একটি ছবি প্রতিযোগিতা এবং হেজিমনি পাঠ
হেজিমনি শব্দটির প্রণেতার নাম আন্তোনিও গ্রামসি। সরল বংলায় এর মানে হচ্ছে, কোন একটা বিষয় সবার মাথায় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা, এবং সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করা যে উক্ত ধারণা সত্যি। মূলত সাম্রাজ্যবাদ, ক্ষমতা এবং সামাজিক চেতনাকে বোঝার জন্য এই শব্দটিকে ব্যবহার করা শুরু হয়। সে সময় উপনিবেশিক শাসকদের ক্ষমতা ধারা বিশ্লেষণ করার জন্য তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় তিনি দেখিয়েছিলেন যে উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী জনতাকে শাসন করার জন্য এমন এক ধরনের ধারণা তৈরি করে, যাতে জনতার মনে হতে পারে যে তারা দেশ শাসনের যোগ্য নয়।
আধুনিক গ্রামসী বিশ্লেষকরা একে আরো বিস্তৃতি করেছে। সেই অর্থে একদল মানুষ আরেক দলের মানসিকতার উপর এমন প্রভাব তৈরি করবে, যাতে দলে দলে মানুষ বিশ্বাস করে যে হ্যাঁ ঘটনা সত্যি, এটাই হল হেজিমনির ধারণা।
দৃশ্যত উপনিবেশবাদ নামক বিষয়টি অনেক আগে খতম হলেও, হেজিমনি চর্চার বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের যারা ক্ষমতাসীন, তারা “হেজিমনি” তৈরি করে প্রচার মধ্যমে, সংবাদপত্রে, রেডিওতে, টেলিভিশনে।
তবে এবার ক্ষুদ্র আকারেও ব্লগে হেজিমনির চর্চা দেখতে পেলাম।
রেডিও সার্কেল একটি ছবি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। শুরু থেকে এই প্রতিযোগিতা বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, বিশেষ করে উপমা মজুমদারে এর ছবি। সেই ছবি নিয়ে ফেসবুকে
ব্লগে এবং ফ্লিকারের লেখার সূত্র ধরে এই লেখাটার অবতারণা।
মূল লেখায় যাবার আগে ইতিহাসের একটি ঘটনা সম্বন্ধে জেনে নেই।
“হেজিমনি” একটা সামজিক ধারণা, যদিও-এর আবিস্কারের কৃতিত্ব আন্টোনিও গ্রামসির, কিন্তু কি ভাবে একটি ধারণাকে তৈরি করতে হয়, সে বিষয়টি কাজে লাগিয়েছিলেন হিটালারের প্রচারমন্ত্রী ভন গোয়েবলস। নিজে একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন”, সেটি হচ্ছে “দশটা মিথ্যা দিয়ে একটা সত্যকে চাপা দেওয়া যায়। গ্রামসি একে ব্যবহার করেছিল সমাজ এবং ঘটনা প্রবাহকে বোঝার ক্ষেত্রে, কিন্তু গোয়বলস তাকে ব্যবহার করেছিল প্রচারণা ছড়িয়ে দেরার উদ্দেশ্য।
গোয়েবলস শুধু এই বিষয়টিকে তত্ত্বের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাস্তবে প্রমাণ করে ছেড়েছিল।
তার উদাহরণটি কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর। জার্মানী পোল্যান্ড আক্রমণ করার সময় জার্মান রেডিও থেকে বার বার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল যে পোল্যান্ডের একদল সেনা কিভাবে জার্মানীর সিলেসিয়ার এক রেলস্টেশনে আক্রমণ করেছে। সেই আক্রমণে নিহত পোলিশ সেনাদেরও ছবি ছাপা হল। সারা বিশ্ব সেই কুখ্যাত পোলিশ ডাকাতদের কথা জানলো। কারণ যতগুলো জার্মান পত্রিকা ছিল, তারা আক্রমণ করতে এসে নিহত সে সব “পোলিশ সেনাদের” ছবি ছাপিয়েছিল। কিন্তু জার্মান এই প্রচারণায়, বৃটিশ এবং ফরাসীরা বিশ্বাস করেনি, তারা পোল্যান্ডের হয়ে লড়াইয়ে নামে। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথমে জার্মানীর শুরুতে বিজয় হলে এক সময় জার্মানীর পরাজয় ঘটে।
