মুঘল আমল থেকে যদি ইতিহাস দেখি - মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ট হয়ে ভারত শাসন করে - ফলে একটা শাসক শ্রেনী তৈরী হয়। যার কিছু অংশ ঢাকায় নবাবদের ইতিহাসের সাথে সম্পৃত্ত। পরে ইংরেজ আসার পর মুসলমানরা পিছিয়ে যায় - হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজদের সাথে সহযোগীতা করে এগিয়ে যায়। তৈরী হয় আরেকটা শাসক শ্রেনী - যা আমরা দেখি পরবর্তীতে জমিদার শ্রেনী রূপান্তরিত হতে।
পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা ধীরে ধীরে এগুতো থাকে - তৈরী হয় আলিগড়। আলিগড় গোস্ঠী ইংরেজদের সহযোগীতার হাত বাড়ায়। অন্যদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে তৈরী হয় জমিদারী শ্রেনী।
ইংরেজরা যখন নিশ্চিত ভাবে ভারত ছাড়ার পরিকল্পনা করে - তখন উঠতি মুসলমান শ্রেনী - যারা অর্থবিত্ত - শিক্ষা অগ্রসর হয়ে নগর জীবন যাপন করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলো - তারা প্রমাদ গুনলো। সেই সময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো মুসলিম লীগের দ্বিজাতী তত্ত্ব। ঘটনা প্রবাহে দ্বিজাতী তত্ত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ এবং বিজয় হলো ৪৭ সালে। জন্ম হলো পাকিস্তানের। কলকাতা কেন্ত্রিক নাগরিক সুবিধাভোগী অগ্রসর শাসক শ্রেনী ঢাকায় এসে সকল গুরুত্বপূর্ন পদগুলো দখল করলো। তারা তাদের মতো করে শাসন চালালো। এখানে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একটা সমস্যা তৈরী করে ফললো জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে আর ঋণ শালিসি বোর্ড করে সাধারন মানুষগুলোকে সত্যিকারে মুক্তি দিয়ে দিলো। ফলে জামিদার শ্রেনী মুসলিমলীগের রাজনীতি হয়ে উঠলেও জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলো।
জনবিচ্ছিন্ন মুসলিমলীগের পাকিস্থানী শাসকদের মতাদর্শের অনুসরন পূর্ব বংগের সাধারন মানুষ - বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এক সময় প্রতারিত বোধ করলো। এরা দ্রুতই সংগঠিত হয়ে আওয়ামীলীগের ব্যানারে অসাপ্প্রদায়িক ধর্ম-নিরপেক্ষ একটা মতবাদকে জনপ্রিয় করে তুললো। ফলাফল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় - আর ৪৭ মতাদর্শের সাময়িক পরাজয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই ৪৭ গোস্ঠীকে চিনতে ভুল করলেন - তাদের স্বপদে বহাল রাখলেন - তার মাসুল তাকে দিয়ে হয়েছে জীবন দিয়ে।
কিন্তু পরাজিত ৪৭ গোষ্ঠী কিন্তু থেমে যায়নি - এরা সংগঠিত হয়ে একটা মরনছোবল দিলো - ৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা এবং জেলে চার নেতা হত্যার পর জিয়াউর রহমানের নেতুত্বে আবার দ্বিজাতী তত্ত্বের অনুসারীরা আবারো ঐক্যবন্ধ হয়ে শাসন ভার গ্রহন করলো - যার ফলে আমরা দেখি শুধুমাত্র কাগজে কলমে মুক্তিযুদ্ধের কথা থাকলেও ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পুরোপুরি দ্বিজাতী তত্ত্বের অনুসারে দেশ শাসিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করেছে রাষ্ট্রীয় ভাবেই। ধর্মকে ব্যবহার করে হয়েছে সাধারন ধর্মপ্রান মুসলমানদের সমর্থন ধরে রাখার জন্যে।
পরবর্তীতে এরশাদ বিরোধী গনআন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ৭১ পন্থীরা তাদের অবস্থাননগুলো ফিরে পেতে শুরু করে। কিন্তু তখনও রাষ্ট্রীয় উচ্পদগুলোতে দ্বিজাতীতত্ত্বের সমর্থকরা নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিলো। সেনাবাহিনী, উচ্চ আদালত, সচিবালয় সব ক্ষেত্রেই দেখা যেতো কেমন যেন একটা গোপনীয় অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তিকে সব কিছুতেই বাঁধা পেতে হতো। যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে শুরু করে ৭৫ এর হত্যাআন্ডের