গতকাল কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়েছি। সপ্তাহ খানেক আগে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করার পর থেকে মেসেজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় আটদিন পর পরশু সন্ধ্যায় মেসেজ পাই। ২৩ তারিখে নির্ধারিত স্থানে যেতে বলা হয়েছে।
২৩ তারিখ অর্থাৎ গতকাল সকাল দশটার দিকে চলে গেলাম জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। হাসপাতালে ঢুকতেই ব্যানার চোখে পরলো। নতুন বিল্ডিং এর দক্ষিণে পার্শ্বে, ৫ম তলায় কোভিড-১৯ টিকা দেয়া হচ্ছে! নতুন বিল্ডিং তাই এখনো লিফট লাগেনি। কিন্তু ৫ম তলায় ব্যবস্থা করাটা কি ঠিক হলো? বয়স্ক মানুষদের জন্য একটু হয়তো অসুবিধাই হবে। ভেতরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়িতে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোন দিকে যেতে হবে।
পঞ্চম তলায় উঠতেই মানুষের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়লো! ভয়ও পেলাম। ঘন্টা খানেকের আগে নিশ্চয় সিরিয়াল পাবো না। আশেপাশে ভালোভাবে তাকাতেই রিসিপশনের মতো একটা টেবিল চোখে পড়লো যেখানে কয়েকজন আপা কাঁচা রেজিস্টারে কিছু একটা এন্টি করছেন। সুযোগ বুঝে সেখানে টিকার কার্ডটা দিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, মেসেজ পেয়েছেন?
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, আজকের ডেটে?
বললাম, জ্বী।
টিকা কার্ডটা দেখিয়ে বললেন, এখানে সিগনেচার, মোবাইল নাম্বার আর ডেট দেন।
লিখে দিলাম। উনি কার্ডটা দেখে খাতায় কিছু তথ্য লিখলেন। টিকা কার্ডে লিখলেন, বুথ-২। তারপর নীচের অংশটা ছিঁড়ে নিয়ে ২ নং বুথটা দেখিয়ে দিলেন।
২ নং বুথের সামনে কোনো লাইন নেই। খুশি হয়ে গেলাম। বড়ো একটা লাইন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঐটা কত নম্বর বুথ?
উনি হেসে বললেন, যারা মেসেজ পায়নি ঐটা তাদের লাইন।
দ্রুত কেটে পড়লাম। ২ নং বুথের সামনে দাঁড়ালাম। দুইটা টেবিল। একটায় দুইজন নার্স রেজিস্টার খাতা নিয়ে বসে আছেন, আরেকটা টেবিলে টিকা সংরক্ষণের ডিব্বা রাখা। সেখানে একজনকে টিকা দেয়া হচ্ছে। আপাদ্বয় আমার কার্ডটি নিলেন। আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না। বউ বলে দিয়েছে, টিকা নেবার ছবি তুলতে! ভেবেছিলাম সিরিয়ালে আমার পরে যারা থাকবে তাদের রিকুয়েস্ট করবো। কিন্তু এখন কাকে যে রিকুয়েস্ট করি! এর মধ্যে একজন আপা বললেন, যান আগে টিকা নেন, কার্ড পরে নিয়েন।
ইতস্ততবোধ করছি। লজ্জার মাথা খেয়ে উনার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, একটা ছবি তুলে দিবেন প্লিজ!
