এস্কিমো এর পোস্ট Click This Link
১৯৯৭ সালের গ্রীষ্মকাল। স্বাভাবিক গরম পড়েছে। মানুষ হাসফাস করছে - বিদ্যুৎ আর পানির অভাবে ঢাকার অধিবাসীরা অস্থির। তেমনই একটা দিনে ঢাকার পানি সরবরাহ সংস্থার এক কর্তাব্যক্তি কোট টাই পড়ে অফিসে এলেন। গরমের কারন অধিকাংশ মানুষ হালকা পোষাকেই সেইদিন অফিস করছিলেন - অজ্ঞাত কারনে সেই কর্তা অফিসে এলেন কোট টাই পড়ে - এসেই পত্রিকার দিকে নজর দিলেন। পত্রিকাগুলো প্রধান সংবাদের সাথে রংগীন ছবি দেখে মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। কাজ হচ্ছে - উনি ভাবলেন।
সকল পত্রিকা সেইদিন প্রধান খবর করেছিলো - পানির অভাবে ঢাকা শহরে কলসী মিছিল। কিছুক্ষন পরই ফোন বেঁজে উঠলো - কর্তা উঠে দাড়ালেন। প্রধান মন্ত্রীর দফতরে যেতে হবে। গত সাতদিনের কাজের ফলাফলের ফাইলটা ড্রয়ার থেকে বের করে আবার চোখ বুলালেন। বেল বাজিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ী তৈরী করতে বলে - কয়েকটা ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গমনকারী সংগী কর্তাদের উনার গাড়ীতে যেতে অনুরোধ করলেন। কারন সেই সময়ে উনাদের কিছুটা কথা বলে তৈরী করা যাবে।
(২)
প্রধানমন্ত্রীর দফতরে শুরু হলো মিটিং। আমাদের কোট-টাই পড়ার কর্তা কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন যাতে প্রধানমন্ত্রীর উষ্মাটা বের হয়ে যায়। তারপর অন্যদের হতচকিত মূহুর্তে দাড়িয়ে টাকা পনের মিনিট কথ বললেন। যার মধ্যে ঢাকা শহরের আশু পানি সমস্যা সমাধানের একটা কম্প্রিহেনসিভ ক্রাশ প্রোগ্রামের বিবরন দিলেন। তাতে খরচ হবে ১২০ কোটি টাকা আর বসানো হবে ২৫টা গভীর নলকূপ। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে প্রচলিত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান না করে বাজারদরে চলতি ঠিকাদার কে দিয়ে কাজ করানো হবে। উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আর সচিবালয়ের আমলারা অভিভূত। মুহূর্তের মধ্যে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হলো - কিন্তু সমস্যা হলো অর্থের সংস্থান নিয়ে। কোট-টাই পড়া কর্তা কিন্তু কাঁচা ঘাস খায় না - উনি পাঁকা খবর নিয়ে এসেছেন - কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত উন্নয়নের জন্যে বরাদ্ধকৃত ১০৩ কোটি টাকা বিভিন্ন জটিলতার কারনে কয়েক বছর ধরে অব্যবহূত আছে আর সংস্থার তহবিল থেকে অনায়েসে বাকী টাকা সংস্থান হবে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন - প্রধানমন্ত্রী অন দ্যা স্পট অনুমোদন দিলেন - শুরু হলো ঢাকা বুকবিদ্ধ করে আরো টিউবওয়েল বসানোর কাজ আর উক্ত কর্তা হলেন প্রজেক্ট ডাইরেক্টর।
(৩)
সেইদিনের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মিটিং এ বলা হয়নি। তা হলো -
১) ঢাকা শহরের পানি সরবারহ কোনদিনই চাহিদাকে অতিক্রম করতে পারেনি। জন্মলগ্ন থেকেই সরবরাহের দুই তৃতীয়াংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদার হিসাব করার সময় বস্তিবাসীদের কোনদিনই হিসাবে আনা হয়না - কারন বস্তিগুলো অবৈধভাবে পানি ব্যবহার করে। সেই হিসাবে সরবরাহ কোনদিনই চাহিদার অর্ধেকও অতিক্রম করেনি।
২) যে দিনটায় বাংলাদেশের প্রধান দৈনিকগুলোতে বিক্ষোভের খবর হেডলাইন হয় - সেদিন সেই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পানি সরবরাহ করা হয়েছে।
৩) পুরো ঢাকা শহর নয় - খিলগাও, আগারগাও, যাত্রাবাড়ী আর হাজারীবাগের চার যায়গায় কিছু মানুষ পানির দাবীতে খালি কলস নিয়ে মিছিল করেছে - সেখানে পত্রিকার ফটোগ্রাফারগন বিশেষ ব্যবস্থায় আগেই উপস্থিত ছিলেন।
৪) বলা হয়নি - যে চার স্পটে বিক্ষোভ হয়েছে সেখানকার সিটি কমিশনারগন নলকূপ বসানোর ঠিকাদারের সাব কন্ট্রাকট্রার হিসাবে কাজ করে।
