আর দশটা বিরক্তিকর ও একঘেয়েমিপূর্ণ দিনের মতো আজও একটা বৃহস্পতিবার। ক্লান্তিকর দিনটা কোনোরকম পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, এমন একটা সময় ফার্মগেট থেকে বাসে উঠলাম। উঠলাম বলাটা ঠিক হচ্ছে না, বলা উচিত- হাতল ধরে ঝুললাম। বাসটা লাল রঙের আর দোতলা। পেছনের পা-দানিটা বেশ বড়ো হওয়ায় একসাথে অনেক মানুষ ঝুলতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ হাতল ধরার সুযোগ পায়, যেমন আমি ধরেছি, আর কেউ কেউ আবার হাতল ধরে ঝুলে থাকা মানুষগুলোর শরীর ধরে ঝুলে থাকে। বিষয়টা মাঝে মধ্যে বিরক্তির পর্যায়ে পড়ে যখন পেছনের সারির মানুষগুলো স্পর্শের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় কিংবা সুযোগ সন্ধানী কোনো পকেটমার সেখানে স্থান করে নেয়। তবে সুযোগ বুঝে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতে পারলেই চাপাচাপি ঠেলাঠেলি সহনীয় মাত্রায় চলে আসে। বেশিরভাগ সময়ই দোতলাটা তুলনামূলক ফাঁকা থাকে। মানুষজন গাদাগাদি করে দাঁড়ায় অথচ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে চায় না কিন্তু আমি চাই। দোতলাটা তুলনামূলক নিরাপদ। ইদানীং সন্ধ্যার পর শহরে টানা পার্টির দৌরাত্ম্য যথেষ্ট বেড়েছে।
বাসটার গন্তব্য জানি না। সম্ভবত আব্দুল্লাহপুর, তবে মিরপুরেও হতে পারে। গন্তব্যহীন চলার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। এই আনন্দটা নেবার জন্য আমি প্রায়ই হুটহাট কোনো একটা বাসে উঠে পড়ি। তারপর সিট ফাঁকা পেলে বসে ঝিমাতে থাকি। হঠাৎ হঠাৎ কখনো ঘুমিয়েও পড়ি। ঘুম বা ঝিমুনি ভেঙে গেলে পরের স্টপেজে নেমে অন্য আরেকটা বাস ধরি। এভাবে চলতেই থাকে যতক্ষণ না বিরক্তি আসে।
পরের স্টটেজ বাস থামতেই আমি দোতলায় উঠে গেলাম। সিঁড়ির মাথায় খানিকটা জটলা থাকলেও ভেতরটা তুলনামূলক ফাঁকা। এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। একেবারে সামনের সারির বাম দিকের দুইটা সিটই খালি। নিজ দায়িত্বে জানালার পাশের আসনটা গ্রহণ করলাম। কচ্ছপ গতিতে বাস চলতে শুরু করলে সামনের অর্ধখোলা জানালা দিয়ে হু হু করে একরাশ হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিলে চললো আমাকে। দোতলায় বোধহয় বাতাস একটু জোর দেখিয়ে চলে। হাওয়া উপেক্ষা করে বাইরে তাকালাম। সারি সারি ডিজিটাল বিলবোর্ড। আলো জ্বলছে, নিভছে। তারকা মডেলগুলোর স্থির কিংবা চলমান ছবি ভেসে উঠছে পর্দায়। নানান রকম পণ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। হাই হিল, চোখে কালো চশমা পড়ে এক সুন্দরী তরুণী কাঁধে দামি লেদারের ব্যাগ ঝুলিয়ে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন ফিরে তাকালো একবার কি দুইবার। না, পেছনে কাউকে আসতে দেখা গেল না। হঠাৎ করে একটা নাম পণ্যের নাম ভেসে উঠলো পর্দায়। লাস্যময়ী তরুণীকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে কি হেঁটে পর্দা থেকে বেরিয়ে গেল? হতে পারে। নতুন আরেকটা বিজ্ঞাপন শুরু হলো, ততক্ষণে অবশ্য বিলবোর্ডটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছি। আমারও মনোযোগে ঘাটতি দেখা দিলো। পাশের সিটে অপরিচিত সহযাত্রীর উপস্থিতি অনুভূত হলো। খুব মিষ্টি একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে। রিনরিন চুড়ির শব্দও পেলাম বোধহয়। তবে কি সহযাত্রী কোনো লাস্যময়ী নারী! আমার কি তার দিকে একবার তাকানো উচিত? নাকি ব্যাপারটা ছ্যাবলামো হয়ে যাবে? কিংবা না-তাকানোটা কি তাকে কোনোভাবে আঘাত করবে?
