somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের কবি, জীবনানন্দ

২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি জানি, কবিতার চেয়ে গল্প আমি খুব ভালো লিখতে পারি। কবিতা লেখা খুব কঠিন কাজ। তবু মাঝে মাঝে অলৌকিকভাবে কিছু লাইন এসে মনে আলোড়ন তৈরি করে। তখন মনে হয়, যেনো কোনো অজেয় পাহাড় বা অনাবিষ্কৃত দ্বীপ জয়ের আনন্দে হৃদয় ভরে যায়।
কবিতা লেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরচেয়ে একটা আস্ত গল্প লেখা অনেক সোজা। তবু কবিতার সাথে একবার প্রেম হয়ে গেলে, আর কোনো উপায় নেই। এই প্রেমে যে কী তীব্র মোহ, কী নিরন্তর দহন প্রতিনিয়ত, তা বলে বোঝানো যায়না। সে যখন তখন ধরা দিবে না, কাছে আসবেনা, দূরেও যাবেনা।
এলোমেলো মন তখন দিশেহারা পথিকের মতো গন্তব্য খুঁজে পায় না, আকুল পাথারে নাবিক কিনারা খুঁজে পায়না।
কবিতারও নিজস্ব মনমর্জি আছে নাকি?

একজীবনে যে মানুষটার কবিতা সবচেয়ে বেশি পড়েছি, সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি, তার ডাকনাম মিলু। জীবনানন্দ। আমার জীবনের আনন্দ।
বলতে দ্বিধা নেই, কবির চেয়ে বেশি তার কবিতাকেই ভালবেসেছি। তবু কারণে অকারণে কবির অন্বেষণে আমি বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরেছি।

সমগ্র ঢাকা শহর চষে বেড়ানো আমার নিত্যদিনের কাজ।
৪৭ পুরানা পল্টন থেকে বুদ্ধদেব বসু আর অজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত হাতে লেখা " প্রগতি " নামের পত্রিকা বের হতো। "খুশ-রোজী" নামের একটি কবিতা জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে এখানে প্রকাশিতো হয়েছিলো। একদিন গেলাম সেখানে। প্রগতি নামের কিছুই নেই।
পাটুয়াটুলির ব্রাহ্মসমাজের পাশ দিয়ে প্রায়ই যাই আসি। এখানকার রামমোহন লাইব্রেরিতে জীবনানন্দের সাথে লাবণ্যের বিয়ে হয়েছিলো।
বুদ্ধদেব বসুও ছিলো সেদিন।
মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগে, এখানেই তারা ছিলো, এখনো আছে, থাকবে। শুধু সময়ের ব্যাবধান মাত্র। এই পথ, আলো, বাতাস, মেঘ, পৃথিবী, আমরা সবাই একই বাঁধনে বাঁধা।
কবির সাথে আমি প্রায়ই হাঁটি। কবি কবিতা শোনায়, আমি শুনি। সে এক অনন্য অনুভূতি।

