবে লাগে নাই মহানগরীতে। তবে কি মহানগরীগুলো ইতিমধ্যেই পরিণত হয়ে গেছে মৃতনগরীতে?
৬
এদিকে ব্যাটাগিরির সংস্কৃতিও গ্রাস করেছে আজ সারা পৃথিবীকে। হোমল্যাণ্ড সিকিওরিটির উছিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালালো ইরাকে, আধিপত্যকামীর বীরত্ববাসনায় একদিকে ইরাকি নারীরা হারালো স্বামী-সন্তান আর অন্যদিকে আমেরিকান সৈন্যরা আর ফিরে এলো না তাদের মায়ের বোনের কাছে। যুদ্ধ, নিরাপত্তা, আত্মমর্যাদা সবকিছুর সংজ্ঞাই আজ নির্ধারিত হয় ব্যাটাগিরির নিজস্ব মাপকাঠিতে। প্রতিটি রাষ্ট্র তার সাধ্যমত বাড়িয়ে তুলছে সেনাসংখ্যা, কাতারে কাতারে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সন্তান প্রাণ হারাচ্ছে সেনাপোষাক পরিধান করে নিরর্থক সব আধিপত্যকামী আদর্শের জন্য। ফুলের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কবরের সংখ্যা, এত বেশি পরিমাণে যে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশও আজ অসম্ভব হয়ে পড়ছে মানুষের জন্য। আর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের নামে বসেছে ধর্ষণের উৎসব দুনিয়ার নানান জায়গায়। কি বসনিয়ার জাতিগত সহিংসতা, কি গুজরাটের সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ-সর্বত্র সন্ত্রাসের প্রথম শিকার নারী। খবরে প্রকাশ, মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশে নাকি কয়েক সপ্তাহের জন্য বৌ কেনে ধনী দেশের পর্যটকেরা। ব্যাটাগিরি ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেশ-কালের পরিচিত সকল সীমানা।
৭
দিল্লীর মেয়েটি মারা গেছে। মরে গিয়ে একরকম বেঁচে গেছে, বেঁচে থাকলে প্রতি মুহূর্তে খুন হত। সমাজের হাতে, রাষ্ট্রের হাতে। বেঁচে থাকলে ট্রমা-আক্রান্ত মানুষ হিশেবে বাঁচতো পরিচিত অপরিচিত নানা জনের করুণা নিয়ে। যেমন বেঁচে আছে বসনিয়ার সার্ব রেইপ ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা বসনিয়ার মুসলমান ও ক্রিশ্চান মেয়েরা।
একটি জীবন হারিয়ে গেছে। মেয়েটির কি কোনো ভালবাসার মানুষ ছিল? থাকলে সেই ছেলেটি হয়তো আজ হারিয়ে ফেলেছে তার মানসিক ভারসাম্য। মেয়েটির মা-বাবা-ভাই-বোন কিভাবে বেঁচে আছে? যখন মেয়েটির মৃত্যুর স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসবে, তখনও হয়তো কোনোদিন ভাতের নলা মুখে তোলার সময় তার মা/বাবা/ভাই/বোনের মনে পড়বে তার কথা, তারা প্লেট ফেলে রেখে টেবিল থেকে উঠে যাবেন। মেয়েটির ঘর খালি পড়ে থাকবে। খাতায় আর দাগ পড়বে না কলমের, বইয়ে ধূলো জমবে। মেয়েটি আস্তে আস্তে তার পরিবার-প্রতিবেশি-পাঠশালা সব জায়গা থেকে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
কিন্তু জীবনগুলো যে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বাতাসে!
জীবনগুলোকে কে বাঁচাবে?
আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এই প্রশ্নের উত্তর দেবার...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৪