somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিছু প্রশ্নঃ কাফনশহর থেকে ফিরে এসে...

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



I do what I do, and write what I write, without calculating what is worth what and so on. Fortunately, I am not a banker or an accountant. I feel that there is a time when a political statement needs to be made and I make it. -Arundhati Roy

সাভার এখন এক কাফনশহর। সেই কাফনশহরের 'বাতাসে লাশের গন্ধ, মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।' কাফনশহর থেকে ফিরে এসে লিখছি, বাধ্য হচ্ছি লিখতে, কারণ কিছু প্রশ্ন আমাকে পাগলা কুকুরের মত তাড়া করে ফিরছে।

খুব সহজ একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি, রানা প্লাজায় যা হল তা কি কোনো 'দুর্ঘটনা?' এর উত্তরটাও খুবই সহজ। উত্তরটা হচ্ছেঃ না, এটা একটা 'স্ট্রাকচারাল কিলিং।' এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে ব্যক্তি আছে, আছে গোষ্ঠী ও দল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর জন্য দায়ী সেই স্ট্রাকচার যে স্ট্রাকচারে বাংলাদেশের জনগণ বাস করছে ৪২ বছর ধরে।

এবার অন্য প্রশ্নগুলি করছি। উত্তর দেওয়ার চেষ্টাও করব না। খালি একটানা প্রশ্ন করে যাবো, কারণ ইতিহাসে এমন সময় আসে যখন উত্তর দেওয়ার চেয়ে প্রশ্ন করাটাই বেশি জরুরী হয়ে ওঠে।

রানা প্লাজা গড়ে উঠেছে যেই জমির ওপরে সেটা কি পাবলিক প্রোপার্টি? যদি পাবলিক প্রোপার্টি হয় তাহলে কি বেদখল হয়েছে? যদি বেদখল হয় তাহলে তখন আইনকানুন কি কোথাও নিদ্রা যাচ্ছিল? আইন কি শুধু নিরীহ নখদন্তহীন ব্লগারদের ক্ষেত্রেই জেগে ওঠে? এই ধরণের ভবন নির্মিত হওয়ার অনুমতি পায় কি করে? কে দেয়? কেন দেয়? কোন প্রক্রিয়ায় দেয়? দৃশ্যের অন্তরালে কি একটা বিশাল শেকল আছে? সেই শেকলের শেষ প্রান্তে কে আছেন? এটা তো জানা ছিল ভবনটা ভঙ্গুর, জেনেও ভবনের সব কাজ স্থগিত করা হল না কেন? ভবনের ভেতরে থাকা একটি বিশেষ বেসরকারি ব্যাংকের সব মালসামান কয়েকদিন আগে থেকেই সরানো শুরু হয়েছে, গার্মেন্টস চারটির ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটলো না কেন? যাঁরা ব্যাংকে কাজ করেন তাঁরা 'ভদ্রলোক' আর যাঁরা গার্মেন্টসে কাজ করেন তাঁরা 'গরীব' এই কারণে? গার্মেন্টস কর্মীরা প্রাণের ভয়ে কাজ করতে চাননি, তাঁদেরকে জোর করে ভয় দেখিয়ে ভেতরে ঢোকানো হয়েছে, কেন? মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য? মানুষের জীবনের চেয়ে মুনাফার মূল্য বেশি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে, এই কারণে? তাহলে এই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে থেকে আমাদের কি ঘোড়াটা লাভ হচ্ছে? উদ্ধার তৎপরতার শুরুতেই যুবলীগ নেতা এবং রানা প্লাজার অবৈধ মালিক সোহেল রানাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুরাদ জং দলবল নিয়ে গিয়ে উদ্ধার করেন, তারপর থেকে সোহেল রানা কোথায়? তাঁকে কি শাস্তি দেওয়া হবে? আদৌ কি কোনো শাস্তি দেওয়া হবে? উদ্ধার তৎপরতায় এখন পর্যন্ত অধিকাংশ কাজ করেছেন সাভারের জনগণ, সারা দেশ থেকে খাবার-পানি-অক্সিজেন-টর্চ-ঔষুধ নিয়ে সাভারে ছুটে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছেন শত শত চিকিৎসক, রক্তের বন্যা বইছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার পুনর্জন্মভূমি শাহবাগে, কিন্তু রাষ্ট্র কি করছে? উদ্ধার তৎপরতায় পুলিশ ও আর্মির ভূমিকা অস্বীকার করা সম্ভব না, কিন্তু তাঁরা যতটুকু আছেন তা কি পর্যাপ্ত? রাষ্ট্রের কি আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা ছিল না? আর উদ্ধারকাজে কোনো কো-অর্ডিনেশন নেই কেন? রানা প্লাজার আশেপাশে থাকা মানুষেরা আমাদের জানাচ্ছেন রাতের বেলা গুম করা হচ্ছে শত শত লাশ, এসব লাশ যাচ্ছে কোথায়? কেন যাচ্ছে? কেন গুম করা হচ্ছে? কেটে কেটে কোথায় ফেলা হচ্ছে? সরকারি হিসেবে লাশের সংখ্যা আমার জানামতে এখন পর্যন্ত দুইশ ছয়, বাস্তবে কয় হাজার? এক? দুই? তিন? তাজরিনে মানুষ-পোড়া ছাই পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়েছিল, এখানে লাশ গুম হচ্ছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলি কি দাশাউ বা আউশভিৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প? তাজরিন থেকে রানা, গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? কথায় কথায় বন্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো, আর শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে খোলা হয় একটার পর একটা বাহারী শপিংমল, কেন? ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে জাতীয় পুঁজির ভিত্তি গঠন করার জন্য তোলার জন্য দেশপ্রেমিক বড়লোক দরকার, গার্মেন্টসের মানুষ-মারা ছ্যাঁচড়া বড়লোকগুলি খালি পারে নিজস্ব সম্পত্তির ভিত্তি গড়তে, রাষ্ট্র কেন এই ছ্যাঁচড়া বড়লোকগুলিরে দুধ কলা দিয়ে পোষে? নাকি এরাই রাষ্ট্ররে পোষে, এঁদের হাতেই আসল ক্ষমতা? নাকি, এরাই রাষ্ট্র? আর আমাদের ইনসানিয়াতের সীমা সাহায্য-সহযোগিতা পর্যন্ত পৌঁচেছে, এটাকে কি আরেকটু প্রসারিত করা যায় না? যদি যায়, কতটুকু? যেই স্ট্রাকচার একটার পর একটা গণহত্যার জন্ম দিয়ে চলেছে, সেই স্ট্রাকচারকে কি আমরা ভেঙে ফেলতে পারি না? যদি পারি, কবে? ৪২ বছর একটা স্বাধীন দেশের জন্য খুব একটা কম সময় না, ৪২ বছরে আমরা ঠিক কতোটা এগিয়েছি? ৫ শতাংশ মানুষের বিলাসবহুল জীবন এখানে গঠিত হয় ৯৫ শতাংশ মানুষকে জোঁকের মত চুষে, এটা কি আমরা বুঝি? পশ্চিমা দেশগুলির দালাল অই ৫ শতাংশ ছাড়া আর কে সত্যিকার অর্থে ভালো আছে এই দেশে? গরীব, যাঁর কিছুই হারানোর নেই, তবু যাঁর একমাত্র সম্পদ রক্ত শুষে টিকে আছে স্ট্রাকচার? মধ্যবিত্ত, যাঁর কাছে জীবনের অর্থ হয়ে গেছে বউবাচ্চা/স্বামীসন্তান-এর শখ মেটানো, আর প্রতিবাদহীন নিঃশ্বাস নিয়ে চলা? দেশপ্রেমিক বড়োলোক, যাঁরা শিল্প গড়ে তুলতে চায়, কিন্তু রাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে পারছে না? ভালো যে নেই আমরা কেউ, সেটা কি আমরা বুঝি? যদি বুঝি, সেটা কি পরীক্ষার খাতার জন্য বুঝি, নাকি সত্যি সত্যি বুঝি? যদি সত্যি সত্যি বুঝি, তো আমাদের কী করণীয়? কী করতে পারি, আমরা? কী? কী? কী?