একবার এক লাস্যময়ী নারী আমাকে বলেছিল, ‘তুমি একটা গাধা। আস্ত গাধা।’
আমি মেনে নিয়েছিলাম। না মেনে উপায়ও ছিল না। কারণ আমি কখনোই নিজেকে মানুষের পর্যায়ে বিবেচনা করি না। ছোটবেলায় পরিবার ছাড়া ভিন্ন প্রতিকূল এক পরিবেশে আবিষ্কার করেছি যেখানে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত! সেখানে শুধুই বেড়ে ওঠা, মানিয়ে নেওয়া কিংবা ছিল প্রতিযোগিতা! অথচ প্রতিযোগিতা আমার ভালো লাগে না, খেলাধুলা কিংবা আড্ডাবাজীও না। ধীরে ধীরে বন্ধুরাও দূরে সরে যেতে থাকে, রসকষহীন বন্ধু কারই বা ভালো লাগে। সময় বয়ে চলে আর আমি পরিচিত হতে থাকি একজন অসামাজিক মানুষ হিসেবে। নিজেকে একা ভাবতে থাকি। কিংবা ভাবতে ভালোবাসি। অথচ একাকিত্ব শব্দটা ভাবলেই খুব অদ্ভুতভাবে নির্দিষ্ট একটা মানুষের কথা মাথায় ঘুরতো। তিনি ছিলেন আমাদের বোর্ডিং স্কুলের হেডমাস্টার জয়নুল স্যার। খুবই জাঁদরেল মানুষ। তাঁর কথায় পুরো স্কুল ওঠাবসা করত। কথিত ছিল, স্কুল চত্বরের কোনো গাছের পাতারও সাহস ছিল না তাঁর অনুমতি ছাড়া নড়ে! শিক্ষক-ছাত্ররা সবাই তাঁর সামনে দুরুদুরু বুকে চলাফেরা করত। পান থেকে চুন খসলেই তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করতেন। ক্লাশ নেওয়া ছাড়া বাকিটা সময় তিনি নিজের রুমে একা থাকতেন। কাজে ডুবে থাকতেন। শৃঙ্খলা, অনুশাসন, আদর্শ, নৈতিকতার তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত, অথচ আমার মনে হতো- তিনি খুব একা। একটা মানুষ কীভাবে সারাদিন কারো সাথে কথা না বলে কাটিয়ে দিতে পারে তা আমার বোধগম্য হয় না, যদিও তখনো জানতাম না যে ভবিষ্যতের জন্য এমনি একটা জীবনধারা আমিও বেছে নিতে চলেছি। একদিন সাহস করে স্যারের রুমে ঢুকে পড়লাম। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ভেদ করে কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ততক্ষণে ভয়কে জয় করে ফেলেছি। বললাম, ‘স্লামালেকুম স্যার, কেমন আছেন?’
তিনি খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন যেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন জীবনে কখনো শোনেননি।
বললাম, ‘স্যার কি ব্যস্ত অনেক?’
স্যার খানিকটা সামনে ঝুঁকে এলেন। ভারী গলায় বললেন, ‘কিছু বলবে?’
বললাম, ‘না স্যার তেমন কিছু না। আপনার সাথে তো তেমন একটা কথা বলার সুযোগ হয় না, তাই দেখা করতে এলাম। ব্যস্ততা থাকলে পরে আসি।’
তিনি কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন। কাঠের চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকলেন আরও কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর বললেন, ‘না, তেমন ব্যস্ততা নেই। ভেতরে এসো। বসো।’
টেবিলের সামনে দুইটা হাতলবিহীন কাঠের চেয়ার। স্যারের সামনে বসার মতো সাহস পাচ্ছিলাম না। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। ডান হাত দিয়ে বসার জন্য ইশারা করলেন। আমি টুপ করে বসে পড়লাম। উনি বোধহয় একটু সহজ হবার চেষ্টা করলেন। আমার নাম-ধাম, পরিচয়, বাড়ির সদস্য সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। পড়াশোনার খোঁজ নিলেন। আমি ফিরে গেলাম ক্লাশে। ইচ্ছে থাকলেও সেদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি, ‘স্যার, আপনি কি একা? আপনার কি কখনো একাকিত্ব বোধ হয়?’
