26 জুন 2016 রোজ রবিবার, রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় একটি নির্মাণাধীন মসজিদে নামাযে বাঁধা দেয় পুলিশ। জাতীয়ভাবে প্রতিবাদ তো দূরে থাক, স্রেফ ফেসবুকে ছোট ছোট স্ট্যাটাস দিয়েই মানুষের ঢলে পরের জুম’আয় মসজিদ বাঁধামুক্ত হয়ে যায়। এরকম “ছোট ছোট” ধর্মীয় বিষয়ে (রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া) আমজনতা মাঠে নেমে দাবী আদায় করেছে বারবার।
অথচ বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ইসলামি চ্যানেল থুড়ি মেরে বন্ধ করে দিল সরকার, একটা মানুষও মাঠে নামল না। কেউ টিভি ভেঙে ফেলল না!
যেখানে পিস টিভি-নির্ভর স্কলারদের কেউ বললেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে https://m.youtube.com/watch?v=fZLXCCDNZyI
যেখানে কেউ বললেন, পিস টিভি বন্ধ হলে লাথি মেরে টিভি ভেঙে ফেলতে https://m.youtube.com/watch?v=38OUJHqYyCY
এই নিরবতা, নির্লিপ্ততার মূলে রয়েছে, চ্যানেলটি ভারত উপমহাদেশের মেইন স্ট্রীম আলেম এবং জনগনকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। অসম্পৃক্ততার ও নিরবতায় বেশ কিছু সঙ্গত কারণ।
তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
(1) চ্যানেলটিতে ভারত উপমহাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের আলেমদেরকে মূল্যায়ন না করা।
(2) ডাক্তার জাকির নায়েকের মানহাজ সিলেকশনে অদূরদর্শীতা।
(3) পিস টিভি (বিশেষত বাংলা)তে আলোচক সিলেকশনে মারাত্মক ভুল।
(4) অর্থ ও রাষ্ট্রশক্তিতে নির্ভরশীলতা।
[এক]
পিস টিভির জন্য কেন দেওবন্দ থেকে আন্দোলন হয় না, পাকিস্তানের তারিক জামিল থেকে তাকি উসমানি (দা: বা কেন কিছুই বলেন না, কিংবা বাংলাদেশের আল্লামা শফি থেকে প্রিন্সিপাল হাবিবুর রাহমান কেন আন্দোলনের ডাক দেন না- এসব প্রশ্ন বাতাসে। কিন্তু যারা এসব প্রশ্ন উত্থাপিত করছেন তাদেরকে যদি উল্টো প্রশ্ন করা হয়, “এসব আলেমগণ কি জানেন পিস টিভি কী, তাদেরকে কি চেনানো হয়েছে টিভির দুয়ার, তাদেরকে কি কখনো একটি বার সুরা ফাতিহা পড়ার জন্য হলেও দাওয়াত দিয়েছেন?” জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এরকম আলেমদেরকে সাইড লাইনে রাখলে তারা সেধে এসে ইজ্জত হারাবেন, এই আশাটা যুক্তিযুক্ত নয়।
[দুই]
যারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন তারা জানেন, ইসলামের মাসআলা মাসাঈল বিষয়ে বিভিন্ন School of Thought এর ভিন্নতার কারণে মাযহাবের ভিন্নতা এসেছে। পৃথিবীতে মুসলমানদের প্রায় 99% এর বেশি মানুষ চার মাযহাবের কোন একটি অনুসরণ করে। ভারত অঞ্চলের প্রায় সকলেই হানাফি মাযহাবের অনুসারী। সেই অঞ্চলে হানাফি মাযহাবের বিপরীতে অভিমত দিয়ে, আরেকটু এগিয়ে বললে, সবক’টি মাযহাবকে অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন উল্লেখ করে শায়খ আলবানি (রাহিমাহুমাল্লাহ)র মানহাজ অনুসরণ করতঃ মাসআলা মাসাঈল প্রচার করার কারণে তিনি এবং তাঁর পিস টিভি সার্বজনীন হতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি দাওয়াতের ক্ষেত্রে ডক্টর আহমদ দিদাতকে অনুসরণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু আহমদ দিদাতের মতো মাস’আলা-মাসাঈল বিষয়ে তার মতো রিজিওনাল ডিমান্ড ফলো করতে পারেননি।
[তিন]
আলেমগণ এবং আপামর জনসাধারণ পিস টিভির জন্য না নামার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, পিস টিভিতে বিশেষত বাংলা পিস টিভিতে এমন কিছু ”স্কলার” বসানো হয়েছে, এমন সব “আলেম”কে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যারা মাযহাবের ইমাম থেকে আরম্ভ করে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের যুগ যুগ ইসলামের খাদেম আলেমদের ছিদ্রান্বেষণ করতে থাকেন!
