কোনো ধরনের চাপের কারণে যদি বিচার কার্য তার নিরপেক্ষতা হারায় তাহলে বিচার বিভাগ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচার বিভাগ তার নিজস্ব দায়িত্ব পালন করবে। আইনের বাইরে কোনো ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করা ঠিক নয়। কথাগুলো বলছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান।
সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাৎকার।
সাপ্তাহিক : দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরনো। অতীতেও ছিল এখনও আছে। সামনে সংঘাত আরও বাড়বে। গত দুই দশক ধরে এই সংঘতের চিত্র বেশ প্রত্যক্ষ করা গেছে। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন শুধু গণতন্ত্র নয়, অতিসম্প্রতি ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নগুলো এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ কারণেই বর্তমান রাজনীতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের সকলের জন্যই খুব উদ্বেগজনক।
সাপ্তাহিক : এই যে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, এর জন্য সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো কী কোনো সমাধানে আসতে পারবে? সরকারের কী করা উচিত বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান : আমি মনে করি, এখানে সরকারের দৃঢ় নেতৃত্বের প্রয়োজন। এর জন্য প্রথমত সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো ধরনের বেআইনি কাজ এবং উচ্ছৃঙ্খলতা যেন না ঘটে। অন্যদিকে সরকারকে মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক যে কাঠামো আছে তার যেন কোনো ক্ষতি সাধিত না হয়। মানবাধিকার, আইনের শাসনের মতো বিষয়গুগুলো সুস্পষ্টতা নিশ্চিত করতে হবে।
এই অবস্থায় আমি মনে করি, সরকারের উচিত হবে সকল সিদ্ধান্ত একা গ্রহণ না করা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যা সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
সাপ্তাহিক : রাজনৈতিকভাবে সমাধানের কথা অনেকেই বার বার বলে আসছেন। সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো তাগিদ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার রাজনৈতিক সমঝোতায় আসবে?
আকবর আলি খান : সরকার করবে কি করবে না সেটা সরকারের ব্যাপার। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্বও সরকারের। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কী করলে ভালো হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া। সরকার শুনবে কি শুনবে না সেটা তাদের এখতিয়ার। আমরা তো ভাবনা করতেই পারি।
সাপ্তাহিক : আপনি বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ধর্মকে নতুন মাত্রা হিসেবে উল্লেখ করলেন। রাজনীতি, সমাজে ধর্মের প্রভাব তো আগে থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। এখন কেন এই বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে?
আকবর আলি খান : যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। ধর্মীয় ইস্যুটি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে এই বিচার কাজকে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য। আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া জরুরি। এই দাবি জনগণের। আওয়ামী লীগ বিচারের ওয়াদা করে ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধের বিচার করা আওয়ামী লীগের নৈতিক দায়িত্ব। সরকার প্রথম থেকেই বলে আসছে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে। সুতরাং এই স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ করার চেষ্টা চলবেই। সরকারের দায়িত্ব হবে সব রকমের সমালোচনা এবং চাপের ঊর্ধ্বে থেকে বিচারের স্বচ্ছতা বজায় রাখা।
সাপ্তাহিক : যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণদের আন্দোলন চলছে। তরুণদের এই আন্দোলন কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে বা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় এরকম আন্দোলন হয়েছে সেখানে বিপ্লবী এবং অতিবিপ্লবীর চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। আপনি যদি ফরাসিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখতে পাবেন, ১৭৮৯, ১৮১৯ এবং ১৮৪৮ সালে বিপ্লব হয়েছে। আঠার শতকের সত্তরের দশকে এবং ঊনিশ শতকের ষাটের দশকেও বিপ্লব হয়েছে। এই বিপ্লবগুলো চেতনার মধ্য দিয়েই হয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাাপাশি আবেগও রয়েছে। এখানে আবেগটা একটু বেশিই বলে মনে হচ্ছে। চেতনা জিইয়ে না রেখে শুধু আবেগ দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি।
সাপ্তাহিক : আপনি কী মনে করেন, তরুণদের এই আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিশেষ প্রভাব ফেলবে?
আকবর আলি খান : আমি সামগ্রিক বিবেচনায় বলছি, কোনো ধরনের চাপের কারণে যদি বিচার কার্য তার নিরপেক্ষতা হারায় তাহলে বিচার বিভাগ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচার বিভাগ তার নিজস্ব দায়িত্ব পালন করবে। আইনের বাইরে কোনো ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করা ঠিক নয়।
সাপ্তাহিক : অনেকেই তো মনে করছেন, এই বিচার নিয়ে সরকার যে চাপে রয়েছে তার পাল্টা জবাব দিতেই আন্দোলন। আন্দোলনের শুরুতে আইন প্রতিমন্ত্রীও এমন মন্তব্য করেছেন?