আপনাদের অনেকের হয়ত জানতে ইচ্ছে করছে, যুদ্ধে তো জার্মানীর পরাজয় ঘটলো, কিন্তু সেই সব পোলিশ আক্রমণকারী সংবাদের শেষটা কি হল? পৃথিবীতে সব সময় দু একজন পাগল থাকে যারা আসলে কোন কিছুর শেষ না দেখে ছাড়ে না। এ রকম দু একজন পাগল পাওয়া গেল যারা সেই ছবিগুলো আবিষ্কার করল, তারা খুঁজে বের করল কারা আসলে এই সব পোলিশ সেনা? গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং তাই না। কারা ছিল সেই সব পোলিশ আক্রমণকারী।
এই সব পোলিশ সেনারা হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব দাগী জার্মান আসামী, যাদের সবকটির নানা অপরাধে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া বদলে পোলিশ সেনা সাজিয়ে পোলিশ আক্রমণের নাটক সাজানোর জন্য খুন করা হয়। কিন্তু যুদ্ধপূর্ব জার্মানীতে দু-একজন ছাড়া সকল জার্মান বিশ্বাস করেছিল যে পোলিশরাই যত অপকর্মের হোতা।
এতক্ষন ধরে হেজিমনি নিয়ে এত কথা বলার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। কারণ ব্যাখ্যা করার আগে দুটি লিঙ্ক দিচ্ছি আপনারা সে দুটি সাইটে ঘুরে এসে যদি লেখার পরবর্তী অংশ পড়েন, তাহলে অন্তত হেজিমনি পাঠের বিষয় আপানদের বুঝতে খানিকটা সুবিধা হবে।
প্রথমটি হচ্ছে সায়ামহয়্যারইন ব্লগের লেখক আসিফ মুভি পাগল-এর, যার শিরোনাম "ফেসবুকীয় প্রতারণার এক অভাবনীয় নাম; রেডিও সার্কেল ফোটে কনটেস্ট "।
হেজিমনি এবং কাউন্টার হেজিমনি
যারা উক্ত লেখাটা পড়েছেন তারা আরেকবার হেজিমনির পাঠ নেই। আমরা যারা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লেখা পড়ি, তাদের বেশীর ভাগ লেখায় কোন না কোন ভাবে আমরা পড়ি ইসলাম হচ্ছে সন্ত্রাসের ধর্ম, অশান্তির ধর্ম, এবং সন্ত্রাসী মাত্রই মুসলিম। কেবল মাত্র হিন্দু, খিস্ট্রান, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাস্তিক যে এই সব কথা বিশ্বাস করে, তা নয়, অনেক উদার নৈতিক মুসলমান মাত্র বিশ্বাস করে যে আসলে মুসলমানদের রক্ত গরম। কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরো বাজে শব্দ ব্যবহার করে “গরুখোরদের মাথা গরম”। আমরা যারা বিশ্বাস করি যে মুসলিম মাত্র গরুখোর এবং তাদের মাথা গরম, তারা আবার এটাও বিশ্বাস করি যে হিন্দুরা যারা গরুর মাংস খায় না, তারা অনেক ঠাণ্ডা মাথার লোক। এই বাহ্য, ইহুদিরা তো গরুর মাংস খায়। তারা কি সব মাথা গরম করা জাতি নাকি? এই ধরনার মধ্যে পড়ে যাওয়ার নাম হচ্ছে হেজিমনি।
কাউন্টার হেজিমনি কি?
