মুভিতে শার্লক হোমসকে যত সহজে করতে দেখা যায় , পাইপে ধুমপান আসলে ততটাই কঠিন । বিশেষ ধরনের তামাক লাগে, হোল্ডারে সেই তামাক ভরার সুহ্ম নিয়ম মানতে হয় , আগুন দিতে হয় দুই ধাপে , তারপর ম্যাগগাইভারের ছুরির মতো একটা বস্তু দিয়ে সেই আগুন উস্কে দিতে হয় । ধোয়া টানতে হয় সাবধানে, ইনহেল না করতে বলা হয়ে থাকে । সর্বপরি আনাড়ির কাজ নয় ।
পাইপ স্মোকিংয়ে আমাকে আনাড়ির বললেও সম্মান দেখানো হয় । জীবনেও সিগারেট ফোকা হয়নি। তারপরও মাঝরাতে ছাদে উঠে গিফট পাওয়া পাইপটায় ধোয়া তোলার চেষ্টা করছি ম্যানুয়াল দেখে দেখে । কোথথেকে গিফট পেলাম সেটা আরেক ইতিহাস , যে ইতিহাস এখন আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না ।
ফুপির বাসার ছাদটাকে টব দিয়ে ছেয়ে বাগান বানানোর একটা কিম্ভুত চেষ্টা করা হয়েছে, লাভের মধ্যে লাভ হলো আরাম করে দাড়ানোর তিল ঠাই আর নাহি রে । রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পাইপে আগুন দিতে যাবো, হাটুর কাছ থেকে কেউ বলে উঠলো,
- বাই , কি কাইতাছুইন ?
টবে পানি দেয়ার জন্য কলতলা তৈরী করা হয়েছে, সেখানে বসে আছে ছেলেটা । মনে পড়লো গেটে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি সম্প্রতি ।
- তুমি নতুন দারোয়ান ?
- হ বাইজান , আমার নাম পরান ।
আহা, রাবীন্দ্রিক নাম বটে । বললাম , কলতলায় এতো রাতে বসে গোছল করো? গরম বেশী লাগতেছে?
- এতোহন লাগতেছিলো, অহন হিত (শীত) লাগে । বেচারা কেপে উঠলো বুঝি শীতে, অন্ধকারে কালো ছেলেটার ধবধবে দাত ছাড়া কিছুতো দেখিও না ।
- বাই, একটা উফকার করবাইন ?
- কি উপকার ? আমি আনমনে বলি। কিছুতেই পাইপে আগুন লাগানোই যাচ্ছে না, এদিকে বাতাস মনে হয় বেশি ।
পানিতে এই ফডুডা বিজ্জা (ভিজে) গেছে গা ।আমার ছুডু বাই । এডা (একটা ) বাই ই আমার, গেরামো তাহে (থাকে) জেঠার লগে ।
- জেঠার সাথে ক্যান , বাপ মা কৈ তোমাদের ?
বাবা মা মারা গেছে ব্রিজের কাজ করতে গিয়ে, অর্ধেক কাজের পরে মাটি ধসে তাদের বাবা মা চাপা পরে । কন্স্ট্রাকশন থেকে জীবনের মুল্য হিসেবে দেয়া হয় পাচ হাজার টাকা, জ্যাঠা সেই টাকা নিয়ে ছোটজনকে আশ্রয় দিয়েছে । বড় ভাই, ১৭-১৮ বছরের পরান ঢাকায় দারোয়ান ।
- ফডুডা হুগানোর ব্যাবস্তা করুন যায় নি বাইজান । নাইলে নষ্ট হৈয়া যাইবোগা ।
পরানের কন্ঠে আকুতি ।
দাও দেখি । আমি হাসলাম , ভাইয়ের জন্য অনেক মহব্বত না?
- আমাগো তো আমরা ছাড়া কেউ নাই বাই । জেডা পরাগরে হারাদিন কামলা খাটান খাটায় । মায়া মহব্বত দুনিয়ায় নাই গো বাই । মায় কইতো আমাগোরে জজ ব্যারিষ্টার বানাবো, কপাল দোষে হইলাম দারোয়ান আর কামলা ।
করুন সিনেমার কাহিনী শুনতে ভাল লাগছিলো না , বললাম, ছবিটা দাও, আমি ওভেনে দিয়ে দেখছি। তুমি ১০ মিনিট পরে এসে নিয়ে যেও ।
রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখি মিনু ফুপি চা বসাচ্ছে । পাইপটা লুকিয়ে বললাম , এতো রাতে তুমি চা খাচ্ছো ? ঘুম আসবে না তো আর ।
- আর ঘুম , যে খবর শুনলাম ।
কি খবর শুনলে?
- আর বলিস না, রোজি একটা ছেলে জোগার করে দিয়েছিলো ওর পোস্টিংয়ের এলাকা থেকে । দারোয়ানের জন্য আর কি । ছুটিতে বাড়ী ছিলো ২দিন । রোজি ফোন করে বললো, ছেলেটা নাকি নাইট কোচে ঢাকা আসতে গিয়ে বাস এক্সিডেন্ট করে মরেই গেছে । বাস পরেছিলো রাস্তার পাশের বাধ ভেঙ্গে নদীতে, পানিতে ডুবেই মারা গেছে ছেলেটা ।
চা ঢালতে ঢালতে আমার দিকে ফিরলো ফুপি। ওকি , এমন চেহারা হলো ক্যানো তোর ? ভুত দেখেছিস নাকি ?
আমি পাথর হয়ে দাড়িয়ে য়াছি ।ফুপির কথায় নড়ে উঠলাম । কিন্তু গলা দিয়ে চট করে শব্দ বেরুনো কি এতো সহজ?
- হাতে কি তোর ? কার ছবি ?
এবার সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠলো । আমার হাতে ভেজা একটা ছবিতে এক শ্যামলা শিশু কাদকাদো চোখে তাকিয়ে আছে ।
ফুপিকে কি বলবো আমি জানি না। আমতা আমতা করে বললাম , ছাদে কুড়িয়ে পেয়েছি। ফুপি আমি বরং ঘরে যাই , ঘুম পাচ্ছে ভিষন ।
ফুপি বললো, যা তাহলে , আমিও দেখি ঘুমাতে পারি কি না। আহারে জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা ।
ঘরে এসে দরজা ভেজিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ । ১০ মিনিট শেষ হয়েছে অনেক আগেই । কেউ দরজা নক করে নি । কিন্তু টেবিলের ওপরের ওই ছবিটা আমার কাছে থাকার কোনো যুক্তি নেই ।
হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমাকে আসলে কি করতে হবে । রোজি ফুপির পোস্টিং কোথায় আমি জানি, এও জানি কাল সবার আগে ওই রুটের কোন গাড়িটা পাওয়া যাবে ।
পরাগ নামের এই ছবির শিশুটিকে আমি চিনি না, কিন্তু কেউ একজন আমাকে বলতে চাচ্ছে আমি যেনো এই বাচ্চাটার পাশে গিয়ে দাড়াই । আচ্ছন্নের মতো আমি ব্যাগ গোছাতে থাকি । মধ্যরাতের বাতাস আমার জানালার বাইরে দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে গেলো