হেড স্যার সম্ভবত একাকিত্ব উপভোগ করতেন, যেমনটা আমি করি। আর উপভোগ করি বলেই হয়তো লাস্যময়ী নারীটির খুব কাছাকাছি গিয়েই নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। অথচ মোহিনীর চোখের মায়ায় আমি ডুবে যেতে থাকি অতল গহীনে; তার রূপের কাছে নিজেকে তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ মনে হয়। প্রাত্যহিক কাজকর্মেরও নতুন বিন্যাস হয়। জীবনের মানে অন্যভাবে খুঁজতে শুরু করি। অপ্রয়োজনে কথা বলি, চোখে চোখ রাখি। আঙ্গুলে আঙ্গুলে ছোঁয়াছুঁয়ি বাড়ে। তারপর একদিন মোহমুক্তি ঘটে। অসামাজিক মন সামাজিক হতে চায় না। লাস্যময়ী নারীকে উপেক্ষা করার মতো সাহস সঞ্চয় করি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আসি। ব্যাপারটার সাথে লজ্জা, সততা, সাহস এসকল বিশেষণ জড়িত কি-না জানি না, তবে সহজাতও হতে পারে। কিংবা মানুষের জীবনের চেয়ে গাধার জীবনটাই হয়তো বেশি উপভোগ্য মনে করি।
হঠাৎ করেই ডান কানটা চুলকাতে ইচ্ছা হলো। কোনো রমণীর পাশে বসে কান চুলকানোটা অভদ্রতা হবে কি-না বুঝতে পারছি না। কান চুলকানোর ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখার মতো তেমন কিছু চোখে পড়লো না। বনানী বাসস্টপ পেরিয়ে গেছি বোধহয়। রাস্তার পাশে সারি সারি উঁচু উঁচু খাম্বা তৈরি হয়েছে, যার ওপর দিয়ে একটা উড়াল সড়ক হাজার হাজার বাহন বহন করবে। পাশেই রেললাইন। মাঝে মধ্যে দু-একটা বাতি জ্বললেও নির্জন একটা পরিবেশ। সারি সারি কিছু অস্থায়ী বস্তিঘর। বাতাসে কটু গন্ধ। মনে পড়ল- এমনই এক পরিবেশে ঘটে গিয়েছিল মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। একদিন ভার্সিটি পড়ুয়া এক তরুণী স্টপেজের আগেই বাস থেকে নেমে পড়েছিল। কাছে পিঠেই লুকিয়ে থাকা মানসিক বিকারগ্রস্ত নেশাখোর এক ধর্ষকের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল সে। অথচ মানসিক বিকারগ্রস্ত নেশাখোর ধর্ষকটি ধরা পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ভুক্তভোগী তরুণীটিকেই আমরা দোষ দেবার চেষ্টা করছিলাম। তার চরিত্র, পোশাকের দিকে আঙ্গুল তুলেছিল তথাকথিত ভালো মানুষগুলো। শারীরিক ও মানসিক ট্রমা কাটিয়ে সেই তরুণী কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। সে ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। অথচ মানসিক বিকারগ্রস্ত নেশাখোর ধর্ষকটি কিন্তু নির্ধারিত শাস্তি শেষে আবার ঐরকম এক নির্জন বস্তিঘরের আশপাশে ফাঁদ পেতে শিকারের আশায় বসে থাকবে! এবং তার কোনো চরিত্র কিংবা পোশাক নিয়েও কেউ কোনোদিন প্রশ্ন তুলবে না। নিঃসঙ্গতাও তাকে কখনো ছুঁয়ে যাবে না।
একটা লোকাল ট্রেন রেললাইন ধরে হেলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছে বাসের সমান্তরালে, যদিও সড়কপথ আর রেলপথ পাশাপাশি চলার মতো সুযোগ এ শহরে খুব বেশি একটা নেই। কামরাগুলোতে কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। ঠিকমতো দেখা না গেলেও ভেতরে বসা বা দাঁড়ানো মানুষগুলোর ক্লান্ত দেহভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। একটা হকারকে ডান হাঁটু ভাঁজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কমবয়সি একটা ছেলে। হয়তো ঘরে ছোট ছোট ভাই-বোন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা ওর ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। হুম, অপেক্ষা! যা করার জন্য আমি কাউকে অধিকার দিইনি, অথবা কেউ সে অধিকার নিতেও পারেনি।
ভ্রমণটা খুব নিরানন্দময় হয়ে যাচ্ছে। চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকারে ভরে যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে পড়া উচিত। অথচ অপরিচিত সহযাত্রীর শরীর থেকে ভেসে আসা সুমিষ্ট সৌরভ ভ্রমণটা আনন্দময় হবার উজ্জ্বল একটা সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। রিনরিন চুড়ির শব্দের আশায় কান পাতলাম। এবারও তার দিকে তাকালাম না। চুড়ির শব্দ হলো না। হতে পারে চুড়িগুলো কাচের। চুড়ির নকশা, রঙ অনুমান করার চেষ্টা করলাম। একটা অনুমান নির্ভর খেলায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে শেষ পর্যন্ত এই বাসে আরও কিছুটা সময় কাটানো যেতে পারে, অন্তত পরবর্তী স্টপেজ না আসা পর্যন্ত।
ফটোক্রেডিট: pixoto.com
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২২ সকাল ১১:০৯