আকবর আলি খান : সরকারের কোনো বক্তব্যের ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এগুলো সরকার ভালো জবাব দিতে পারবে।
সাপ্তাহিক : আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী বলবেন?
আকবর আলি খান : যারা আন্দোলন করছে, কী উদ্দেশ্যে আন্দোলন করছে তার জবাব তারাই দিতে পারবে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার কাছে নেই।
আমার মনে করারও কিছু নেই। আমি মনে করলেও কিছু আসে-যাবে না। যাদের কেন্দ্র করে আপনার এই প্রশ্ন তাদেরকেই জিজ্ঞেস করুন। আমার যে বক্তব্য তা প্রথমেই বলে দিয়েছি।
সাপ্তাহিক : এই আন্দোলনকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন। আপনি কী মনে করেন এর মাধ্যমে আমাদের রাজনীতিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসবে?
আকবর আলি খান : আমি আগেই বলেছি, তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু আবেগ রাজনীতির পরিবর্তনের কোনো নিয়ামক হতে পারে না। আবেগ কোনো সঠিক সমাধানও দিতে পারে না। তরুণদের এই আন্দোলন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কিনা এমন ভবিষ্যদ্বাণী আমি করতে চাই না। যারা এই আন্দোলন করছেন তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিও না। যাদের আমি চিনিই না তাদের ব্যাপারে কী মন্তব্য করব? আপনি যদি তাদের চিনে থাকেন, তাহলে তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করুন। আন্দোলন নিয়ে এর বাইরে এর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব নয়।
সাপ্তাহিক : তরুণদের এই আন্দোলনের বিপরীতে বেশ শক্তভাবেই ধর্মীয় দলগুলো মাঠে নেমেছে। তাদের এই অবস্থান নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
আকবর আলি খান : বৈপ্লবিক চেতনা এবং এর বিপরীত স্রোতের সঙ্গে নিরন্তর সংঘর্ষ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এই আন্দোলনকেও সেই জায়গা থেকেই দেখতে হয়। আবার এর মধ্য দিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে তাও বলা যাবে না। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে সেখানেই এমন প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে যেহেতু অনেক আগে থেকেই সংঘাতের রাজনীতি চলে এসেছে এবং এই বিচার অনেক পরে শুরু হয়েছে সুতরাং এই ইস্যুতে সঙ্কট সৃষ্টি হবে এটি স্বাভাবিকই বটে।
সাপ্তাহিক : সঙ্কট নিরসনে পুলিশ গুলি করছে। এতে সঙ্কট আরও বাড়তে পারে কীনা? সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে কীনা?
আকবর আলি খান : পুলিশের অবস্থা আমাদের চাইতে আপনারাই ভালো জানেন। আপনাদের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি। সুতরাং পুলিশ কী করছে এই বিষয়ে আমার কাছে জানতে না চাওয়াই ভালো।
সাপ্তাহিক : আসলে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী? আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
আকবর আলি খান : দেখুন আমি প্রথমেই বলেছি যে, আমরা এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে উদ্বেগ তত বাড়ছে। রাজনৈতিকভাবেই সঙ্কট বাড়ানো হচ্ছে।
আমি মনে করি, রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য। এই ধরনের সংঘাতের জন্য গণতন্ত্রের যাত্রা যদি ব্যাহত হয় তাহলে সঙ্কট দীর্ঘায়িত হবে।
উত্তরণের কথা আমরা বার বার বলেছি। হাজার বার বলেছি। সমঝোতা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
সাপ্তাহিক : সমঝোতা কীভাবে সম্ভব?
আকবর আলি খান : দুই দল ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় যে কোনোভাবে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তারা যদি ইচ্ছা না করে তাহলে আমরা যতই বলি সমস্যা সমাধান হবে না। সব কিছুই দুই দলের ওপর নির্ভর করছে।
সাপ্তাহিক : এমন পরিস্থিতিতে অন্য কোনো শক্তি বা বলয় গুরুত্ব পাচ্ছে কীনা?
আকবর আলি খান : আমি এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। অপেক্ষা করতে হবে। পরিস্থিতি এবং সময়ই বলে দেবে।