৫) আরো বলা হয়নি - ১৯৮০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা সিটি ল্যান্ড সাসিডেন্স নামে একটা স্টাডি হয়েছে - সেখানে ঢাকা শহরের ভূমিধ্বস আর ওয়াটার মাইনিং এড়ানোর জন্যে আর কোন নলকূপ না বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
৬) আরো কয়েকটা ঠিকাদারী প্রতিষ্টান অনেক কমমূল্যে কাজ করতে রাজী হলেও বিশেষ কারনে একটা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে।
৭) মুলত একটা দীর্ঘকাল থেকে লালিত সমস্যাকে সময় সময় কাজে লাগিয়ে কিছু কর্তাব্যক্তি, কয়েকটা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আর স্থানীয় মাস্তানরা সুবিধা নেওয়ার একটা সুপরিকল্পিত কাজে জনগনের নির্বাচিত সরকারকে জনগনের দূর্দশা লাঘবের কথা বলে ব্লাকমেইলিং করা হচ্ছে।
(৪)
মজার বিষয় হলো - সেই ২৫টা টিউব ওয়েল বসানোর পরের বছরই আবারও একই নাটক করে আরো ২৫টা টিউব ওয়েল বসানো হয়েছে। লাভবান হয়েছে কিছু মানুষ - ঢাকা শহরে বাড়ীর দাম বেড়েছে আর কিছু টাকা পাচার হয়েছে দেশের বাইরে। ১৯৮০ সালে যেখানে ১১০টা টিউবওয়েলের উপস্থিতিতে ঢাকা শহরকে একটা বিপজ্জনক শহর হিসাবে চিহ্নিত করেছে বিশেষজ্ঞরা - সেখানে আজ প্রায় ৪০০ টিউবওয়েল ওয়াটার মাইনিং করছে। কিন্তু শহরের পানির সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
(৫)
পানির সমস্যার জন্যে সরকারকে বিদ্যুৎ সমস্যার কথা বলে জেনারেটর কিনে পরিবেশ ধ্বংশ করা আর সাদাহাতি পোষার মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছানোর কাহিনীটাও বেশ মজার। সময় হলে সেই কাহিনীটাও বলা যাবে। তবে এইটুকু বলি - পানি উঠানোর জন্যে যদিও জেনারেটর ব্যবহার করা হয় - কিন্তু তাতে সবাই পানি পাবে সেই নিশ্চয়তা নেই। কারন প্রত্যেকটা বাড়ীর নিজস্ব রিজার্ভার থেকে পানি উঠাতে আবার বিদ্যুতে উপর নির্ভর করতেই হয়। এই একটা চত্রু। এর থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে রেখেছে আমলা আর প্রকৌশলী কর্তারা।
(৬)
দীর্ঘ ১২ বছর পর আবার দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর দফতে জরুরী বৈঠক হয়েছে - পানি সরবরাহের জন্যে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছে। এতো বড় সরকার থাকতে কেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্যে সবাই বসে থাকে - এই বিষয়টা লক্ষ্য করার মতো। সেই নির্দেশের সুবাদে আরো ২০০ জেনারেটর কেনা হবে - হয়তো আরো কয়েকজন ডজন টিউব ওয়েল বসানো হবে। দ্রুত ধনী হয়ে যাবে কিছু মানুষ। কিন্তু পানির সমস্যার উনিশ থেকে হয়তো বিশও হবে না।
একটা দেশের মানুষ যখন সব কিছুই শর্টকাটে শেষ করতে চায়। শর্টকার্টে পানি - বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান - সেখানে টোটকা চিকিৎসার জন্যে বসে আছে একদল চতুর লোক। এরা মানুষের দূর্দশাকে পুঁজি করে - সরকারকে বোকা বানায় আর নিজেরা আখের গুছায় । অন্যধিকে সাধারন মানুষও ভাবে না যে পানি আর বিদ্যুৎ তাদের বাসায় আসছে তার জন্যে কতটা মুল্য পরিশোধ করতে হয়। শহুরে মানুষগুলো সবকিছুর সমাধান চায় যত জোরে চিৎকার করে - বিল প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের ততটা অনীহা দেখা যায়। এদের ভাবার সময় নেই - পঞ্চগড়ের কৃষক থেকে টেকনাফের জেলের চিকিৎসা - শিক্ষা - বাসস্থানের জন্যে বরাদ্ধ কমিয়ে শহরের মানুষ খুশী করার জন্যে জন্যে বছরের পর বছরে সরকাকে স্বল্পমেয়াদী সমাধানের দিকে টেনে নিচ্ছে কিছু জ্ঞানপাপী - এরা সুকৌশলে দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের দিকে যেতে দেয়না - কারন নগদ লাভের লোভ সামলানো কঠিন।
মনে হয় এরা সবাই ডেলকার্নেগীর শিষ্য - এরা সবাই আজকের জন্যেই বাঁচতে চায়।
আর সরকারের দিন বদলের শ্লোগানকে নিজেদের ভাগ্য বদলের সুযোগ বানানোর প্রক্রিয়াটা অবাক হইনি - শুধু ভাবছি - দিন বদল আসলেই একটা কঠিন কাজ।