বিচারগুলোকেই এরা অবজ্ঞা করেছে। উচ্চ আদালতে যুদ্ধাপরাধী নাগরিকত্ত্ব পেয়েছে - বিচারের অভিযুক্তরাও ছাড়া পেয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে - ঐ সময়ে যে বিচারকরা বসে ছিলেন - এরা ৪৭ এর প্রডাক্ট। এই গোষ্ঠী বিজয়ী বাঙালী জাতিকে ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিকাশের সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে আছে। যার ফল দেখা যায় - ৬০ বছর আগে ভাষা আন্দোলন হলেও আজও সরকারের উচু মহলে বাংলা ব্যবহার হয় না। সমাজের অগ্রসর শ্রেনী তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা শেখায় না - বাংলা আজও ২য় শ্রেনীর ভাষা হিসাবে বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। উদ্দু চালু করতে না পারলেও এরা ইংরেজীকে বাংলার উপর প্রাধান্য দিয়ে রেখেছে - যাতে সাধারন মানুষের উপর একটা সংস্কৃতিক প্রাধান্য ধরে রাখা যায়।
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ৭১ সমর্থকদের নিজেদের অনৈক্য আর ৪৭ গোষ্ঠীর সুচতুর ভারত বিরোধী এবং ধর্ম ব্যবহারের কৌশল - দীর্ঘ কাল ধরে বাংলাদেশের তরুনদের আকর্ষন করেছে। ফলে এরা নিশ্চিত ছিলো - দ্বিজাতীতত্ত্বের কখনই মৃত্যু হবে না।
৪৭ গোষ্ঠীর উপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে বিগত সংসদ নির্বাচনে। বিগত নির্বাচনে তরুন ভোটারদের একটা বড় অংশই ভোট দেয় ৭১ এর পক্ষে। এতে ৪৭ গোষ্ঠী ভীত হয়ে উঠে। শুরু হয় আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কাজ। আজ আমরা দেখি জামায়াতের মতো দেশবিরোধীরাও ৭১ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে যোগ দিয়েছে। সবার কমন শত্রু হলো - আওয়ামীলীগ। সুষ্পষ্ট করে বললে বলতে হয় - এদের টার্গেট শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে সরাতে পারলে ৭১ পন্থীরা আবার ছত্রভংগ হয়ে যাবে - ফলে এরা আবার বিভাজনের রাজনীতিতে দ্বিজাতীতত্ত্বকে পুনস্থাপন করতে পারবে।
আমি মনে করি ৪৭ গোষ্ঠীর সাথে ৭১ গোষ্ঠীর দন্দ্বই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতের মুল কারন। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে - আওয়ামীলীগ আর বিএনপির মধ্যে কর্মসূচী বা লক্ষ্য নিয়ে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে দুরত্ব হাজার মাইল। খালেদা জিয়ার হাতে এখন দ্বিজাতীতত্ত্বের ঝান্ডা - যে কোন মুল্যের বিনিময়ে ৪৭ গোষ্টী আবার ক্ষমতায় আসতে চাইছে - যাতে গত নির্বাচনের তাদের হারানো তরুন সমাজ যেন পুরোপুরী তাদের থেকে দুরে সরে না যায়।
অন্যদিকে ৭১ সমর্থকরা এখন দ্বিধান্বিত। বিশেষ করে বামরা। এরা ইতিহাসে সব সময়ই শত্রুমিত্র চিনতে ভুল করেছে। ৯০ থেকে ২০০৮ পর্যণ্ত একদল বাম ৭১ এর পক্ষে শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা চাইতে শত্রু শত্রু আমার মিত্র ফর্মুলায় ৪৭ সমর্থকদের সমর্থণ দিয়ে এসেছে। এখনও বামদের একটা বড় অংশ নানান তত্ত্বের আলোকে ৭১ এর সমর্থকদে ঐক্যবদ্ধ থাকতে দিচ্ছে না। অন্যদিকে ৪৭ গোষ্ঠী উগ্র সাম্প্রদায়িক জংগী থেকে শুরু করে খুনী চোর বাটপার যাকে পাচ্ছে তাকেই ঐক্যবদ্ধ করছে। বিএনপির জাতীয়তাবাদী নীতির উদারতা থেকে শত মাইল দুরে হিজবুত ও এদের মিত্র। খালেদা জিয়া অবলীলায় মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ স্বজন হারানোদের সাথে তামাশা করছে - জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। কারন একটাই - দ্বিজাতীতত্ত্বকে বাঁচানো। এই জন্যে তাদের বহুল ব্যবহূত ভারতবিদ্ধেষী অবস্থান আর ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।
শেষ কথা হলো - এই দুই মতাদর্শ অনন্তকাল ধরে পরষ্পরের সাথে সংঘাত চালিয়ে যেতে পারবে না। একটাকে পরাজিত হতেই হবে। প্রশ্ন হলো কে পরাজিত হবে?
আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে ৭১ এর শক্তিকে সম্ভাব্য বিজয়ী হিসাবে বিবেচনা করা যায় - কিন্তু ৪৭ এর শক্তিও মোটেও ফেলনা না। এরাও তরুনদের মাঝে যথেষ্ঠ সমর্থক তৈরী করতে পেরেছে। সামনে আরেকটা যুদ্ধ হবে। এবার হয়তো প্রশাসন, বিচার বিভাগ বা আর্মি থেকে ৪৭ গোষ্টী আগের মতো সহায়তা পাবে না - কিন্তু তাদের হাইব্রিড প্রজন্ম আর বামদের ৭১ এর শক্তির সাথে অনৈক্যের সুবাদে এরা হয়তো আবার বিজয়ী হবে। গতবার কিবরিয়া, আসানুল্লাহ মাস্টার, ৬৩ জেলার বোমাবাজি, বাংলাভাই, নানান ধরনের জংগী তৎপরতার পর তাদের উপলদ্ধি হলো - মুল বাধা হলো শেখা হাসিনা - গ্রেনেড হামলা হলো দিনদুপুরে - উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিলো - শেখ মুজিবকে হত্যা করে ৭১ এর চেতনাকে মোটামুটি করব পর্যন্ত পাঠালেও শেখ হাসিনাকে ঘিরে আবার তা ফিরে আসছে। শেখ হাসিনাকে যদি হত্যা করা যেতো - তাহলে হয়তো আজ আমার এই লেখার দরকার পড়তো না। আমাকে হয়তো আরো অনেকের হত্যার বিচার চাইতে হতো।
৭১ এর চেতনাকে যারা ধারন করেন - যারা বাঙালী জাতিত্ত্বাকে নিজের জাতিগত পরিচয় হিসাবে দেখতে গর্ববোধ করেন - যারা ৭১ কে বাংলাদেশের মানুষের জন্যে বাঙালী জাতিসত্ত্বার বিজয় হিসাবে বিশ্বাস করেন। তাদের জন্যে সামনে খুবই কঠিন সময় আসছে। ৪৭ এর ঝান্ডাধারী এক মরিয়া নেতৃত্বের পেছনে সংগঠিত হচ্ছে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী থেকে শুরু করে ইংরেজদের উচ্ছিষ্টভোগী এলিট শ্রেনী - যারা চমৎকার কৌশলে আমাদের জাতীয় পরিচয়ের মাঝে দ্বিজাতিত্ত্বকে সন্নিবেশিত করে। এরা ঐক্যবন্ধ হয়েছে আবহমান বাংলার সাধারন মানুষের বিজয়কে নিজেদের থাবায় বন্দী করতে। যদি ৭১ এর শক্তি এখনই ঐক্যবন্ধ না হতে পারে তবে হয়তো আমাদেরকে আরেকটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে - কারন শেষ বিচারে দ্বিজাতীতত্ত্বকে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ কখনই নিজেদের দর্শন হিসাবে মেনে নেবে না - তাই ৪৭ এর শক্তির বিজয় আবারো সংঘাতের জন্ম দেবে।
(লেখাটি সম্পাদিত হবে )
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:৪০