উনি খুবই বিরক্তচোখে তাকালেন। বললাম, আমি সুঁই খুব ভয় পাই তো, তাই কনফার্ম হবার জন্য বউ বলে দিয়েছে যাতে ছবি তুলি। ওর দৃঢ় বিশ্বাস আমি টিকা নিব না।
আপাটি একটু সহজ হলেন। হেসে মোবাইল ফোনটা নিলেন। টিকা নিলাম, ভেবেছিলাম ব্যথা পাবো। কিন্তু তেমন একটা ব্যথা পেলাম না।
আপাটি ফোন ও টিকা কার্ড ফেরত দিয়ে বললেন, ঐপাশে রেস্টরুম আছে। আধাঘণ্টা রেস্ট নিয়ে তারপর যাবেন। আর ভাবীকে ছবিটা পাঠায় দেন।
রেস্টরুম বলতে বিশাল একটা জায়গা পেলাম যেখানে সাড়ি সাড়ি অনেক বিছানা পাতা। অনেকেই রেস্ট নিচ্ছেন। খুবই সুন্দর ব্যবস্থা। আমিও ফাঁকা একটা বেডে আধশোয়া হয়ে বসলাম! বউকে মেসেঞ্জারে ছবি পাঠালাম। সে সাথে সাথেই কলব্যাক করলো! টিকা নিয়েছি জেনে খুশি হলো। ঠিক মতো রেস্ট নেবার জন্য বললো।
ক্যান্ডিক্রাশ গেম খেললাম কিছুক্ষণ। তারপর মনে হলো রেস্ট নেয়া দরকার। গেম খেললে তো রেস্ট হবে না। প্রথমবার রক্ত দেবার কথা মনে পড়লো! সেবার রক্ত দেবার পর সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সবাই বলেছিল, দশ-পনের মিনিট শুয়ে থাকো। কিন্তু কারো কথা শুনিনি। ফলাফল হলো খুবই খারাপ। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই এবার রিস্ক না নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফোনটা পকেটে রেখে পা তুলে শুলাম। পাশের ফাঁকা বেডে আরেক ভদ্রলোক এলেন। এসেই বালিশ উল্টালেন। ঝারলেন, তারপর শুয়ে পড়লেন। মনে হলো, আমি তো বালিশ উল্টাইনি। তারমানে আমার আগে যিনি শুয়েছিলেন তার শরীরের জার্ম (যদি থেকে থাকে) অলরেডি আমার মাথায়-ঘাড়ে লেগে গেছে। পরেরবার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে বালিশ উল্টে নিতে হবে। আহ্, জীবনে কত শিক্ষা যে এখনো বাকী!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঝিমুনি চলে এলো। আমি যেকোনো সময় যে কোনো অবস্থায় ঘুমাতে পারি। বাস, ট্রেন, সিএনজি, খটখটে হাতল বিহীন কাঠের চেয়ার কোনো কিছুই বাদ যায়নি, এতো রীতিমতো বিছানা।
বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। পাশের বেডে বালিশ পাল্টানো ভদ্রলোক চলে গেছেন। সেখানে মাঝবয়েসী আরেকজন বসে আছেন, যার শার্টের বোতাম খোলা, অর্ধেক নামানো, ভেতরের ধবধবে সাদা সেন্ডো গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে! সম্ভবত টিকা দেবার সময় শার্ট নামানো হয়েছিল তা আর ঠিক করা হয়নি। শার্ট খোলার ভয়ে গেঞ্জি পড়ে এসেছি। ইজ্জত রক্ষা বড়ো কথা! উনি কেমন যেন শক্ত হয়ে বসে আছেন, কেউ কি জোড় করে টিকা দিয়ে দিল নাকি?
বিপরীত দিকের পাশাপাশি দুই বেডে ষাটোর্ধ কপোত কপোতী শুয়ে শুয়ে গল্প করছেন। উনারা টিকা নিতে পেরে খুবই আনন্দিত। দ্বিতীয় ডোজ পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকেন সেই বিষয়ে আলাপ করলেন। কার যেন বিয়ের পাত্রী নিয়ে কথা বললেন। অন্য বেডগুলোতে প্রায় সবাই স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত। কেবল বয়স্ক মানুষ দুজন নিজেদের মধ্যে গল্প করে যাচ্ছেন, বিভিন্ন বিষয়ক, জীবন বিষয়ক! উনারা সম্ভবত স্মার্টফোনে খুব একটা অভ্যস্থ নন!
আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে পড়া উচিত। অফিস যেতে হবে।
বের হবার সময় খেয়াল করলাম, পাশের বেডের মাঝবয়েসী মানুষটি এখনো আগের মতোই বুক ছাতি বের করে শক্ত হয়ে বসে রয়েছেন।
রাতে সামান্য জ্বর এসেছিল, এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা মনে হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:০৪