যখন মাযহাবকে সরাসরি শিরক আখ্যা দানকারী হয়ে যান পিস টিভির স্কলার, তখন মাযহাব মানা আলেমগণ কীভাবে পিস টিভির জন্য আন্দোলনে নামবেন?
যখন পিস টিভির আলোচক বলেন, “তাবলীগীরা বউকে কোথায় রেখে জেলায় জেলায় ঘুরে”, তখন কী করে আশা করা যায়, মাওলানা তারিক জামিলের অনুসরণকারীরা পিস টিভির জন্য গাট্টিপুটলা নিয়ে রাস্তায় নামবে?
যখন পিস টিভির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্কলার বলেন- “চোরকে যেমন ধরা ফরয, পীরকে তেমন ধরা ফরয”, তখন চরমোনাই পীরের পক্ষের মানুষ কী করে মাঠে নামবে?
যখন পিস টিভির বদৌলতে ভোকাল হওয়া ব্যক্তি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভীকে মুশরিক আখ্যা দেন, তখন কী করে আশা করা যায়, দেওবন্দি মতাদর্শের লোকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে শাপলায় বা আগ্রায় যাবে?
যখন এই পিস টিভি নির্ভর শায়খ টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে বাজিয়ে “মাওলানা সাঈদীর শত শত ভুল” মানুষকে শুনিয়ে মজা লন, তখন কী করে আশা করেন মাওলানা সাঈদীর ভক্তরা পিস টিভির জন্য খালি বুকে রাস্তায় নামবে?
যখন শুধু পিস টিভি-ভিত্তিক শায়খ জুম’আর খুতবায় বলেন, “আল্লামা সাঈদী ষাট বছর ভুল নামায পড়েছেন” তখন কোন লজিকে বলা যায়, সাঈদীর জন্য রক্ত দেয়া, অশ্রুফেলা মানুষেরা পিস টিভির জন্য আন্দোলন করবে?
[চার]
এটা হচ্ছে, ডাক্তার জাকির নায়েক এবং তাঁর দলের সবচেয়ে দুর্বল ভিত্তি। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং রাষ্ট্রশক্তির নমনীয় দৃষ্টি থাকে তাহলে পিস টিভি কখনো বন্ধ হবে না। কখনো কখনো পিস টিভি স্কলারদের এমন আশ্বাসের কথাও শুনা গেছে। বলা হয়েছে, পিস টিভি ভারতে বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলাদেশে কখনো বন্ধ হবে না। কিন্তু শেষতক সেই চিরন্তন নিয়মকেই আবার স্মরিয়ে গেল। দাওয়াতী কার্যক্রম ততবেশি শক্তিশালী এবং মজবুত হয়, যতবেশি সাধারণ মুসলমানের নাগালে।
এরকম আরো অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে পিস টিভি বিষয়ে মুসলমানদের নিরবতার। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মাযহাবগত দিকটা আমলে নেয়া। ভারত উপমহাদেশের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য আলেমদেরকে পিস টিভির সাথে সম্পর্কিত করা। যে সকল শীর্ষস্থানীয় আলেম সর্বস্তরের মানুষের সাথে জড়িত এবং সাধারণ মুসলমানরা যে সকল আলেম দ্বারা প্রভাবিত, সেই আলেমদেরকে পিস টিভির দর্পণে ভাসিয়ে তোলা। জনগণ তো আপনার জন্য তখনই প্রাণ দেবে, যখন আপনি তার প্রাণ দখল করবেন। আর কারো প্রাণ দখলে নিতে প্রথমে তার প্রাণপ্রিয় বিষয়কে মূল্যায়ন করতে হবে- পিস টিভি এতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:০৪