বিয়েতে মেয়েরা সাধারণত লাল শাড়ি পরে। কিন্তু আমার বৌয়ের ভাগ্যে সেটা নেই। তবুও গাঢ় নীল শাড়িতে মিষ্টিকে খারাপ লাগছে না। ভাল বললে মনে হয় ঠিক হবে না, এই মুহূর্তে ওকে ডানা কাটা পরী মনে হচ্ছে। গত দু'ঘন্টায় কতকিছু যে হয়ে গেল, বড়ই অবাক লাগছে।
প্রথমে মিষ্টিকে আমার রুমে আসতে দেখে একটা ফোর ফোরটি ইলেকট্রিক শক্ খেলাম। কোটিপতি বাপের একমাত্র মেয়ে, আমার ছাত্রী। দরজা থেকেই বললো, স্যার আসবো?
"এসো এসো, হঠাৎ কি ব্যাপার?"
আজ মেয়েটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু গম্ভীর। অনেকগুলো খামের মধ্যে থেকে একটা এগিয়ে দিয়ে বললো, স্যার আমার বিয়ে।
"ভাল কথা, গুড নিউজ।"
"না স্যার, ভাল কথা না। এ বিয়ে আমি করবো না।"
"কেন? পাত্র ভাল না? কি করে? পছন্দ হয়নি?"
"না স্যার, সে কথা নয়।"
"তাহলে?"
"আমি আপনাকে ভালবাসি।" অন্যদিকে তাকালো মিষ্টি।
আমার মাথাটা অদ্ভুত রকমের দুলে উঠলো। স্বপ্ন না সত্যি বুঝতে পারছি না। রাজকন্যা আর রাজত্ব- কি একসঙ্গে ছেড়ে দেয়া যায়? তাছাড়া মিষ্টির প্রতি আমার যে দূর্বলতা নেই তা নয়। বললাম, তোমার বাবা-মা মেনে নেবে না। আমার বিরুদ্ধে কেস করবে।
"আমার বাবা সেরকম নন। তাছাড়া আমি যথেষ্ট অ্যাডাল্ট। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করার অধিকার আমার আছে। আপনি রাজি কি না বলুন।"
বুঝতে পারছি মেয়েটা খাপ ছাড়া কথা বলছে। ওর বাবা সেরকম না হলে তো বাবাকে রাজি করিয়ে আমাকেই বিয়ে করতে পারতো। ওর সার্টিফিকেট বয়স এখনো আঠারো হয়নি, যদিও ওর আসল বয়স উনিশ ছুঁই ছুঁই। বললাম, তা হয় না মিষ্টি।
"আমি জানতাম, আমি জানতাম আপনি 'না' বলবেন। ঠিক আছে, এবার আমাকে শেষ বারের মতো দেখে নিন। আমিও দেখে নিই, তাহলে মরতে কষ্ট হবে না। শুধু চাওয়া একটাই, আপনি সুখী হবেন।" বলেই সে একটা কিসের যেন শিশি বের করলো ব্যাগ থেকে।
আমি ঠিক বাংলা সিনেমার নায়কের মতো দৌড়ে গিয়ে শিশিটা কেড়ে নিলাম। কিন্তু সিনেমার শেষ দৃশ্য এটা না। মিষ্টি আত্মহত্যা করলে নিশ্চিত ফাঁসি। আবার কিছুণ ভাবলাম। তারপর বললাম, তোমার মোবাইলটা দাও তো।
"কাকে ফোন করবেন, বাবাকে?"
