somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরাধীর সাথেও অপরাধমূলক আচরণের মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন কাম্য নয়

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে ও ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু এই ক্ষোভের প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে যা আশংকাজনক। যাবতীয় শোষণ নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের ইতিহাসে যত আন্দোলন হয়েছে তার পর্যালোচনা করলে প্রায় প্রতিটি ব্যর্থ আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে একটি কমন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটি হলঃ আন্দোলনকারী জনগণের আবেগ সংগঠিত উপায়ে পরিচালিত না হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে পরিচালিত হওয়া। সাম্প্রতিক ধর্ষণবিরোধী ক্ষোভের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতাটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই এই বিষয়টিতে সময় থাকতেই সচেতন হওয়া আমাদের সবার জন্যই আবশ্যক।

ফেসবুকে একটি ইংরেজি নোটে দেখলাম কেউ একজন ধর্ষণ প্রতিরোধে ইরানের মত শরিয়া আইন প্রয়োগের দাবী তুলেছেন। এবং অনেকেই তাঁর দাবী সমর্থনও করছেন। সেই নোটে এবং ফেসবুকে-ব্লগে-বাস্তবজীবনে এই ধারার কথা অনেককেই বলতে শুনেছি যে ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার "একমাত্র কারণ" যথাযথ শাস্তি না হওয়া। তাই কঠোর শাস্তি দিলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে! কি আশ্চর্য রকমের সহজ সমাধান !!!

পাঠ্যবই-অপাঠ্যবই-নাটক-সিনেমা-গল্প-উপন্যাস-কবিতা-চিত্রকলা-ভাস্কর্য সব জায়গায় নারীকে পণ্য হিশেবে উপস্থাপন করার পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ভোগবাদী সংস্কৃতি বহাল থাকবে, ঘরে-বাইরে-স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-অফিসে আদালতে-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সর্বত্র নারীবিরোধী মন্তব্য বক্তব্য বহাল থাকবে, ছোটবেলা থেকেই ছেলেসন্তানকে বীর আর মেয়েসন্তানকে লজ্জাবতী হওয়ার ট্রেনিং দেওয়া বহাল থাকবে, পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে সব জায়গায় পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতা বহাল থাকবে... "শুধুমাত্র" ধর্ষককে কঠোর শাস্তি দিতে পারলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে!!! "আহা বেশ বেশ বেশ"...

ইরানের ব্যাপারে একটা কথা বলি। প্রথমত, ইরানে প্রকাশ্য দিবালোকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় ধর্ষণের জন্য নয়,জেনা করার জন্য। কোরানে জেনা, অর্থাৎ "নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক" কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা ইসলামের নৈতিকতার মাপকাঠিতে অনৈতিক। ইসলামে বিশ্বাসী ও ইসলামে অবিশ্বাসীর ক্ষেত্রে এই নৈতিকতার মাপকাঠি মানা না-মানা উভয়েরই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ধর্ষণ নৈতিকতার বিষয় নয়, ধর্ষণ করার স্বাধীনতা ইসলামে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী কারোই থাকতে পারে না, কেননা এটা মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ। বাংলাদেশে যদি আজকে ইরানি কায়দায় শরিয়া আইন চালু হয় তবে সমূহ সম্ভাবনা আছে ধর্ষকের বিচার না করে সেই আইন ব্যবহার করা হবে জেনাকারীদের বিচারে। সেটা কি কাম্য?

ধরে নিলাম, বাংলাদেশে প্রকাশ্য দিবালোকে জেনাকারীকে নয়, ধর্ষককেই ইরানি কায়দায় শাস্তি দেওয়া হবে। কেন? কারণ তাতে শাস্তির বীভৎসতা দেখে সম্ভাব্য ধর্ষকরা ভয় পাবে এবং ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকবে। অর্থাৎ সমাজের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মনুষ্যত্বের সংস্কৃতি বিকশিত করে ধর্ষণ বন্ধ করতে চাই না আমরা, ভয় দেখিয়ে মানুষকে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে চাই!!! এটা কি সুস্থ চিন্তা???

তাহলে কেন আমরা ক্রসফায়ারে বিচার-বহির্ভূত হত্যার নিন্দা করি, সৌদি আরবে গলা কেটে খুনের শাস্তি দেওয়া দেখে অশ্রুপাত করি? খুন বা ধর্ষণকে অপরাধ হিশেবে গণ্য করার মূল কারণ হল এগুলো ব্যক্তির সাথে পরিচালিত হলেও শেষ বিচারে মানবতারই বিরুদ্ধে যায়। তাই এগুলোকে আমরা বলি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এবং এই ব্যাপারটাই খুনী বা ধর্ষককে শাস্তি দেওয়াটা জাস্টিফাই করে। এখন খুনী বা ধর্ষককে শাস্তি দিতে গেলেও যদি সেই মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক আচরণই তাদের সাথে করতে হয়, ভয়ের সংস্কৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে হয়; তাহলে কিসের বেসিসে আমরা খুনী বা ধর্ষককে শাস্তি দেব?

খুনী বা ধর্ষকের শাস্তি অবশ্যই হতে হবে, কিন্তু সেই শাস্তিও লিঙ্গকর্তন-গলাকাটা-প্রকাশ্যফাঁসি হতে পারে না। সেই শাস্তিও মনুষ্যত্বের সীমা ছাড়াতে পারে না। আর খুনী বা ধর্ষক যে ব্যবস্থায় তৈরি হয় ও বিকাশ লাভ করে, সেই ব্যবস্থা্টাকে বদলানোর জন্য সামষ্টিক সংগ্রামে না নেমে কেবল শাস্তিকেই মুখ্য করে তোলা এক প্রকারের স্ববিরোধিতা। খুন বা ধর্ষণের বিরুদ্ধে জেহাদে আমাদেরকে যদি জিততে হয়, তাহলে আবেগকে সংগঠিত উপায়ে পরিচালিত করতে হবে, যেহেতু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ কেবল ব্যর্থতার উদাহরণই বৃদ্ধি করে...

(প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও বাম রাজনীতিক ফিরোজ আহমেদের একটি বক্তব্য নিজের ভাষায় ব্যবহার করেছি।)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×