এই প্রশ্নগুলো আমাকে তাড়া করছে, আর আমার ধারণা; আমাদের অধিকাংশকেই করছে।

একা এসবের উত্তর পাওয়া যাবে না, পেতে চাইলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আর তাঁর জন্য অরাজনৈতিকতার অমানবিক সুখ ছাড়তে হবে, কারণ রাজনীতি যেহেতু আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে সেই কারণে আমাদেরকেও আমাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আপাতত, এই মুহূর্তে, আপনার পাশের মানুষটির হাতই সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তাই বিচ্ছিন্ন না থেকে তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরুন, কারণ এই মৃত্যু-উপত্যকায় আমরা কেউ একা একা বাঁচতে পারবো না...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে কিশোর শ্রী জয়ন্ত নিহত: স্বর্ণা দাস হত্যার এক সপ্তাহ না পেরোতেই আবারও ভারতের পৈশাচিকতা!

লিখেছেন মিথমেকার, ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১


ছবি: দৈনিক ইনকিলাব।

"ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে জয়ন্ত কুমার (১৫) নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জয়ন্তের বাবা মহাদেব চন্দ্র (৪৩) এবং প্রতিবেশী দরবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

অন্দোলন কারীদের প্রতি হাসনাতের বৈষম্য - "৯ আর ১ দুইটাই ডিজিট, কিন্তু দুইটা তো সমান না। কারো কারো অবদান কারো কারো চেয়ে বেশি।"

লিখেছেন আহসানের ব্লগ, ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:১৯


এই হাসনাত আব্দুল্লাহদের বাড়াবাড়িগুলা বেশ অনেক দিন ধরেই চোখে পড়তেসে। সব জায়গায় এমনকি সচিবালয়ে পর্যন্ত এদের একদম ভিআইপি এক্সেস। কেন? দেশের যে কোন জায়গায় পান থেকে চুন খসলেই সেখানে হাসনাতরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বাংলাদেশকে পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করার পরামর্শ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০১

বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার পরামর্শ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছেন: সে সেনা তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন। (সাময়িক)

লিখেছেন মিথমেকার, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৩৩



খুলনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উন্মত্ত জনতার হা’মলায় আহত উৎসব মন্ডল সামরিক হাঁসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
উৎসব মন্ডল এর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বেশ ভালো। চিকিৎসকরা খুব আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিচ্ছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গল্পের শেষ নাই.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪

যে গল্পের শেষ নাই.....

পাসের সীটের যাত্রী সাথে আলাপচারিতায়- নাম জানার পর, জিজ্ঞেস করলাম- "বাড়ি কোথায়?"
ছেলেটি বলল- 'ঝালকাঠী, কীর্ত্তিপাশা গ্রাম।' কীর্ত্তিপাশা শুনেই বুকের ভিতরে উথাল পাথাল ঢেউ- এক কিশোরীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×