"না, কাজী অফিসে।"
মিষ্টির মুখ থেকে কথা সরলো না। বললাম, আহা, দাও না।
ওর ফোনটা নিয়ে তিন-চারটা বন্ধুকে ডাকলাম। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দিল। কাজী অফিসে গিয়ে রেজিষ্ট্রি করলাম। তারপর ধরে বেঁধে আমাদের একটা হোটেলে তুলে দিল সবাই। মিষ্টির বাবাকে নিয়ে একটু একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। যদি হোটেলের ঠিকানা বের করে ফেলে! তবুও বন্ধুদের দেয়া সাহসে বাসর ঘরে ঢুকেই পড়লাম।
আমি নীল পরীর দিকে তাকালাম। মনে হলো, সারাজীবন মেয়েটাকে খুব ভালবাসবো। প্রাণ দিয়ে ভালবাসবো। বললাম, তোমাকে ভালবাসি মিষ্টি।
ঘোমটা আড়াল থেকে মিষ্টি বললো, আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি।
"আপনি বললে কেন? বিয়ের পরে কেউ আপনি বলে নাকি! তুমি বলবে। বলো।"
মিষ্টি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো, শুনতে পাচ্ছিসনা শালা, উঠতে বলছি।
ভীত কিন্তু গম্ভীর ভাবে গলায় একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ নিয়ে আসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কে? কে ওখানে? এত রাতে কি চান?
"উঠ শালা, তোর যম।" আগের কন্ঠটা বললো। এবার আরো স্পষ্টভাবে।
হঠাৎ মনে হলো চারপাশের পরিবেশটা কেমন জানি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। সেই কন্ঠটা আবারো বললো, শালা গরুর মতো ঘুমাচ্ছিস। উঠবি না, সাড়ে দশটা বাজে।
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
শুভ সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বাস্তবে ফিরে আসতে একটু বেশি সময় নিলাম। তবুও বুঝলাম না কিংবা বুঝতে চাইলাম না, কোনটা স্বপ্ন? আগেরটা না এখনকারটা? এটা স্বপ্ন হলে বেশি ভাল হয়। শিওর হওয়ার জন্য বললাম, শুভ, একটা চিমটি দিবি।
সুযোগ কাজে লাগিয়ে শুভ এমন একটা রাম চিমটি দিল যে আমি লাফিয়ে না উঠে পারলাম না। কিন্তু সেখানেও সমস্যা, কাঁথা গায়ে ছিল। সেটা পরে গেল খসে। ফলে গিঁট খুলে যাওয়া লুঙ্গিটা চেপে ধরতে হলো বড় কষ্টে, তবে ততণে ইজ্জত অনেকটা চলে গেছে। ভাগ্যিস দিগম্বর হতে হয়নি। মেজাজটা সপ্তমে উটে গেল, আর একটু হলেই অষ্টমে উঠবে। খুব ইচ্ছে হলো, শুভর পশ্চাৎদেশে কষে দু’টা লাথি মারি। কিন্তু ওর চাঁদবদনে বত্রিশটা দাঁত কেলানো হাসি দেখে শেষবারের মতো মাফ করে দিলাম।
আমার একমাত্র রুমমেট আমার দিয়ে চেয়ে হাসছেই। বললো, দোস্ত একটা বিড়ি দেনা।
সিগারেটের প্যাকেটটা বালিশের পাশেই রেখেছিলাম। সেখানে নেই। প্যাকেটে একটাই মাত্র সিগারেট ছিল। চাঁদমুখোটা এবার জোড়ে জোড়ে হেসে বুজিয়ে দিল যে প্যাকেটটা ওর কাছে। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, শুভ তুই খুব ভাল করেই জানিস, ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন আমার একটা বেড-বিড়ি লাগে।
"তুই কি আমাকে সন্দেহ করতেছিস?"
"সন্দেহ না আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দেখ, আমার মনটা খুব খারাপ। বিড়িটা দিয়ে দে।"
"তোর শালা সমস্যাটা কোথায়? কতগুলো প্রেমিকা সে হিসেবটা নিশ্চয়ই তোর মনে নেই। দু’একটা ছ্যাঁকা দিলেই কি কেঁদে ভাসাতে হবে!"
"দেখ এটা একটা সিরিয়াস সমস্যা। প্রেমিকা সংক্রান্ত না।"
"বলে ফেল তাহলে।"
"বলবো তো বটেই, আগে বিড়িটা দে।"
শুভ শার্টের পকেট থেকে বিড়িটা বের করলো। তারপর একটু ইতঃস্তত করে এগিয়ে দিল। বালিশের পাশ থেকে লাইটারটা নিয়ে জ্বাললাম দিনের প্রথম সিগারেটটা। তারপর টেবিলের দিকে ইশারা করে বললাম, ওখানেই পাবি খামটা!