যারা এই সব প্রচারণার মাঝেও বলে যে মুসলমান মাত্রই সান্ত্রসী নয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম, সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী মাত্র, ইসলাম নিরপরাধ কাউকে খুন করার আদেশ দেয় না।
যেহেতু পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এখন সারা বিশ্বে শক্তিশালী, তাই পশ্চিমের প্রদান করা ধারনাটি “হেজিমনি” এবং তার বিরোধীতাকারীরা কাউন্টার হেজিমনির নির্মাতা।
এখানে ব্লগার আসিফ তার লেখায় ফেসবুকে রেডিও সার্কেলের প্রতারণার বিষয় লিখেছেন। এবং তার নীচে একই বিষয়ে কিছু মন্তব্য এসেছে। যাদের লেখাতে কয়েকটি ধারণা পরিষ্কার হয়। এক এই প্রতিযোগিতায় এক প্রতিযোগি উপমা মজুমদার ভোট কিনছে, তার সাথে রেডিও সার্কেলের এ্যাডমিনের যোগাযোগ আছে, যার ফলে সবার কমেন্ট মুছে দেওয়া হয়েছে [এই কাজটি করেছে সম্ভবত এ্যাডমিন এবং এর মধ্যে উপমার বন্ধুরা সম্ভবত আজে বাজে মন্তব্য করেছে এদের মন্তব্যের কিছু কিছু স্ক্রিন শট আছে, যাতে প্রমাণ হয় যে উপমা ভোট কিনছে, এই লেখার নীচে কিছু মন্তব্য আছে তাতে জানা যাচ্ছে উপমার বন্ধুরা বাজে মন্তব্য করেছে, কিন্তু ২৫০ টি মন্তব্যে উপমাকে সম্ভবত কেউ খারাপ কিছু বলেনি।]।
তার লেখার মাঝে একটা জায়গায় কি ভাবে ভোট উপমা মজুমদার ভোট কিনছে তার জন্য তিনি প্রমাণ স্বরূপ তিনি মাইক্রোওয়ার্কারসের মত সাইটের একটি স্ক্রিনশর্ট দিয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে উপমা মজুমদার এই ভোট কেনার মত ঘটনার সাথে জড়িত।
যেহেতু ব্লগার নিজে কিংবা এবং এই ভোট চুরির বিষয়ে মন্তব্যকারীদের কেউ কোন প্রাতিষ্ঠানিক মামলা দায়ের করেনি, তাহলে একে আমি একটা “হেজিমনি” কিংবা একটা ধারণা তৈরির প্রচেষ্ঠা বলে ধরে নেব।
প্রতিযোগিতা নিয়ে তাদের আপত্তির কথা এখন ফেসবুক-এর বাইরে ব্লগ এবং ফ্লিকারে ছড়িয়ে পড়েছে তা এই দুটি এই লিঙ্ক থেকে বোঝা যাবে, তাতে কি সত্যি মানুষ প্রভাবিত হয়?
লেখক আসিফের ব্লগে টিএস আবতাহি নামের একজন মন্তব্যকারি তার মন্তব্যে ফ্লিকারে একটি ডিসকাসন পাতার লিঙ্ক দিয়েছে তাতে অবশ্য উপমার ছবি কার কাছ থেকে কি মন্তব্য লাভ করেছে তা জানতে পারবেন। এই বিষয়টি ফ্লিকার পাতায় দেওয়ার উদ্দেশ্য কি?