কলকাতায় জীবনানন্দ ১৮/২/এ, বি সি চ্যাটার্জি স্ট্রীটের যে মেস বাড়িটায় থাকতো, তার ঠিকানা লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে হিন্দু স্কুল, সংস্কৃত কলেজের সামনে দিয়ে বি সি চ্যাটার্জি স্ট্রীটে পৌছলাম। লোকদের বলেও বাড়িটা খুঁজে পেলাম না। চলে এলাম কবির কলেজ প্রেসিডেন্সী তে। কবির হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিঙেও গিয়েছিলাম। এখানে প্রচণ্ড অর্থকষ্টে কেটেছে কবির রাত্রিদিন। তবু রূপসী বাংলা আর ধানসিঁড়ি নদী বয়ে যেতো তার আদ্র হৃদয় জুড়ে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছিলাম, এই মাঠে ঘাসের উপর শুয়ে হয়তো কবি লিখে ফেলেছিল, অনন্ত নক্ষত্রবীথির কোনো প্রাঞ্জল কবিতা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পাশেই। এখানেও এসে মনে হলো, আমার প্রিয় কবির পাদচারণা ছিল এখানে। এই পথেই হয়তো কবি আনমনে চলে যেতো পিরামিড, ব্যাবিলনের দেশে।
কবি ইংরেজিতে বি এ, এম এ পড়লেও বাংলা সাহিত্যে যেভাবে আত্মনিবেশ করেছিলো, তা অভূতপূর্ব। এসব যায়গায় আমার প্রিয় কবির পদচারণা ছিলো। আমিও এখান দিয়েই হাঁটছি, ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল মনের ভেতর। কলকাতার সিটি কলেজে একদিন গেলাম। এখানে কবি কনিষ্ঠ অধ্যাপক ছিলো।
যেদিন হাওড়া গেলাম, সেখানকার গার্লস স্কুলে গেলাম। মৃত্যুর আগে এই স্কুলের শিক্ষক ছিলো কবি।
তারপর একদিন বালিগঞ্জ দিয়ে যাচ্ছি। কী যেনো একটা মনে পড়ার কথা। মনে আসছেনা। একটা ট্রামে দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। মনে পড়ে গেলো, এখানেই কবি ১৪ অক্টোবর হয়তো এই ট্রামটাতেই আঘাত পেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিলো।
আমি আর ভাবতেই পারিনা। যদি মৃত্যুতৃষ্ণা জেগে ওঠে!
কেনো এতো মৃত্যু পিয়াসী ছিলে তুমি, তবে কেনো বলেছিলে, তোমার যেখানে ইচ্ছা চলে যাও, আমি এখানেই থেকে যাবো ?

হয়তো মনের গভীরে আলো-অন্ধকারে, স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালবাসা নয়, অন্য কোনো বোধ কাজ করছিলো তার। সে তা এড়াতে পারেনি। সবকিছু তুচ্ছ, পণ্ড, শূন্য-শূন্য লেগেছিলো জীবনের।
অথচ এই মানুষটা নিজেই বলেছিলো,
"আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
এমন আকস্মিক পরিবর্তন কেনো এসেছিলো তার মনে, তা কেবল সে নিজেই জানে।

"জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয়
সবখানি;
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে:"

অবাক লাগে, গত শতাব্দীতে একজন মানুষই ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সে আর কেউ নয়, কবি জীবনানন্দ দাশ।
আজ কবির মৃত্যুদিন।

জীবনানন্দ তার সময়ের প্রথাবিরোধী কবিদের একজন ছিলো।
শনিবারের চিঠি পত্রিকায় সজনীকান্ত দাস অত্যান্ত অশালীন ভাষায় জীবনানন্দের একেকটা কবিতাকে অশ্লীল বলে তীব্র আক্রমণ করতে থাকেন।
ক্যাম্পে কবিতাটা প্রকাশের পর অশ্লীলতার অপবাদ আরও বেড়ে যায়।
সেজন্য সজনীকান্তের বিরুদ্ধে আমার মনের ভেতর একটা আক্রোশ ছিলো।
জীবনানন্দ দাস যখন মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালে ভর্তি, তখন এই সজনীকান্ত দাসই তার পাশে বন্ধুর মতো দাড়িয়েছিলেন।
এমনকি তখনকার মূখ্যমন্ত্রি বিধানচন্দ্র রায় তার অনুরোধেই জীবনানন্দকে দেখতে এসেছিলেন।
অথচ জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাস তার পাশে খুব কম সময়ই ছিলেন। লাবণ্য তখন টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যাস্ত।
জীবনানন্দকে শেষপর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
তবু সজনীকান্ত শত্রু থেকে বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন দেখে নিশ্চই এক পরম সুখের হাসি জীবনানন্দের মুখে ফুটে উঠেছিলো।
:)
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×