খামটা খুঁজে পেতে শুভর খুব একটা সময় লাগলো না। মিষ্টির বিয়ের কার্ড। কাল বিকেলে নিজে এসে দিয়ে গেছে। আবার বলে গেছে, ও যে এসেছিল এটা যেন কাউকে না বলি। এরপরের অংশটা অবধারিতভাবেই স্বপ্ন। মনে মনে হাসলাম একবার। সুন্দরী ছাত্রীর বিয়ে, টিউশনীটা হাত ছাড়া হয়ে গেল আর আমি তখন কল্পনায় ব্যাকুল!
কার্ডটা খুলতেই চারপাশে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে শুভ বললো, ও এই তাহলে কাহিনী। প্রেমিকা হাত ছাড়া হয়ে গেল তাহলে!
"আরে গাধা প্রেমিকা না, টিউশনী! সপ্তাহে ৩ দিন, মাসে দিত সাত হাজার। এই বাজারে সাতহাজার টাকার টিউশনী হাতছাড়া হওয়া মানে বুঝিস?"
"কেন বিয়ের পরে আর পড়বে না নাকি? বলছে কিছু?"
"ধুস... মনে হয় না আমারে আর রাখবে। বাদ দে। কাশ আছে নাকি আজকে?"
"থাকবে না কেন? যাবি? ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি আশংকাজনক!"
"পত্রিকার ভাষা বলতেছিস কেন! মারামারি হইছে নাকি?"
"জানি না। যেতে চাইলে চল যাই।"
"হুম, জুয়েলের সাথে দেখা হওয়া দরকার। টাকা পয়সা নাই হাতে।"
"জুয়েল তো নেতা মানুষ, ওকে কি আর খুঁজে পাবি এখন!"
উত্তর দিলাম না। কথা সত্য। জুয়েল নেতা মানুষ। ক্যাম্পাস গরম থাকলে জুয়েলকে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু জুয়েলকে পাওয়া জরুরী। জুয়েল হলো আমার মামাতো ভাই। একই ভার্সিটিতে পড়ি। মাসের ২৩ তারিখ, হাতে টাকা নেই। এখন জুয়েলই একমাত্র ভরসা।
ঘন্টা খানেক পরে আজিজ সুপার মার্কেটে শাহীন ভাইর দোকানে এসে জুয়েলের খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম, অবস্থা ভয়াবহ। দুই গ্রুপের মারামারি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কয়েক রাউন্ড গুলিও ফুটেছে। আমাদের ছাত্র ভাইরা নিজেদের মধ্যে আক্রমণে গেছে। ফলাফল হতাহত কয়েকজন। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ খবর যেটা সেটা হলো যে, নেপালী মেয়ে দিপীকা ফিজিক্সে পড়তো। ক্রস ফায়ারের সময় ওর কাঁধে একটা গুলি লেগেছে। ঢাকা মেডিক্যালে আছে। এই ঘটনার পরে পুলিশের টনক নড়েছে। জুয়েল সহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। শাহীন ভাই বললো, তুমি যে জুয়েলের ভাই এই পরিচয়টা এখন কাউকে দেবার দরকার নাই। টাকা পয়সা লাগলে নিয়ে যাও। দু’চার দিন বাড়ি থেকে বের হইয়ো না।
কুফা একটা দিন শুরু হয়েছে। শুভর মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছি। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই সমস্যা। সুন্দর একটা স্বপ্নের মাঝে ডাকাডাকি করে দিল স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে, টিউশনী হারানো যন্ত্রণা বার বার ফিরে আসছে, বেড-বিড়ি চুরি হয়ে গেল, ক্যাম্পাসে মারামারি, জুয়েলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। শাহীন ভাইর কাছে শ'পাঁচেক টাকা পাওয়া গেল বটে কিন্তু এখন যাবটা কোথায়? ক্যাম্পাস বন্ধ। মিনা নামের এক স্বল্প পরিচিতা বান্ধবীর সাথে আজ কিছু নোট দেয়া নেয়ার কথা ছিল। এখন তো সে আগামী পনের দিন ক্যাম্পাসে আসবে না। মেসে গিয়ে কোনো কাজ নাই। আর মেসে গিয়েই বা কি হবে? দেখা যাবে সারাদিন কারেন্টই থাকবেনা। ফ্যানটাও ঘুরবে না, একটু গান-টানও শোনা যাবে না। শালা শুভটা যদি সাথে আসতো, এখন তার পশ্চাতদেশে কষে একটা লাথি মেরে বলতাম, "জীবনে আর আমার ঘুম ভাঙ্গাবি? বল, ভাঙ্গাবো না!"