এর উদ্দেশ্য একটাই, যাতে এই ধারণাকে আরো শক্তিশালী করা যে ছবির মালিক পয়সা দিয়ে ভোট কিনছে। তাতে কি সবাই প্রভাবিত হচ্ছে।
ফ্লিকারের এই পাতায় ক্যাচ দি ড্রিম নামে এক ব্যক্তি “এই ছবি কেনা বেচার ব্যাপারে ছি ছি করছেন”। উক্ত ভদ্রলোকের পরিচয়, উনার নাম মনিরুজ্জামান । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক এবং একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। তার মানে উনি বিশ্বাস করেছেন, যে এই ছবিটা ভোট কেনাবেচার সাথে জড়িত।
তিনি আরো লিখেছেন “প্রাইজ দিবে কবে, কোথায়? ওইদিন উপমা মজুমদার ক্যামেরা হাতে বের হলেই তার মুখে পচা ডিম এবং টমেটো ছুড়ে মারার জন্য একটা টিম ঠিক করা যেতে পারে।
তার মন্তব্যে আরো আছে।
"এই টিম এ লোক রিক্রুট করার জন্য microworkers.com এ বিজ্ঞাপন ও দেয়া যেতে পারে।
উনি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন এবং পুরস্কারটি পর্যন্ত উপমাকে দিয়ে দিয়েছেন। (বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং ফটোগ্রাফী সোসাইটির একজন হিসেবে এটা উনার দায়িত্ব যে এই ছবি এবং এই প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা, অথবা ভোট কেনা বেচার বিষয়টি অন্তত সোসইটিতে তোলা। তিনি তা করেছেন কি? তার বদলে তিনি কিছু কঠিন মন্তব্য করেছেন মাত্র। )
এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, হয় তিনি এই হেজিমনির দ্বারা প্রভাবিত, নতুবা তিনি নিজেই এই হেজিমনির অংশ।
আসিফের লেখার নীচে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ উপমার পক্ষ হয়ে লেখার চেষ্টা করেছে। তারা আসলে কাউন্টার হেজিমনির অংশ। তাদের একজন বাল্মিকি জানাচ্ছে যে যে সাইট থেকে টাকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে তার কোন ভিত্তি নেই।
ভোট কেনার ব্যাপারে নিজের মাথায় কিছু প্রশ্ন এসেছে। যা কাউন্টার হেজিমনির অংশ।
১) এই ছবিতে .১২ সেন্ট মানে প্রায় ১০ টাকায় ভোট কেনা হচ্ছে। এই টাকায় কি ফেসবুকে ভোট কেনা সম্ভব? উপমার ছবিতে প্রায় ১২০০-এর মত ভোট পড়েছে। এদের মধ্যে কতজন ব্যক্তি টাকা খেয়ে ভোট দিয়েছে? তারা কি তাদের ভোট কে এত সস্তায় বিক্রি করে দিচ্ছে?
যারা ভোট দিয়ে ১২ সেন্ট পাচ্ছে, তারা কি ভাবে এই ১২ সেন্ট পাচ্ছে? উপমা কেন টাকা বাদ দিয়ে সেন্টে অর্থ লেনদেন করছে। সম্ভবত ইন্টারনেটে টাকা লেনদেনের কোন ব্যবস্থা নেই। যদি সেন্টে সব কিছু লেনদেন হয়, তাহলে উপমা কোথায় টাকাকে সেন্টে রূপান্তরিত করেছে। আর যদি বাংলাদেশের ১২০০ মানুষের একাউন্টে এই অর্থ লেনদেন হয়, তাহলে নিশ্চয় কোথাও না কোথাও এর প্রমাণ রয়েছে, সেগুলো কোথায়? ইন্টারনেটের কোন সাইটে, নাকি ব্যাংক একাউন্টে? আমি যতদূর জানি যদি সেন্টে টাকা পাঠতে হয় তাহলে বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন পালন করতে হয়, এখানে কি ভাবে সেই নিয়ম কানুন পালন করা হচ্ছে। ইন্টারনেটে ১২০০ লোক নিশ্চয় কোন না কোন সোর্স থেকে টাকাটা পাচ্ছে? তাদের মধ্যে থেকে কেউ জানাবেন কি, কোথা থেকে টাকাটা আসছে?
ইন্টারনেটে এই লড়াইটা কি হেজিমনির লড়াই, নাকি সত্যক প্রতিষ্ঠার লড়াই, সময় তা বলে দেবে। তবে আসিফের এই লেখাটা যদি সত্য হয়, তাহলে মারাত্মক এক ধারণা, মানে হেজিমনির মধ্যে অন্তত আমি নিজেই পড়ে যাব।
“জাতি হিসেবে আমরা মাত্র ১২ সেন্টে বিক্রি হয়ে যাই”।
রেডিও সার্কেল-এর ছবি প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করতে চাইলে এই লিঙ্কে প্রবেশ করুন।
উপমাকে সমর্থন করে ফেসবুকে বিজয় মজুমদারের এই লেখাটা পড়তে পারেন, এখানে
এ ছাড়া আজকে এই ঘটনার উপর ইউকে বিডি নিউজে একটা সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কে ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১০:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



