বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে গেছে শ্যাওলা পড়া পাথর গুলো, শ্মশান ঘাটে নামতে হয় তাই খুব সাবধানে । অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পুরোনো কাঠের বেঞিটার কাছে পৌছে দেখি মোবারক আগেই এসে বসে আছে । আমাকে দেখে একটা বিড়ি বের করলো , কিছুহ্মন টিপে টুপে সেটা ঠোটে নিলো । আমি চুপচাপ ঘাসের ডাটা একটা মুখে নিয়ে চিবুতে লাগলাম । শুন্য শ্মশান ঘাটে শিস দিতে দিতে বাতাস বয়ে যায় ।
- কবে আইছোস? মোবারক নিরবতা ভাঙে ।
- এইতো ,.. ,ঈদের দুইদিন আগে ।
-একা?
- হুম । আরকে আসবে?
-ও ।
নুড়ি পাথড় কয়েকটা নদীর পানিতে ছুড়ে মারে মোবারক ।ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে কয়েকটা নুড়ি ব্যাঙ লাফ দেয় পানির ওপর । তারপর টুপ করে ডুবে যায় । চারদিক নিরব হয়ে যায় আবার । দুরে কোনো এক চাষির বাড়িতে ঘুমন্ত কোনো শিশু কেঁদে ওঠে একবার । বিলাসী ভঙিতে এক পেচা ঝটপট করতে করতে উড়াল দেয় ।
তারপর মোবারক কথা বলে ওঠে আবার ।
- আবিরের খবর জানিস ?
- শাহজালাল ভার্সিটির আবির ?।
- হুম , ব্যাটা ভাড়াটে ক্যাডার হইছে ।
আমি ঘাসের ডাটা কাটি, খারাপ কি?
- পরেশকে মনে আছে, পরেশ? সুইডেন গেলো যে?
- হুম ।
মোবারক পরেশকে নিয়ে নানা কুচ্ছিত কথা বলতে থাকে । তারপর আরেক জন । মোবারকের মুখ আর থামে না। সবার ব্যাপারে নানা খারাপ খবর দিতে থাকে। সবার কুঃসংবাদ গুলো জানে সে । ব্যাটা আমার ব্যাপারে অন্যদের কি বলে জানতে ইচ্ছা করে ।
- মোবারক তোর মাছের ব্যবসার কি খবর?
- ভালোই ।
স্কুলে নাইন আর টেনে সেকেন্ড বয় ছিলো মোবারক । ফার্স্টবয় আর সেকেন্ড বয়ের মধ্যে একটা রেশারেশি থাকে, আমাদের দুজনের মাঝেও তা ছিলো । কিন্তু তারপরও কেমন করে বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা, ওর বাবা মাঝি আর আমার বাবা টিচার হওয়া সত্বেও ।
ক্লাস টেনের টেস্ট পরীহ্মার পরে ওর পড়াশোনা আর হয়নি । মাছের ব্যবসা করে আজ বছর খানেক ।
- আড়ত নিছি আরও দুইটা । আর বিয়া করবো আরেকটা।
আমি থতমত খেয়ে বলি, কি করবি আরেকটা ?
- বিয়া করবো। টাঙ্গাইল জেলায় গিয়ে থাকতে হয় প্রায় প্রায়ই । বিয়া করলে ব্যবসা চালাইতে সুবিধা ।
আমি ঘাস ফেলে দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকি। মোবারক আমার বাল্যবন্ধু । ইতঃমধ্যে দুইটি বিয়ে করে তিন নম্বরটার সে প্ল্যান করছে, আমার পড়াশোনাই শেষ হয় নাই । মাথা নিচু না করে উপায় কি ?
মোবারক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘সুরুজ মোল্লাটা মইরা যাবে সামনের মাসের দশ তারিখে ।‘
আমি চমকে উঠে বলি, ‘কি বলিস , শক্ত সমর্থ জোয়ান লোকটা ! অসুস্থ তো ওর বাপ না ?
মোবারক পিচিক করে থুতু ফেলে, ‘বুড়া বাচঁবো আরো সাত বছর । সুরুজ মোল্লারে সাপে কাটবে দশ তারিখে ।‘
সুরুজ মোল্লারা থাকে পশ্চিম পাড়া। নামে মোল্লা হলে কি হবে, ধর্ম কর্মে ব্যাটাদের মতি নেই । চাষাদের নাকি ধার্মিক হওয়ার কথা, ফসলের বাড়নের জন্য ঈশ্বরের অনুগ্রহ সরাসরিই প্রয়োজন । ছয়ভাই পালা করে জুম্মাবারে মসজিদে আসে, একবার আসলে বাকি পাচ সপ্তাহ তাকে আর নাকি কেবলামুখী হতে দেখা যায় না ।তবে মানুষগুলি ভারি ভালো । সবার ভালো ছাড়া খারাপ কেউ চায় না।
আমি মন খারাপ করে বসে থাকি । একবার ভাবি বলবো, কিছু করা যায় না? জোয়ান হাসি খুশি লোকটা । তারপর মনে পরে অনেক আগে মোবারকেরই বলা কথাটা , কোনো কিছু পরিবর্তন করা যায় না। সেই হ্মমতা শুধু একজনের কাছে ।
আকাশে গুরগুর শব্দ করতে থাকে মেঘ, বৃষ্টি বোধহয় আসবে আরও জোরেশোরে ।ঘাটের উল্টোদিকের ঢিবিতে সরসর করে কি একটা শব্দ শোনা গেলো । কোনো নিশাচর হয়তো রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এলো গর্তে ।
- যাই ।
- যাবি? যা তাইলে । আমারেও মাছের চালান আনতে যাইতে হইবো বামুনজির বিলে ।
মোবারক একটু থামে । তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘বামুনজির বিলের কথা মনে আছে তোর ?
- আছে ।
- এই বিলেই ওরা আমারে খুন করছিলো, মনে আছে?
আমার সব মনে আছে । টেস্ট পরীহ্মার দুই দিন পরেই বাপের বদলে রাতে মাঝিগিরি করছিলো মোবারক । ভোর বেলা ওর লাশ পাওয়া যায় ঘাটের কাছে ।
এইটুকু জমি ছিলো ওদের । ওটা নিয়েই কাজিয়ার জের ধরে ওর চাচাই খুন করেছিলো ওকে । মোবারকই বলেছিলো আমাকে, খুনের তিন দিন পরে ।
শুধু যে আমি মোবারকের ভুতকে দেখি তা না, আরও অনেকেই দেখে।কিন্তু দেখে ভয়ঙ্কর ভয় পায় । তাই মোবারক সবাইকে এড়িয়ে চলে। বেচারা মাছের ব্যবসা করে, ভুতদের মাছ সাপ্লাই দিয়ে বৈধ্য ভাবে আয় করে। আর আমার কাছে মাঝে মাঝে কারও কারও মৃত্যুর ভবিষ্যতবানী করে যায় ।
পিচ্ছিল শ্মশান ঘাট বেয়ে উঠতে উঠতে আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে মোবারককে ঝাপসা হতে দেখি । সুরুজ মোল্লার কথা ভেবে মনটা আবার খারাপ হয় ।