অনেক ভাবাভাবির পর যখন বুঝলাম, এখন করার মতো কোনো কাজ নাই, তখন কড়া রোদে খালি পায়ে হিমুর মতো হাঁটা দেবার একটা দুর্বার ইচ্ছা জেগে উঠলো। কিন্তু খালি পায়ে হাঁটতে হলে তো স্যান্ডেল খুলতে হবে! আজিজ থেকে বের হয়ে একটা বিড়ি জ্বাললাম। মনে হলো, পুরাপুরি হিমু না হোক আংশিক হিমু তো হতে পারি। স্যান্ডেল খোলার দরকার নাই, কারণ পড়নে তো হলুদ পাঞ্জাবী নাই! কাজেই এলিফ্যান্ট রোড ধরে হাঁটা শুরু করলাম।
বাটা সিগনাল আসতেই মনে হলো ট্রাফিক সিগনাল কন্ট্রোল করা শুরু করবো নাকি? তারপর একটা ধবধবে সাদা পাজেরো এসে পাশে দাঁড়াবে কিংবা একটা রেসিং কার; সেখান থেকে নেমে আসবে একটি টুকটুকে সুন্দরী মেয়ে। ঠিক মিষ্টির মতো। না, চিন্তা উলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। কড়া রোদে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই পাশে একটা গাড়ি এসে থামলো। না, পাজেরো বা রেসিং কার কোনটাই না। র্যাবের গাড়ি। কালো সানগ্লাস পড়া ৪/৫ জন শক্তিশালী যুবক এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। সাথে সাথে আমার গা ঘেঁষে আরেকটা গাড়ি থামলো। কোর্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক দ্রুত বের হতে হতে বললেন, এই সেই কালপ্রিট। এ সব জানে। একে ধরুন।
আবার যে কিসের ঝামেলায় পড়লাম বুঝতে পারছি না। আমার কাছে কি চায় তারা? জুয়েলের ভাই পরিচয় দেয়া চলবে না। বললাম, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি তো কিছু করিনি।
এবার ভদ্রলোক নয়, বরং সাদা পোশাক র্যাব কর্মকর্তা বললো, মাইর খাইলে সব বুঝতে পারবা চান্দু। আমাদের কোনো ভুল হইতেছে না। পোলাটা আর মাইয়াডারে কোথায় লুকায়া রাখছো তাড়াতাড়ি কও, তাইলে মাইর কম খাইবা।
কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ আবিস্কার করলাম, বিড়িটা এখনো ফেলিনি। হাতেই শেষ হতে গিয়ে আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লেগেছে। আঙ্গুলের চামড়ার খানিকটা পুড়ে গেল বোধহয়।
"এই ছেলে কথা বলছো না কেন? আমার মেয়েকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো?"
"কে আপনি?"
"কাল সন্ধ্যায় রুবাইয়াতের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের সাক্ষী ছিলে, তাদের ভাগিয়ে দিলে, আর এখনো বুঝতে পারছো না আমি কে? আমি মিষ্টির বাবা!"
বাহ্ কি আনন্দ, চুরি না করেই চোরের দায় এখন মাথায়। হঠাৎ মনে হলো, শুভ ঘুম না ভাঙ্গালে যদি সারাদিন স্বপ্ন দেখতে পারতাম!
অন্যগল্পগুলো:
- বৃষ্টিস্নান
- ছোট গল্প: কথপোকথন
- ছোট গল্প: ভয়

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



